মালয়েশিয়া কোচ ও এক ফুটবলার সংবাদ সম্মেলনে আসামাত্রই স্থানীয় সাংবাদিকেরা করতালি আর উল্লাসধ্বনি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানালেন। ২০০৭ সালে স্বাগতিক হিসেবে খেলার পর এই প্রথম এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠার ছাড়পত্র পেয়েছে মালয়েশিয়া। সবার মধ্যে তাই বাঁধভাঙা আনন্দ ছিল সোমবার গভীর রাতে।
সেই আনন্দ কয়েক গুণ বেড়ে যায় ১৯৮০ সালের পর মালয়েশিয়া এই প্রথম নিজেদের যোগ্যতায় সরাসরি এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পারায়। মাহেন্দ্রক্ষণটা এসেছে বাংলাদেশকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে। এমন রাতে কুয়ালালামপুরে খুশির বন্যা। তবে সেটা শুধু বুকিত জলিল স্টেডিয়ামের ভেতর। স্টেডিয়ামের বাইরে কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। ম্যাচ শেষে সবাই নীরবে যার যার গন্তব্যে।
স্টেডিয়াম যখন অনেকটা ফাঁকা, নিজেদের উৎসব–আনন্দ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসতে একটু দেরিই হলো মালয়েশিয়ার কোচ কিম প্যান গনের। সঙ্গে ছিলেন ম্যাচে অন্যতম গোলদাতা দেশটির বেলজিয়ামপ্রবাসী ডিফেন্ডার ডিওন কুলস। দুজনই ছিলেন খুশি এবং দলকে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নিতে পারায় তাঁরা তৃপ্ত।
এই প্রাপ্তি শুধু তাঁদের নয়, গোটা দেশবাসীর জানিয়ে কোচ ধন্যবাদ দিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবিরকে, যিনি মাঠে ছিলেন এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের শেষ দুই ম্যাচে। কোচ ধন্যবাদ দেন গোটা দেশবাসীকে, যারা তাঁর দলের পাশে ছিল বারবার। বিশেষ করে দর্শকদের কথা বারবার বলেছেন। ‘আলট্রাস মালায়া’ নামের মালয়েশিয়ার মারদাঙ্গার সমর্থকগোষ্ঠীর কথাও আলাদাভাবে এসেছে, যদিও কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয় তাঁদের নয়।
মালয়েশিয়ার কোচ কথা বলে যাওয়ার একটু আগে বাংলাদেশ কোচ সংবাদ সম্মেলনে আসেন মুখ কালো করে। তাঁর জন্য হতাশার ছিল সফরের শেষ ম্যাচটা। প্রথমেই বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য কঠিন ম্যাচ ছিল। ওরা মাঠে ছিল দুর্দান্ত। আমাদের জানা ছিল, ওরা শুরু থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের কাজ ছিল ওদের প্রতিরোধ করা। তবু পেনাল্টির পরও প্রথমার্ধ শেষে আমরা এমন জায়গায় শেষ করেছি, যেখান থেকে জিততেও পারতাম। কিন্তু আমরা আমাদের খেলাটা কখনোই খেলতে পারিনি। আমাদের ধারাবাহিকতার অভাব ছিল।’
গ্যালারিতে ৫২ হাজার দর্শকের উল্লাস বাংলাদেশের জন্য চাপ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশ কোচ কাবরেরার ভাষ্য ভিন্ন, ‘মালয়েশিয়ায় মাঠে পরিবেশ এমনই থাকে। এটা হতে পারে আগে থেকেই জানতাম আমরা। ফলে এটা কোনো বিষয় নয় আমার কাছে।’
কোচ যোগ করেন, ‘আমরা ধারাবাহিক হতে পারিনি শেষ মাচে। তবে আমি মনে করি, এর চেয়ে ভালো করার সামর্থ্য আমাদের ছিল। এখন ভিডিও দেখে ভুলগুলো নিয়ে কাজ করব। সবকিছু বিচার–বিশ্লেষণ করব। এটা ধরে আমাদের সামনে পা বাড়াতে হবে।’
সফর শেষে প্রাপ্তি কী, জানতে চাইলে তাঁর কথা, ‘আমরা উন্নতি করেছি। এটা ধরে রাখতে হবে এবং সামনে আরও উন্নতি করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নতির ধারায় আছে।’
তারিক কাজী, সুমন রেজা, সাদ উদ্দিন, নাবিব নেওয়াজসহ দলে ছিলেন না প্রথম সারির ৮ ফুটবলার। তাঁরা থাকলে বিরাট কিছু হয়ে যেত না। কারণ, বাংলাদেশের ফুটবলাররা ১৯-২০। যা–ই বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন। তাই দলে কে আছে কে নেই, এসব বড় হয়ে ওঠে না। তবে আরেকটু ভালো কী হতে পারত, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ কোচের উত্তর, ‘পুরা দল নিয়ে এলে কী হতো, আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, যারা এসেছে, তারা সেরাটা দিয়েছে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।’
বাংলাদেশ সময় আজ রাত আটটায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে বাংলাদেশ। ফেরার আগে প্রাপ্তি কী, কী উপলব্ধি? উপলব্ধি এটাই যে দেশে ভালো মানের ফুটবলার তৈরির কোনো বিকল্প নেই। ফুটবলাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তাঁদের ভুলত্রুটি হতেই পারে। ভুল নিয়ে সমালোচনাও করা যায়। কিন্তু আসল সমস্যা গোড়াতেই। দেশের ফুটবল সংস্কৃতি যেমন নেই, নেই উন্নতি করার কার্যকর কোনো পথরেখাও।
আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে তৈরি হতে হবে ছোট থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলে সেই ধারাই নেই। ছোট থেকেই এ দেশে ফুটবলারদের ভালোভাবে তুলে আনার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এসব নিয়ে ভাবার লোকও কম।
তারপরও বাফুফে বলতে পারে, ‘সব সুযোগ-সুবিধা তো আমরা দিচ্ছি। আমরা তো মাঠে খেলে দেব না।’ কথাটা ঠিক। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মুখে এখন কোনো অভিযোগও নেই। কিন্তু সামর্থ্য সেরাটা তাঁরা দিতে পারেননি শেষ ম্যাচে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে নিজেদের খেলাটা খেলতে পারেনি। বলা ভালো, মালয়েশিয়া খেলতে দেয়নি। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের সামনে মালয়েশিয়া নাকি ব্রাজিল—রীতিমতো গোলকধাঁধায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
সেই গোলকধাঁধা নিয়েই আরেকটি সফরের শেষে এসে যথারীতি হাহুতাশ। শেষটা ভালো হতে হতে আর হয় না। গত বছর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের সঙ্গে জিতলে ফাইনাল। সেই ফাইনাল দেখতে দেখতে নেপালের সঙ্গে পেনাল্টিতে গোল খেয়ে ড্র। সাফের পর শ্রীলঙ্কার চার জাতি টুর্নামেন্টে ফাইনালে উঠতে উঠতে শেষ দিকে গোল খেয়ে অবিশ্বাস্য হার। এবার বাহরাইনের সঙ্গে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে গোল না খাওয়া তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার পর আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যে শেষ ম্যাচে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভালো করা সম্ভব। কিন্তু শেষ দিনে এসেই শেষটা হলো বাজে।
ঢাকায় বসে বাংলাদেশের ফুটবল সংগঠকেরা শুধু কথা বলায় পটু। দেশের ফুটবল কাঠামোর কোনো ঠিক নেই, অথচ ‘এই করব’ ‘সেই করব’ বলে স্বপ্ন দেখান। দেশে ক্লাবগুলোর যাচ্ছেতাই অবস্থা। ক্লাব শক্তিশালী না হলে জাতীয় দল কখনোই শক্তিশালী হয় না। মালয়েশিয়া দেখাল, বাংলাদেশ কোথায় পড়ে আছেন। এখানে ইউরোপের মতো যে ফুটবলীয় অবকাঠামো, তাতে মালয়েশিয়ার বড় জয়ে অবাক হওয়ার কিছুই নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক।
অতীতে বাংলাদেশ দলের ভেতর নানা দ্বন্দ্বের কথা শোনা যেত। খেলা ছাপিয়ে সাংবাদিকেরা দলের ভেতরকার সেসব দ্বন্দ্ব নিয়েই লিখতেন বেশি। কিন্তু এখন ছবিটা পাল্টেছে। এখন আর দলে দ্বন্দ্ব বা ভেতরে কোনো অসন্তোষ বড় কোনো বিষয় নেই। এখন মূল হলো দল কেমন খেলল, কী অর্জন করল? আর সেটার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উঠে আসছে ব্যর্থতাই।
কোচ কাবরেরা প্রতিদিন একই একাদশ খেলিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করেছেন, কুয়ালালামপুরে এসেও একই একাদশ এবং একই ছকে খেলিয়ে গেছেন টানা। যে চিন্তা নিয়ে শুরু করেছেন, সেটা দিয়েই শেষ করেছেন। কোনো পরীক্ষায় যাননি কোচ। যখন ভালো কিছু হচ্ছে না, পরিকল্পনা দুইয়ে যেতে পারতেন কি না, কেউ কেউ সে প্রশ্নও তুলতে পারেন।
একাদশের ওপর আস্থা রাখা ভুল কিছু নয়। তবে বিশ্বনাথ ঘোষ যেখানে রাইটব্যাক, তাঁকে সব কটি খেলানো হলো স্টপারে। তপু না থাকায় এবার লিগে বসুন্ধরা কিংস স্টপারে খেলিয়েছে বিশ্বনাথকে, এটা ঠিক। তবে দলে থাকা প্রথাগত স্টপার রিয়াদুলকে দেখা যেত কি না, আসছে সেই প্রশ্নও। রিয়াদুলকে এক মিনিটও নামানো হয়নি এ সফরে। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট বলছে, রিয়াদুলের চেয়ে তাদের চোখে বিশ্বনাথ এগিয়ে।
নবাগত সাজ্জাদকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলিয়ে গেছেন কোচ, যাঁর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। প্রশ্ন আসতে পারে, বিকল্প কে? বিকল্প মাহবুবুর রহমান সুফিল হতে পারতেন। যদিও মাহবুবুর রহমান বসুন্ধরা কিংসের হয়ে বেঞ্চেই ছিলেন, তবে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা তাঁর ভালো। মাহবুবুরকে শেষ দিকে বদলি নামান কোচ। কিন্তু কিছু করতে পারেননি। তবে সাজ্জাদ যখন পেরে উঠছেন, তখন একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে পারতেন কি না কোচ, সেই আলোচনাও আছে।
অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার নাবিব নেওয়াজকে বাদ দিয়ে এসেছেন কোচ কাবরেরা। ক্যাম্পে কয়েক ঘণ্টা পর আসায় শৃঙ্খলার কারণ দেখিয়ে নাবিবকে বাদ দেন তিনি। অনেকে বলছেন, নাবিবকে দরকার ছিল দলে। অ্যাটাকিং থার্ডে নাবিব বল পায়ে রাখতে পারেন, যেটা পারেনি সাজ্জাদ। কোচ বলতে পারেন, শৃঙ্খলা তাঁর কাছে আগে। নিশ্চয়ই শৃঙ্খলা আগে। তবে নাবিবকে অন্যভাবে শাস্তি দেওয়া যেত কি না, এমনটাও আলোচনায় আসছে।
সাজ্জাদ বল ছাড়া ভালো রানিং করেছেন। তবে ভালো জায়গায় বল পেয়েও গোল করতে পারেননি। তাঁর জায়গায় অভিজ্ঞ কেউ থাকলে গোল হতে পারত কি না, দ্বিতীয় ম্যাচের পর এই প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে কোচ নেতিবাচক প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, কোচ সমালোচনা নিতে পারেন না। প্রশ্ন মনমতো না হলে নেতিবাচক বলে উড়িয়ে দেন। তা–ও যদি তিনি শেষটা ভালো করে ফিরাতে পারতেন, একটা কথা ছিল। সেটাও হয়নি। সব মিলিয়ে সফরের শেষ দিনটা ভালো না কাটায় উঠে আসছে দলের ভেতরের নানা ফাঁকফোকর। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দুদিন পর সব ভুলে যাবেন কর্তারা। আরেকটি সফর আসবে, আবার একই গল্প তৈরি হবে। এভাবেই তো চলছে বাংলাদেশের ফুটবল!