নতুন মৌসুমে বিদেশি ফুটবলারদের জোয়ার বাংলাদেশের ফুটবলে। কয়েক মৌসুম ধরে যে ক্লাবগুলোর ভালো মানের বিদেশি আনার প্রবণতা দেখা গেছে, সেটির ধারাবাহিকতায় এবারও আবাহনী, বসুন্ধরা কিংস, পুলিশ, সাইফ স্পোর্টিং, মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলো উঁচু মানের বিদেশি দলে টেনেছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আছেন, যাঁরা দর্শকদের মাঠে টেনে নিয়ে আসতে পারেন নিজেদের শক্তিশালী অতীতের জোরেই। তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানলে মাঠে আসার ইচ্ছাটা জাগতে বাধ্য।
স্তোয়ান ভ্রানিয়েস (বসুন্ধরা কিংস)
এবারের মৌসুমে বসনিয়া জাতীয় দলে খেলা আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার স্তোয়ান ভ্রানিয়েসকে নিয়ে চমক দেখিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। মঙ্গলবার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিপক্ষে ৬-০ গোলের জয়ে জোড়া গোলে কিংসের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে তাঁর। প্রথম ম্যাচেই ভ্রানিয়েস বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কত উঁচু মানের খেলোয়াড়। প্রথাগত মিডফিল্ডার হলেও তাঁকে মূলত আর্জেন্টাইন রাউল বেসেরার জায়গায় স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানোর চিন্তা নিয়েই দলে নেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর ৩টি ম্যাচ খেলেছেন ভ্রানিয়েস। আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে খেলেছেন উজবেকিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও মেক্সিকোর বিপক্ষে। সর্বশেষ মৌসুমে বসনিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব বোরাক বানজা লোকার হয়ে খেলে ১৫ ম্যাচ ভ্রানিয়েস করেছেন ১০ গোল। দলটির অধিনায়কও ছিলেন এই মিডফিল্ডার। ইউরোপা ও চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইপর্বের দুটি ম্যাচ খেলেছেন। এই তো গত জুলাইয়ে রোমানিয়ার ক্লাব সিএফআর ক্লুজের বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে করেছিলেন প্রথম গোলটি।
ডরিয়েলটন গোমেজ (আবাহনী লিমিটেড)
ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব ফ্লুমিনেসের যুব দলে বেড়ে ওঠা ফরোয়ার্ড ডরিয়েলটন গোমেজ। প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে খেলেছেন ফ্লুমিনেসের সিনিয়র দলেও। তবে এক ম্যাচের বেশি খেলা হয়নি তাঁর। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে এশিয়ায়। নির্দিষ্ট করে বললে চীনে। ২০১১ সালে চীনের ক্লাব ফুটবলে নাম লিখিয়েছিলেন। মাঝে এক বছর বাদ দিলে আবাহনীতে নাম লেখানোর আগপর্যন্ত চীনই ছিল তাঁর ঠিকানা। দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ের লিগে সাতটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি। সর্বশেষ চায়না লিগ ওয়ানে ৫ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ২টি। এর আগে চাইনিজ সুপার লিগের ক্লাব চাংচুং ইয়াতাই ও শাওজিং ইউএজিয়ার হয়ে ৫৪ ম্যাচ খেলে ১৬টি গোল আছে তাঁর। দুর্দান্ত গতির সঙ্গে বল নিয়ন্ত্রণে তিনি দুর্দান্ত। আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র না আসায় আবাহনীর প্রথম ম্যাচটি খেলা হয়নি তাঁর। তবে ছাড়পত্র আসায় ৭ ডিসেম্বর রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির বিপক্ষে আবাহনীর জার্সিতে অভিষেক হতে যাচ্ছে এই ব্রাজিলীয় ফুটবলারের।
এমফোন ও এমেকা (সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব)
বাংলাদেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপটে নাইজেরিয়ার এমফোন সানডে উদোহ ও এমেকা ওগবাগ—নাম দুটি বেশ বড়ই। নাইজেরিয়া জাতীয় দলে খেলা দুই ফরোয়ার্ড সাইফ স্পোর্টিংয়ের আক্রমণভাগের মূল দায়িত্বে। ২৯ বছর বয়সী এমফোন নাইজেরিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৩টি ম্যাচ। ২০১৪ সালে নাইজেরিয়া প্রিমিয়ার লিগে ২৩ গোল করে এক লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি তাঁর দখলে। সাইফে যোগ দেওয়ার আগে নাইজেরিয়া প্রিমিয়ার লিগে আকওয়া ইউনাইটেডের হয়ে ৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন একটি।
তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দেওয়ার জন্য আছেন স্বদেশি এমেকা ওগবাগ। ২০১৮ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর খেলেছেন পাঁচটি ম্যাচ। সর্বশেষ বাহরাইন প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব মালকিয়াতে খেলেছেন ৩১ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। এ ছাড়া মরক্কোর ক্লাব মৌলোদিয়া, নাইজেরিয়ার ক্লাব রিভার্স ইউনাইটেডে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। স্বাধীনতা কাপের প্রথম ম্যাচে নামের প্রতি পুরোপুরি সুবিচার না করতে পারলেও সামর্থ্যের ইঙ্গিত ঠিকই দিয়েছেন তাঁরা।
নেডো ও রাফাল (স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘ)
দেশের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে নাম লিখিয়েছে স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘ। আবির্ভাবেই আক্রমণভাগ সাজিয়েছে ইউরোপের দেশ বসনিয়ার নেডো তারকোভিচ ও পোল্যান্ডের রাফাল জাভোরোস্তিকে দিয়ে। স্বাধীনতা কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন তাঁরা। ‘নাম্বার নাইন’ হিসেবে খেলছেন নেডো আর আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে পেছনে থেকে বলের জোগান দিয়েছেন রাফাল।
নেডো বসনিয়া, কাজাখস্তান, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো, আজারবাইজান, পোল্যান্ড আর রোমানিয়ার ক্লাব ঘুরে সর্বশেষ খেলেছেন ইরাকের ক্লাব আল দিওয়ানিয়ায়। ইউরোপা লিগের বাছাইপর্বও খেলার অভিজ্ঞতা আছে। এ অঞ্চলের সঙ্গেও পরিচিত। ২০১৭ সালে ভারতের আই লিগের ক্লাব নেরোকা এফসির হয়ে খেলেছিলেন।
২৭ বছর বয়সী রাফাল তো পোল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলেছেন। নিজ দেশ ছাড়াও খেলেছেন নরওয়ে, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো, গ্রিস ও রোমানিয়ার শীর্ষ লিগের ক্লাবে। সর্বশেষ খেলেছেন রোমানিয়ান তৃতীয় স্তরের ক্লাব পান্ডুরিতে। তাঁরা যে ছোট দলের বড় তারকা হতে যাচ্ছেন, এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
জাসমিন ও জন (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব)
ক্লাবগুলোতে একজন বিদেশি সেন্টারব্যাক দেখা অতিপরিচিত দৃশ্য। তবে এবার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে দেখা যাবে বিদেশি সেন্টারব্যাক জুটি। উত্তর মেসিডোনিয়ার মেসিনোভিক জাসমিন ও অস্ট্রেলিয়ার রিয়ান ডন অ্যারন জনকে নিয়েছে সাদাকালোরা। উত্তর মেসিডোনিয়ার অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলের হয়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন জাসমিন। মোহামেডানে নাম লেখানোর আগে নিজ দেশের প্রথম সারির দল এফসি স্ট্রুগায় সর্বশেষ খেলেছেন। এর আগে হাঙ্গেরি, মালদোবা, কসোভো, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার লিগের বিভিন্ন পর্যায়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।
অ্যারন জনও অস্ট্রেলিয়া বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। ২২ বছর বয়সী এই সেন্টারব্যাক সর্বশেষ খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সার্কাসের হয়ে। নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলে দীর্ঘদেহী এই ডিফেন্ডার জুটি যে যেকোনো ক্লাবের আক্রমণভাগের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজই ঢাকা এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে জাসমিনের, আর ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আসবেন অ্যারন জন।
আমিরুদ্দিন, কুসকুস ও ডেনিলসন (বাংলাদেশ পুলিশ স্পোর্টিং ক্লাব)
এবার শোনা যাক আক্রমণভাগের সম্ভাবনাময় এক ত্রয়ীর কথা। ‘নাম্বার নাইন’ আফগানিস্তান জাতীয় দলের স্ট্রাইকার আমিরুদ্দিন শরিফি। তাঁর পেছনে আক্রমণাত্মক দুই মিডফিল্ডার মরক্কোর বংশোদ্ভূত জার্মানির আদিল কুসকুস ও ব্রাজিলের ডেনিলসন রোলদাও। ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলেছেন ডেনিলসন। কুসকুস খেলেছেন মরক্কোর অনূর্ধ্ব-২০ দলে। তাঁদের বলের স্পর্শ ও মুভেই পাওয়া গিয়েছে অভিজাত ফুটবলের ছাপ। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই এই তিন বিদেশির ত্রিভুজ আক্রমণ জমে উঠেছিল বেশ।
আমিরুদ্দিন, ডেনিলসনরা জায়গা বদল করে খেলেছেন বারবার। অফসাইড ফাঁদ ভাঙতেও জুড়ি নেই এ বছরের জুনে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে গোল করা আমিরুদ্দিনের। তাঁদের রক্ষণচেরা থ্রু দিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিতে জুড়ি নেই কুসকুসের।