ব্রোনিৎসি নামে ঝিম ধরে থাকা যে শহরে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের বেস ক্যাম্প, সেটিতে ঢোকার মুখেই কাল একটা সাইনবোর্ড দেখা গেল। যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘জন্মদিনে লিওনেল মেসিকে ব্রোনিৎসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন’। সঙ্গে আজ মেসির ৩১তম জন্মদিন ঘিরে ব্রোনিৎসি শহরের পক্ষ থেকে যে আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ। বেস ক্যাম্পের পাশেই বেলস্কো লেকের পাড়ে দুপুর থেকে কনসার্ট, মাঝে সন্ধ্যায় কেক কাটার উৎসব-অনুষ্ঠানসূচির সবই বিস্তারিত দেওয়া আছে সেই সাইনবোর্ডে। আয়োজকদের একজন আর্জেন্টাইন দৈনিক ক্লারিনকে বলেছেন, কেক কাটতে মেসি নিজেই আসবেন বলে কথা দিয়েছেন।
আসলেই যাবেন? কথাটা হয়তো আগেই দিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু এখন কি সেই কথা রাখার মতো মানসিক অবস্থা আছে মেসির! এই ৩১ বছরে জন্মদিন আর কখনো এত বিষাদময় হয়ে এসেছে তাঁর জীবনে! একে তো ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হারের পর টালমাটাল আর্জেন্টাইন ফুটবল, সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত প্রশ্নবিদ্ধ পারফরম্যান্স। ওই ম্যাচের পর গত দুই দিনে তাঁকে দেখে কারও মনে হয়নি, জন্মদিন নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখানোর মতো অবস্থায় আছেন।
শুধু তো মেসি নন, পুরো আর্জেন্টিনা দলের অবস্থাই মাঝসমুদ্রে দিশেহারা জাহাজের যাত্রীদের মতো। তার মধ্যে আবার ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে আর্জেন্টিনা দলে কোচ সাম্পাওলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের খবর। আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য এটি উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছে, বিদ্রোহ-টিদ্রোহ কিছু হয়নি, সব মিথ্যা কথা। তবে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম এখনো দাবি করে যাচ্ছে, কোচের সঙ্গে গেম প্ল্যান নিয়ে একটা বড় দ্বন্দ্ব রয়েছে খেলোয়াড়দের।
সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, চারপাশ থেকে আসা বিষাক্ত সব সমালোচনার তির থেকে আপাতত রেহাই নেই আর্জেন্টিনা দলের। কারও কাঠগড়ায় কোচ হোর্হে সাম্পাওলি, কারোর বা মেসি, কারও চোখে পুরো দল। ম্যারাডোনা যেমন শুরু থেকেই সাম্পাওলিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। মেসিকে তিনি দায় দিতে রাজি নন, প্রথম আলোয় লেখা বিশেষ কলামেও সেটি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। কাল ভেনেজুয়েলাভিত্তিক তেলেসুর টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরও একবার ধুয়ে দিয়েছেন সাম্পাওলিকে, ‘সবাই ভেবেছিল সাম্পাওলি সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। একগাদা কম্পিউটার, ড্রোন, ১৪ জন সহকারী আর ২৫ জন কাজের লোক দিয়েই যদি সব সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে তো হতোই।’
তাহলে কী সমাধান? ম্যারাডোনার মতে, সাম্পাওলি খেলোয়াড়দের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না। সে জন্য আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ক্লদিও তাপিয়াকে অনুরোধ করেছেন তাঁকে একবার খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিতে। মেসিদের কী বলতে পারেন, তার একটা আভাসও পাওয়া গেল তাঁর কথা শুনে, ‘আমি যখন আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিতাম, জীবন দিয়ে খেলেছি। কী মনে হয় আপনাদের, বেলজিয়াম আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই গোলগুলো কি আমি এমনি এমনি করে ফেলেছি? যখন আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলতাম, মনে হতো, আমার বৃদ্ধা মা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের কোটি মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।’
ম্যারাডোনা দেখা করার সুযোগ পান কি না, সেটা জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে আপাতত আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমে সর্বশেষ যে খবর এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে, দলের গুমোট পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নাইজেরিয়া-আইসল্যান্ড ম্যাচে নাইজেরিয়া জেতায় নতুন করে আশা জাগে আর্জেন্টিনার শেষ ষোলোয় যাওয়ার। নতুন হিসাব অনুযায়ী ২৬ জুন শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়াকে বড় ব্যবধানে হারালেই অনেকটা নিশ্চিত পরের রাউন্ড। ম্যাচ শেষে তাপিয়া কোচ আর খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা বৈঠক করেন। সেখানেই নাকি সাম্পাওলি স্বীকার করেন, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গেম প্ল্যানে খেলোয়াড়দের কথা না শুনে তিনি ভুল করেছেন। অধিনায়ক মেসি আর সহ-অধিনায়ক হাভিয়ের মাচেরানোও খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে দ্বন্দ্ব ভুলে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে শেষ চেষ্টা করার প্রতিজ্ঞা করেন।
কাল থেকে আবার তাই নতুন উদ্যমে অনুশীলন শুরু করেছে আর্জেন্টিনা। খেলোয়াড়দের পরামর্শমতো দলে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনার কথাও নাকি ভাবছেন সাম্পাওলি। ক্লারিন-এর খবর, গোটা পাঁচেক পরিবর্তন দেখা যাবে পরের ম্যাচের আর্জেন্টিনা দলে। সবার কথা অবশ্য এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে একজন যে একাদশে থাকছেন না, সেটা প্রায় নিশ্চিত। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ওই হাস্যকর ভুল করা উইলি কাবায়েরোর বদলে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গোলবারের নিচে দাঁড়াতে পারেন রিভার প্লেটের ফ্রাঙ্কো আরমানি।
সব মিলিয়ে ৩১তম জন্মদিনটা তাহলে বিষাদ ভুলে মেসির নতুন করে শুরু করার দিনও। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেই হারের পর থেকেই নাকি নিজের চেহারায় একটা অদৃশ্য ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ সাইন ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। নাইজেরিয়ার জয়ের পর আর্জেন্টিনার বৈঠকে সেই সাইনটা সরেছে। কে জানে, আজ হয়তো বেলস্কো লেকের পাড়ে কেক কাটতে যেতেও পারেন!