একটা গোল জীবন তছনছ করে গড়ে যেভাবে

২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালের গোলদাতা ইনিয়েস্তার ছবি হাতে লুইস মারিয়া। ছবি: মার্কা
২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালের গোলদাতা ইনিয়েস্তার ছবি হাতে লুইস মারিয়া। ছবি: মার্কা

দশ বছর আগে এই দিনে লুইস মারিয়া দিয়েজ পিকাজো ছিলেন রাস্তায়। শত শত স্প্যানিয়ার্ডের মতো তিনিও ভেসে গিয়েছিলেন আনন্দে। দেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন বলে কথা! সেদিন রাতের কথা মারিয়া জীবনে কখনো ভুলতে পারবেন না। জীবন পাল্টে দেওয়া রাত।

এলাকায় মারিয়াকে সবাই ডাকে 'এল পিকা' নামে। সেদিন লোগ্রোনোর পাশে এক উৎসবমুখর জায়গায় বন্ধুদের সঙ্গে ছিলেন মারিয়া। বিয়ার, হই-হুল্লোড়, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোল, এসব নিয়ে মেতে ছিল সবাই। এটুকু পড়ে মনে হতেই পারে, এ তো আর দশজন স্পেনভক্তের গল্প, এমন আলাদা কি?

লোগ্রোনোতেই অবস্থিত মুরিয়েতা ঝর্ণায় বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন মারিয়া। আনন্দের আতিশায্যে সেখানে পা পিছলে পড়ে ঘাড় ভেঙে নেন তিনি। বন্ধুরা না থাকলে হয়তো সলিল সমাধিও হয়ে যেত। পানি ঢুকেছিল ফুসফুসে। কিছুক্ষণ পর অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চার পাশে কী ঘটছে সব টের পাচ্ছিলেন মারিয়া। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা ও শরীর নড়াতে পারছিলেন না। লোগ্রোনোর জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে নেওয়া হয় বার্গোস হাসপাতালে। অস্ত্রোপচার করাতে হয় শরীরে। তখন বোনের কাছে প্রথম জানতে পারেন মারিয়া, তাঁকে নিয়ে টানাটানি চলছে যমে-মানুষে।

মেরুদন্ডে বড় চোট পেয়েছিলেন মারিয়া। কোমায় ছিলেন পাঁচ দিন। কোমা থেকে ওঠার পর তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না, জীবনে আর কখনো হাঁটতে পারবেন না!

সেই মারিয়া এখন ভ্যালেন্সিয়ায় থাকেন। ওই দূর্ঘটনা তাঁর জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেওয়ার চেয়ে দিয়েছে বেশি বলেই মনে করেন তিনি। আশ্চর্য লাগাই স্বাভাবিক। পঙ্গুত্ব বরণ করার বিনিময়ে মারিয়া এমন কী পেয়েছেন? শুনুন তাহলে, সেদিন রাতে যাঁর গোলের আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে মারিয়ার এই পরিণাম, সেই ইনিয়েস্তা তাঁর খোঁজ নিয়েছিলেন। হাসপাতালে থাকতে নানা প্রেরণাসূচক বার্তা মারিয়াকে পাঠাতেন স্প্যানিশ কিংবদন্তি।

মারিয়ার তাই মনে হয়, 'ওই দূর্ঘটনা আমার জীবন থেকে যা কিছু কেড়েছে তার চেয়ে দিয়েছে বেশি। ইনিয়েস্তার গোলটাই আমাকে জীবন দিয়েছে।' হাসপাতালে দীর্ঘ ছয় মাসের জীবন নিয়ে মারিয়া স্মৃতিচারণ করেন, 'ওই ঘটনার পর সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়। যা করার করে নাও। এতে নতুন জীবন পাই। মনে আছে, কোমা থেকে ওঠার পর সেবিকাকে টিভি এনে দিতে বলেছিলাম। উদযাপন দেখব। সে (সেবিকা) আমাকে মাদ্রিদে উৎসব, ক্যাসিয়াস-সারার চুমুর কথা বলে...এসব তো আর দেখা হয়নি।'

স্পেনের পতাকা নিয়ে হুইল চেয়ারে মারিয়া। ছবি: মার্কা

হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পর জীবনটা আরও বড় ও খোলতাই মনে হয়েছিল মারিয়ার কাছে। সেই জয়ের প্রেরণা তাঁর মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে পঙ্গুত্ব নিয়ে হতাশ না হয়ে খেলাধুলায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন মারিয়া। যে জলে একদিন ডুবে মরতে বসেছিলেন সেই জলে ঝাঁপ দেওয়ার মধ্যেই জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পান তিনি। বেছে নেন ডাইভিং।

ভ্যালেন্সিয়ায় ভূ-মধ্যসাগর তীরবর্তি একটি জায়গায় তিন বছর ধরে বসবাস করেন মারিয়া। তাঁর মতে, 'মাথার ভেতর থেকে হুইল চেয়ারটা সরাতে পারলে জীবনে কিছু মেলে। হ্যাঁ, এটা আমার জীবন নষ্ট করেছে। কিন্তু কোনো কিছু চাইলে জীবন আপনাকে দেবে যদি তার পেছনে ছোটেন।'

মারিয়া তাই ডাইভিংয়ের পাশাপাশি টেনিস, সাইক্লিং এমনকি নৌকা চালনাতেও দক্ষ। এর পাশাপাশি একটি রাগবি দলের অগ্রদূতও তিনি। সমস্যা একটাই, এসব করতে কোমরের নিচে একটি ভালো হুইল চেয়ার লাগে। তা কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই মারিয়ার। তবু লড়াই থামেনি, চলছে, 'দুই বছর খেলাধুলার বাইরে ছিলাম। মোটা হয়ে গেলেও পরিস্থিতি পাল্টে ফেলি। টেনিস ও সাইক্লিংয়ের চেয়ার বেচে দেই। এখন যেটা আছে সেটা মোটেও ভালো না কিন্তু আছে তো! খেলাধুলা আমার প্রেরণা। কোনো অভিযোগ নেই। নিয়মিত জিমে যাই। কিছু না কিছু করছি। জীবন মানেই অপার সম্ভাবনা, অসীম সুন্দর। আমি কি বসে আছি? দাঁড়ানো অবস্থায় কিন্তু অনেক কিছু করার ছিল।'

মারিয়ার সর্বশেষ হাঁটুতে ভর করে দাঁড়ানোর দিনটিতে বিশ্বকাপ জিতেছিল স্পেন। এক দশক আগে আজকের এই দিনে।'মার্কা'র সঙ্গে স্মৃতিচারণ শেষে মারিয়া গাড়িতে ওঠার সময়ও বিড়বিড় করে বলছিলেন, 'ইনিয়েস্তার গোল আমার জীবন বাঁচিয়েছে।'