ভুটানে বাংলাদেশের চার নারী ফুটবলার সাবিনা খাতুন, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা ও ঋতুপর্ণা চাকমা
ভুটানে বাংলাদেশের চার নারী ফুটবলার সাবিনা খাতুন, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা ও ঋতুপর্ণা চাকমা

ঋতুপর্ণার নাম যখন ‘ম্যাথো’, মনিকার ‘ইয়াঙ্কি’, মারিয়ার ‘দিচেন’

ঋতুপর্ণা চাকমা নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করার চেষ্টা করেছিলেন রয়্যাল থিম্পু কলেজ নারী ফুটবল ক্লাবের কোচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভুটানের সেই কোচের নামও অবশ্য ঋতুপর্ণাও পুরোপুরি মনে করতে পারলেন না, শুধু তাঁর নামের প্রথম অংশটাই মনে করতে পারলেন—জিগমে। নামটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত ভুটানের রাজপরিবারের কারণেই। জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক—ভুটানের বর্তমান রাজা জিগমে খেসার ওয়াংচুকের বাবা। তিনি একসময় সার্ক সম্মেলন বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সফরে অনেকবারই এসেছেন বাংলাদেশে।

যা–ই হোক, থিম্পু কলেজ নারী দলের কোচ বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশি ফুটবলারদের নামগুলো তাঁর পক্ষে উচ্চারণ করা অত সহজ নয়। তাই তাদের নতুন নামকরণই শ্রেয়। ভুটানে পরিচয়পর্বেই ঋতুপর্ণার নাম হয়ে গেল ‘ম্যাথো’, মনিকা চাকমার ‘ইয়াঙ্কি’ আর মারিয়া মান্দার ‘দিচেন’। বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুনকেও একটা বিশেষ ভুটানি নামে ডাকা হতো, সেটি অবশ্য ঋতুপর্ণা কিছুতেই মনে করতে পারছেন না।

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ভুটানে তাঁকে যে ‘ম্যাথো’ নামে ডাকা হয়েছে, এটা মনে হলেই হাসি পায় ঋতুর। প্রথম প্রথম ম্যাথো নামে ডাকলে বুঝতে পারতেন না। পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। ভুটানি ক্লাব রয়্যাল থিম্পু কলেজ নারী দলের হয়ে এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের চার নারী ফুটবলার—ঋতুপর্ণা, মনিকা, মারিয়া আর সাবিনা। তবে নিবন্ধনে দেরি করে ফেলায় সাবিনার দুর্ভাগ্য, চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা হয়নি তাঁর। ঋতু, মারিয়া আর মনিকা খেলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে থিম্পুর দুই গ্রুপ ম্যাচই। ইরানের বাম খাতুন এফসি আর হংকংয়ের কিচি এফসির বিপক্ষে দুটি ম্যাচের পাশাপাশি তাঁরা ভুটান নারী ফুটবল লিগের একটি ম্যাচেও মাঠে নেমেছিলেন। ইরানের বাম খাতুন এফসির বিপক্ষে ম্যাচটি থিম্পু কলেজ হেরেছে ২-১ গোলে। সে ম্যাচে ঋতুপর্ণার গোলেই এগিয়ে গিয়েছিল থিম্পু। কিন্তু সেটি ধরে রাখা যায়নি। বাংলাদেশের কোনো ক্লাব না খেললেও এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগে ভুটানি ক্লাবের হয়ে খেলাটা বাংলাদেশের তিন নারী ফুটবলারের জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। তবে তিনজনেরই মত, ভুটানি ক্লাবের হয়ে খেলার কারণেই হয়তো তাঁদের অভিজ্ঞতা স্মরণীয়।

ভুটানে কোচদের সঙ্গে বাংলাদেশের চার ফুটবলার

কারণটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ঋতু, ‘এর আগে জাতীয় দলের হয়ে ভুটানে গিয়েছি। এই তো জুলাই মাসে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এবার খেলেছি ভুটানি দলের হয়ে। সে কারণেই বোধ হয় বাড়তি আদরযত্ন পেয়েছি। ভুটানিরা যদি আপনাকে নিজেদের মানুষ মনে করে, তাহলে উজাড় করে ভালোবাসে।’

সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশই ‘ম্যাথো’, ‘ইয়াঙ্কি’ আর ‘দিচেন’ নাম তিনটি। ঋতুর কথা, ‘আমাদের তিনজনকে যে তিনটি নাম দেওয়া হয়েছিল, তিনটি নামেরই আলাদা অর্থ আছে। আমার “ম্যাথো” নামের অর্থ যেমন ফুল, মারিয়ার “দিচেন” নামের অর্থ শান্তি আর মনিকার “ইয়াঙ্কি” মানে সুখ।’

চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজের গোলে খুব খুশি ঋতু, ‘আমার একটা অভ্যাস আছে ডি–বক্সের আশপাশে বল পেলে পোস্টে শট নেওয়ার চেষ্টা করা। সেদিন সেটিই করেছি ইরানি ক্লাবটির বিপক্ষে। এর বেশি কিছু না। তবে গোলটি বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের হয়ে করতে পারলে বেশি ভালো লাগত।’

ভুটানে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে বাংলাদেশের চার নারী ফুটবলার

মারিয়া মান্দা আর মনিকা চাকমার ভুটান-অভিজ্ঞতাও ঋতুপর্ণার মতোই চমৎকার। মনিকা যেমন বললেন, ‘ভুটানের মানুষ ভুটান দেশটির মতোই সুন্দর। সবাই এত আপন করে নিতে পারে! থিম্পু কলেজ টিমের প্রতিটি খেলোয়াড় আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। বাকি খেলোয়াড়েরা কলেজ হোস্টেলে থাকলেও আমরা থাকতাম থিম্পুর একটি হোটেলে। এটা করা হয়েছিল যেন আমাদের খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা না হয়, সে জন্য। ভুটানি খাবার খুব ঝাল। আমরা কেউই খেতে পারতাম না। হোটেলে আমাদের পছন্দমতো খাবার রান্না করে দিত।’

বাংলাদেশেও যে পাহাড়ি, আদিবাসীরা আছে, সেটা তারা জানত না। ভুটানে দোকানপাটে গেলে দোকানিরা ওদের ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলত। যখন শুনত আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, অবাক হতো।
মনিকা চাকমা, বাংলাদেশের নারী ফুটবলার

ঋতু, মনিকা, মারিয়া—তিনজনই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর খেলোয়াড়। বাঙালি চেহারা না হওয়ার কারণেও মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের। মনিকা জানালেন সেটি, ‘আমাদের তিনজনের চেহারার সঙ্গেই ভুটানিদের চেহারার মিল আছে। সে কারণে প্রথম প্রথম ওরা খুব অবাক হয়েছিল। ওদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে সবার চেহারাই বাঙালি। বাংলাদেশেও যে পাহাড়ি, আদিবাসীরা আছে, সেটা তারা জানত না। ভুটানে দোকানপাটে গেলে দোকানিরা ওদের ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলত। যখন শুনত আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, অবাক হতো।’

এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে ভুটানি ক্লাব রয়্যাল থিম্পু কলেজ নারী দলের হয়ে খেলেছেন বাংলাদেশের তিন ফুটবলার

থিম্পুর সাড়ে ৮ হাজার ফুট উচ্চতায় খেলাটা কষ্টকর, সেই অভিজ্ঞতা সদ্য ছেলেদের জাতীয় ফুটবল দলের হয়েছে। যদিও মেয়েরা জুলাই মাসে ভুটানের বিপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেই জিতেছে হেসেখেলে। ভুটানের উচ্চতা নিয়ে ঋতুর কথা, ‘অভ্যাস না থাকলে ভুটানে খেলা বেশ কষ্টকর। জুলাই মাসে ভুটানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে আমাদের কষ্ট হয়েছিল। তবে ওখানে কিছুদিন থাকলে উচ্চতাটা গা–সওয়া হয়ে যায়। জুলাইয়ে খেলে এসে এবার যেমন থিম্পু কলেজের হয়ে আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি খেলতে।’