এমবাপ্পে-গ্রিজমানদের যেভাবে খেলাবেন দেশম

ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম। ফাইল ছবি
ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম। ফাইল ছবি

১৯৯৮ বিশ্বকাপ, ২০০০ ইউরো। এরপর ২০০৬ বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়া ছাড়া বিশ্বমঞ্চে বলার মতো সাফল্য নেই ফ্রান্সের। এবার সেই খরা কাটতে পারে। ফ্রান্সের বর্তমান প্রজন্ম তাদের সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছে। অসাধারণ স্কোয়াড, অভিজ্ঞ কোচ দুটিই রয়েছে ফ্রান্সের। ২০১২ থেকে দলের দায়িত্বে থাকা দিদিয়ের দেশম রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য দল গড়েছেন নিজের মতো করে। তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন দেশম। তবে সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের মান নিয়েও করেননি কোনো আপস। তা না হলে কী আর লাকাজেরের মতো স্ট্রাইকারকে দলের বাইরে থাকতে হয়!

এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট ফ্রান্স। দলটির সামর্থ্য নিয়ে নেই কোনো সন্দেহ। ফর্মের তুঙ্গে রয়েছে এরা। ২০১৬ ইউরো ফাইনাল হারের পর খেলা ২৭ ম্যাচে দলটি হেরেছে কেবল ১টি ম্যাচ। যেটি তাদের ধারাবাহিকতার প্রমাণ।

দিদিয়ের দেশম দল ঠিক করেন প্রতিপক্ষ বুঝে। তাঁর পছন্দের দু’টি ফরমেশন ৪-৩-৩ এবং ৪-৪-২। প্রতিপক্ষের রক্ষণ দুই দিকে (ফুলব্যাক) ভালো হলে ব্যবহার করেন ৪-৩-৩। দুই অ্যাটাকিং উইঙ্গার থাকেন যারা দুইদিক থেকেই গতি, স্কিলের মাধ্যমে রক্ষণকে নড়বড় করে দিতে পারেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণ যদি মাঝে ভালো হয় তাহলে দুই স্ট্রাইকার খেলান দেশম।

তাঁর ৪-৩-৩ ফরমেশনেই সেরাটা বেরিয়ে আসে ফ্রান্সের। মিডফিল্ডে থাকেন পল পগবা। একসময়ের বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় ফ্রান্স দলের মেরুদণ্ড। যেদিন পগবা ভালো খেলেন সেদিন ফ্রান্সকে থামানো দু:সাধ্য ব্যাপার। আক্রমণ, রক্ষণ দুই ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী পগবা একজন আদর্শ বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের উদাহরণ।

ফ্রান্স দলের ইঞ্জিন হলেন এনগোলো কান্তে। বলা হয়ে থাকে, পুরো দল মিলে ম্যাচে যত দূর দৌড়ায় এক কান্তেই তার সমান দৌড়ান। কথাটি বাহুল্য হলেও এটি কান্তের পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং সামর্থ্যেরই জানান দেয়। ডিফেন্সিভ এই মিডফিল্ডারের অন্তহীন কর্মক্ষমতা মাঝমাঠে ফ্রান্সের বড় শক্তি। পুরো দলের খেলাও এক সুতোয় বাঁধার কাজ করেন কান্তে। এই দুজনকে সহায়তা করতে থাকবেন ব্লেইস মাতুইদি। মাঠে তাঁকে চোখে পড়বে কমই। কিন্তু কাজের কাজ ঠিকই করেন মাতুইদি। তাঁর ডিফেন্সিভ ট্যাকল প্রায় নিখুঁত। যেটি ফ্রান্সের রক্ষণে চাপ কমাবে।

সাফল্যের জন্য ফ্রান্স তাকিয়ে এমবাপ্পে-ডেমবেলে জুটির দিকে। ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সের মেরুদণ্ড যদি হয় তাঁদের মাঝমাঠ তাহলে সেই মেরুদণ্ডের ওপর ভর দিয়ে দলকে পার করে নিতে রয়েছে তাঁদের আক্রমণভাগ। কিলিয়ান এমবাপ্পে যার মূল অস্ত্র, বয়স কেবল ১৯। মাত্র ২ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারেই বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন তাঁকে ফুটবলের ভবিষ্যৎ মহাতারকা বলা হয়। অবিশ্বাস্য গতি, বল নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, গোল করার সামর্থ্য, রক্ষণকে বোকা বানানো—সব সামর্থ্যই আছে এমবাপ্পের। বিশ্বকাপের তারকা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে ফ্রান্সের নাম্বার টেনের।

আরেক মারণাস্ত্র ২১ বছর বয়সী ওউসমানে ডেমবেলে। মৌসুমের শুরুতে প্রায় এক হাজার চার শ কোটি টাকা দিয়ে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে বার্সেলোনা। সেটি যে এমনি এমনি নয় মৌসুমজুড়েই চোটে ভুগলেও তার ঝলক দেখিয়েছেন ডেমবেলে। দিদিয়ের দেশম ডেমবেলেকেই সবচেয়ে বেশি সমাদর করেন। সহজাত ড্রিবলিং ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রিত গতি, ফিনিশিং মিলিয়ে ডেমবেলে ফ্রান্স দলের জন্য বড় রত্ন। দুই উইংয়ে এমবাপ্পে-ডেমবেলে কে অচল করার ওপর নির্ভর করছে ফ্রান্সকে থামানো।

এমবাপ্পে-ডেমবেলের বুনে দেওয়া বীজ থেকে ফসল ঘরে তুলতে পুরোপুরি প্রস্তুত আঁতোয়ান গ্রিজমান। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ভাবা হয়ে তাঁকে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে সেটির প্রমাণও দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়তই। একজন স্ট্রাইকারের যেসব দক্ষতা থাকা উচিত তার সবই রয়েছে গ্রিজমানের মধ্যে। ২০১৬ ইউরোর গোল্ডেন বুটজয়ী গ্রিজমানের বড় টুর্নামেন্টে গোল করার রাস্তাটাও ভালোই চেনা আছে।

রক্ষণে ফ্রান্স সম্ভবত বিশ্বকাপেরই সেরা। দুই সেন্টার ব্যাক রাফায়েল ভারান এবং স্যামুয়েল উমতিতি খেলেন বিশ্বের সেরা দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায়। দুজনের পাহাড়সম রক্ষণ বাধা প্রতিপক্ষ কীভাবে পেরোবে সেটি দেখার বিষয়। অনেক দিন পর ফুলব্যাক পজিশনে একসঙ্গে দুজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় পেয়েছে ফ্রান্স। জিব্রিল সিদিবে ও বেনজামিন মেন্ডির ফুলব্যাক জুটি আক্রমণ-রক্ষণে এনে দেবেন ভারসাম্য। গতিশীল দুই ফুলব্যাকই আক্রমণে ওস্তাদ, সময়মতো নিজেদের ফেলে আসা জায়গায় ফিরে আসতে পারার ক্ষমতাও রয়েছে তাঁদের। তাই এবারের ফরাসি রক্ষণই বিশ্বকাপের সেরা।

গোলে আছেন দীর্ঘদিনের সেনানী এবং দলনেতা হুগো লরিস। এই বিশ্বকাপেই দেশের হয়ে ১০০তম ম্যাচ খেলবেন লরিস। বিশ্বের সেরা গোলকিপারদের তালিকায় তাঁর নাম হয়তো অনেকের পরেই আসে, কিন্তু নিজের দলে লরিস অপরিহার্য।

এত প্রতিভার ভিড়ে ফ্রান্সের খুঁত কিংবা দুর্বলতা বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতোই কঠিন। কিন্তু বলতে হয় রক্ষণটা যেমন সেরা তেমনি বড় টুর্নামেন্ট খেলায় অনভিজ্ঞ। চার মূল ডিফেন্ডার একসঙ্গে কখনোই বড় কোনো প্রতিযোগিতায় খেলেননি। অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার লঁরা কসিয়েলনির অভাব ভোগাতে পারে ফ্রান্সকে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও এই দলটির জন্য সমস্যার কারণ। এ কারণেই তারা জিততে পারেনি ২০১৬ ইউরো। গত ছয় বছর ধরে দল সামলানোর পরও দিদিয়ের দেশমের ওপর অনেকেই বিরক্ত। দেশমের দর্শন এই দলের সঙ্গে যায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ফ্রান্সের সম্ভাব্য একাদশ।


এ রকম প্রতিভাসম্পন্ন দল ফ্রান্স অদূর ভবিষ্যতে আর কখনো পাবে কিনা সেটি সন্দেহের বিষয়। নিজেদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখাতে চাইলে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপই ফ্রান্সের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। দলটির সামর্থ্য রয়েছে বিশ্বজয় করার। এবার দেখার পালা, ফ্রান্সের তরুণ এই দলটি সামর্থ্য আর প্রত্যাশার মিশেল ঘটিয়ে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারে কিনা।