মেসুত ওজিল আর জার্মানি জাতীয় দল—গল্পটা দারুণ কিছুর ইঙ্গিত দিয়েও শেষটা হলো কী বিস্বাদে! তবে তার তেতো প্রতিক্রিয়া সইতে হয়েছে গল্পের অনেক কুশীলবকেও। রিয়াল মাদ্রিদ ও জার্মানি দলে ওজিলের সাবেক সতীর্থ টনি ক্রুসই যার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির চূড়ান্ত ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় বলি হয়েছেন ওজিল। চারিদিক থেকে সমালোচনা শুনতে শুনতে একটা সময় আর সইতে পারেননি, জার্মানি দলকে বিদায় জানিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর বিদায় জানানোর ধরন আবার অনেকের পছন্দ হয়নি। এই অনেকের মধ্যে ছিলেন ক্রুসও। ওজিলের সমালোচনা করেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ডার।
কিন্তু সে জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গঞ্জনা সইতে হয়েছে ক্রুসকে। রিয়াল মিডফিল্ডারের চেহারা, নীল চোখ, চুলের ছাঁটের সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসে কলঙ্কিত জার্মান প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলারের অনুসারী নাৎসিদের সঙ্গে বেশ মিল আছে। ওজিলের সমালোচনার পর তাঁকে সে সময় তাই ‘নাৎসি’ বলেছিলেন অনেকে। ‘হিটলারের চ্যালা’ নাম পেয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন ক্রুস নিজেই।
জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টাইনমায়ারের সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম লাইভে সে সময়ের কথা জানিয়েছেন ক্রুস, ‘২০১৮ বিশ্বকাপের পর আমি বলেছিলাম মেসুত ওজিলের অবসর নেওয়া আর ও যেভাবে অবসর নিয়েছে সেটির ধরনটা আমার পছন্দ হয়নি। এরপর হঠাৎই অনেকের কাছে আমি “নাৎসি” হয়ে গেলাম! সোনালি চুল, নীল চোখ...অনেকের কাছে (ক্রুসকে নাৎসি ডাকার জন্য) সব উপকরণই ছিল।’
তিন বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে তুরস্কের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন ওজিল ও জার্মানির আরেক মিডফিল্ডার ইলকায় গুন্দোয়ান। ওজিল-গুন্দোয়ান দুজনই তুর্কি বংশোদ্ভূত। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে তুরস্কের নির্বাচনী প্রচারণার সময় এরদোয়ানের মতো পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বিতর্কিত একজনের সঙ্গে ওজিল-গুন্দোয়ানের ছবি তোলা ভালোভাবে নেয়নি জার্মানির মানুষ। গোদের ওপর বিষফোড়া, বিশ্বকাপ ইতিহাসে ৮০ বছর পর সেবার গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ে জার্মানরা। কিন্তু বিশ্বকাপের পর ওজিলদের ওই ছবিই অনেক বড় বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
খারাপ খেলায় জার্মানি দলের সমালোচনা হয়নি, তা নয়। কিন্তু নয়্যার-ক্রুসদের কিংবা কোচ ইওয়াখিম ল্যুভের সমালোচনা যতটা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সমালোচনা হয়েছে ওজিল-গুন্দোয়ানের। এর আগে এত বছর জার্মানির হয়ে খেলেছেন দুজন, জার্মানির জার্সিতে ৯২ ম্যাচ খেলা ওজিলের জার্মানির ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ে বড় অবদান। কিন্তু সেসব ভুলে জার্মানরা হঠাৎ প্রশ্ন তুলে দেয়, ওজিলরা আসলে তুরস্ককে ভুলে পুরোপুরি জার্মানির হতে পারেননি। ওজিল অবশ্য সব সময়ই বলে এসেছেন, দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার কোনো মানে দেখেন না তিনি। যতটা তুরস্কের, ঠিক ততটাই জার্মানির বলে নিজেকে পরিচিত করেছেন সব সময়।
তাতেও সমালোচনা থামেনি। এমনকি জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের (ডিএফবি) কর্তারাও ওজিলের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যার মধ্যে ছিলেন সে সময়ের ডিএফবির সভাপতি রাইনহার্ড গ্রিন্ডেলও। এরপরই ওজিল জার্মানির জার্সিতে আর না খেলার ঘোষণা দিয়ে দেন। ‘ডিএফবি ও আরও অনেকের কাছ থেকে যে আচরণের শিকার হয়েছি এরপর জার্মানির জাতীয় দলের জার্সিটা গায়ে দেওয়ার ইচ্ছে আমার আর নেই। নিজেকে জার্মানি দলে অপ্রয়োজনীয় একজন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর আমার অর্জনগুলো কী কী, মানুষ সেসব ভুলে গেছে,’ অবসরের ঘোষণায় বলেছিলেন ওজিল।
ডিএফবি সভাপতি গ্রিন্ডেলকে কড়া জবাব আর জার্মানির প্রতি তাঁর নিবেদন নিয়ে প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে দিয়েছেন পরের কথায়, ‘গ্রিন্ডেল ও তাঁর সমর্থকদের চোখে আমরা যখন জিতি তখন আমি জার্মান, আর যখন হেরে যাই, তখন আমি একজন অভিবাসী।’
এর জবাবে ক্রুস কী বলেছিলেন? ওজিলের প্রশংসা-সমালোচনা দুটিই করেছেন তখন। রিয়ালের হয়ে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা মিডফিল্ডারের চোখে, ‘মূল কথা হচ্ছে মেসুত ওর যোগ্যতার কারণেই জাতীয় দলে খেলেছে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে ওর বিদায়টা আরও ভালোভাবে হওয়া উচিত ছিল।’
কিন্তু ওজিল যেভাবে বর্ণবাদের অভিযোগ এনেছেন জার্মান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে, সেটি পছন্দ হয়নি ক্রুসের, ‘বিবৃতিতে যে অংশগুলোতে ও একেবারে ঠিক কথাটি বলেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো ছাপিয়ে গেছে বিবৃতিতে অনেক বেশি পরিমাণে থাকা আলতু-ফালতু কথা। আমার মনে হয় ও খুব ভালো করেই জানে যে জাতীয় দল ও ডিএফবির কোনো জায়গাতেই বর্ণবাদ নেই।’
এ সমালোচনার কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওজিলভক্তদের তোপের মুখে পড়েন ক্রুস। এমনিতে তো ‘শ্রুতিমধুর’ অনেক শব্দ শুনতে হয়েছেই, তাঁর নীল চোখ, লেপটে থাকা সোনালি চুল মিলিয়ে হিটলারের ‘নাৎসি’ দলের অনুসারী অপবাদও শুনতে হয়েছে ক্রুসকে। তবে সেটা ক্রুস ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম লাইভে, ‘আমি সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। যে কেউই ভুয়া প্রোফাইলের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে, যে কাউকে চাইলে অপমানও করতে পারে। ওদের কে থামাবে!’
২০১৮ বিশ্বকাপের পর অবশ্য ক্রুস ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপসহ কিছু ট্রফি জিতলেও ওজিলের ক্লাব ক্যারিয়ারও পেছনের দিকেই গেছে। আর্সেনালে আর্সেন ওয়েঙ্গারের বিদায়ের পর আসা দুই কোচ উনাই এমেরি ও মিকেল আর্তেতা—কারও অধীনেই দলে জায়গা পাকা করে নিতে পারেননি ওজিল। এই মৌসুমে তো আর্সেনাল তাঁকে লিগের দলেই রাখেনি। জানুয়ারিতে অবশেষে মুক্তি মিলেছে ওজিলের, চুক্তির ছয় মাস বাকি থাকা সত্ত্বেও আর্সেনাল তাঁকে বিনা মূল্যে ছেড়ে দিয়েছে তুরস্কেরই ক্লাব ফেনেরবাচেতে।
সেখানেও অবশ্য এখনো সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি ওজিল। লিগে ৬ ম্যাচ আর তুর্কি কাপে ১ ম্যাচ—৭ ম্যাচ খেলেও কোনো গোল করতে পারেননি, করাতেও পারেননি। এর মধ্যে গতকাল আন্তালিয়াসপরের বিপক্ষে লিগের ম্যাচে অ্যাঙ্কেলের লিগামেন্টে চোট পেয়ে মাসখানেকের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেছেন ওজিল।