নাহ, এই ছেলেকে দিয়ে হবে না...
শেষবারের মতো নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তটা সম্পর্কে আরেকবার ভেবে নিলেন সেজার লুইস মেনোত্তি। আসলেই কাজটা ঠিক হচ্ছে তো? এমনিতে মিডিয়ার কোলাহল, সমর্থকদের দাবিদাওয়া বিশেষ একটা পাত্তাটাত্তা দেন না এই কোচ। চলেন নিজের হিসেবে। নিজে যেটা ভালো বোঝেন, দলের জন্য সেটাই করেন। সবার কথা ধরে ধরে শুনতে গেলে হবে নাকি? মানুষের চাপে পড়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পরে হিতে বিপরীত হলে কোপ তো সেই তাঁর ঘাড়েই পড়বে, তা–ই না? যারা মাতামাতি করে, তাঁদের এই মাতামাতি করা পর্যন্তই দৌড়। পরে সেই সিদ্ধান্তের দায়টা তো তাঁকেই নিতে হবে, নাকি? নাহ, সমর্থকদের চাপে পড়ে নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলানো যাবে না। দলটা তাঁর, খেলোয়াড় নির্বাচন করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাই তিনি রাখেন।
এসব ভাবতে ভাবতে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের হেডকোয়ার্টারের ভেতরে নিজের কক্ষে পায়চারি করছিলেন মেনোত্তি। ঠোঁটে সিগারেট। আজ এই নিয়ে আঠারো নম্বর চলছে। সাধারণত দল ঘোষণার আগে এত চিন্তা হয় না তাঁর। কিন্তু এবার কেন জানি হচ্ছে। একের পর এক সিগারেট তাই ঠোঁট স্পর্শ করছে। ওই যে, ওই সিদ্ধান্তটার জন্য! একটু পর বাইরের সভাকক্ষে হাজারো উৎসুক সংবাদকর্মীর সামনে দল ঘোষণা করতে হবে মেনোত্তিকে। যেনতেন দল না, বিশ্বকাপের দল। আর এবার তো ঘরের মাটিতেই বিশ্বকাপ হচ্ছে। অন্য যেকোনোবারের চেয়ে এবার তাই বিশ্বকাপ জেতার চাপটা বেশি। হাজারো উৎসুক সংবাদকর্মী মূলত যে নামটার জন্য অপেক্ষা করছেন, সে নামটাই আজ উচ্চারণ করবেন না মেনোত্তি। কারণ তাঁকে দলে নেওয়াই হয়নি।
ঘরের মাটিতে তাঁকে বিশ্বকাপ খেলতে দেবেন না মেনোত্তি। সংবাদকর্মীরা তাঁর নাম না শুনতে পেলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান, কী কী প্রশ্নবাণে মেনোত্তিকে জর্জরিত করতে পারেন, সেগুলোর সম্ভাব্য জবাব মনের মধ্যে ভেবে নিয়ে খেলোয়াড়দের তালিকাটা হাতে নিয়ে সভাকক্ষের দিকে এগোলেন এই আর্জেন্টাইন কোচ।
ওদিকে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে নিয়মিত অনুশীলন শেষ করে মাত্র বাসায় ফিরেছেন ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। আজ অনুশীলনে তেমন মন দিতে পারেননি।
পারবেনই বা কেন? জাতীয় দলের কোচ যে আজ দল ঘোষণা করবেন বিশ্বকাপের! আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে গত দুবছর ধরে যা খেলা দেখাচ্ছেন, তাতে এই কিশোরের দলে না থাকাটাই বরং আশ্চর্যের হবে। ঘরের মাঠে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আর বেশি দূরে নেই, ভাবতে ভাবতে রেডিওটা অন করল সেই কিশোর। পাশে পুরো পরিবার। পরিবারের সবার উত্তেজনাই যেন স্পর্শ করছে তাঁকে।
'আমি জানি আপনারা আমার সিদ্ধান্তে খুবই হতাশ। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতার জন্য এটাই সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। ম্যারাডোনা মাত্র খেলা শুরু করেছে। ও আরেকটু বড় হোক, অভিজ্ঞ হোক, চাপ সামলাতে শিখুক, ওর জন্য তো পুরো ভবিষ্যৎটাই পড়ে আছে...'
কোচের কথাগুলো যেন শেল হয়ে বিঁধছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের সেই কিশোরের বুকে। সেজার লুইস মেনোত্তি বুঝলেন না, কয়েক কিলোমিটার দূরে কানে রেডিও ধরে বসে থাকা ছেলেটা ততক্ষণে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, আগামী বিশ্বকাপে যে করেই হোক, সুযোগ পেতে হবেই!
ম্যারাডোনা এমনই ছিলেন। একবার কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেটা করেই ছাড়তেন। ব্যস, শুরু হলো বিরাশির বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করে নিজেকে গড়ে তোলার কাজ। আটাত্তরের বিশ্বকাপে সুযোগ পাননি, তো কী হয়েছে? পরের বছর অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে মেনোত্তির চোখের সামনেই দেখালেন তিনি পা দিয়ে কী কী জাদু দেখাতে পারেন। সেবার যুবদলের দায়িত্বেও ছিলেন মেনোত্তি। ম্যারাডোনা জাদুতে মুগ্ধ মেনোত্তি সেবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, নাহ, আটাত্তরে ছেলেটাকে নেওয়া হয়নি ঠিক আছে, কিন্তু বিরাশিতে নিতে হবে অবশ্যই।
তত দিনে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ছেড়ে বোকা জুনিয়র্স হয়ে বিশ্ব রেকর্ড ট্রান্সফার ফি তে বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে ম্যারাডোনা। সতেরো বছরের সেই কিশোর তত দিনে আরও পরিণত। ফুটবলার হিসেবে তো বটেই, আর্জেন্টিনার নাগরিক হিসেবে আরও বেশি। দেশের জার্সি গায়ে কিছু করে দেখানোর ইচ্ছাটা যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি তীব্র। বোকা থেকে বার্সায় যাচ্ছেন, এমন খবর জেনেই স্পেনের উদ্দেশে উড়াল দিলেন ম্যারাডোনা। না, বার্সার হয়ে খেলতে নয়। সেবার বিশ্বকাপটা স্পেনেই হয়েছিল। তবে যেটা জানতেন না, সেটা হলো ফকল্যান্ডের যুদ্ধে আর্জেন্টাইনদের করুণ পরিণতির কথা। আর্জেন্টিনার মিডিয়া নিজেদের পরাজয়ের খবরটা সেভাবে ফলাও করে প্রচার করেনি, ফলে ম্যারাডোনারাও জানতেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা জেতাই হয়ে গেছে। ইউরোপে নেমে জানলেন পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্যস, বাড়তি আরেকটা চাপ এসে জুটল ভালো খেলার জন্য।
দলের নতুন তারকা আদতে কেমন খেলেন, সেটা দেখার সুযোগ আগেভাগেই পেয়ে গেলেন বার্সা সমর্থকেরা। সেবার আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচটাই হয়েছিল ক্যাম্প ন্যু তে, বেলজিয়ামের বিপক্ষে। এর আগে কখনো প্রথম রাউন্ড পেরোতে না পারা বেলজিয়ানদের ওদিক কী হয়েছিল কে জানে, প্রথম থেকেই জানপ্রাণ দিয়ে লড়া শুরু করল সে সময়কার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। আর লড়তে লড়তে একটা জিনিস দেখিয়ে দিল সবাইকে, 'ম্যারাডোনাকে আটকাও, আটকে যাবে আর্জেন্টিনা।' দেশের হয়ে কিছু করে দেখানোর আকাঙ্ক্ষা, সঙ্গে নতুন ক্লাবের ঘরের মাঠে প্রথমবার ভালো খেলার তাড়না, সবকিছু মিলিয়ে ম্যারাডোনাও যেন সবকিছু নিংড়ে খেলা শুরু করলেন।
লাভ হলো না। গোটা ম্যাচে ম্যারাডোনাকে একের পর এক ফাউল করে গেল বেলজিয়ান তারকারা। আর্জেন্টিনাও হেরে বসল ১-০ গোলে। ম্যারাডোনা এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে বেলজিয়ান অধিনায়ক এরিক গেরেৎসের সঙ্গে ম্যাচ শেষে জার্সি বদলও করেননি।
ব্যস, একে ফকল্যান্ডের যুদ্ধে পরাজয়, তার ওপর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই পরাজয়। আটলান্টিকের ওপারে আর্জেন্টাইনরা হতাশ হয়ে পড়ল। অনেকেই বলা শুরু করল, ম্যারাডোনা অতিমূল্যায়িত খেলোয়াড়। তাঁকে দিয়ে আর যা–ই হোক, শিরোপা জেতা যাবে না। ওদিকে সুযোগ পেয়ে পেলেও এক হাত নিলেন ম্যারাডোনাকে। কয়েক বছর ধরেই ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর তুলনা হচ্ছে, ব্যাপারটা মনে হয় ব্রাজিল কিংবদন্তির কাছে ভালো ঠেকছিল না। ব্যস, বলে দিলেন, 'ও টাকার জন্য খেলে। আসলেই গ্রেট হওয়ার ক্ষমতা ওর আছে কি না, আমার সন্দেহ আছে।' ম্যারাডোনাও কম কিসে? পাল্টা জবাব দিলেন, 'ওনার জাদুঘরে থাকার বয়স হয়েছে।'
কিন্তু শুধু মুখ চালালেই তো হয় না, মাঠে খেলাও দেখাতে হয়। সেটা দেখাতে আর বেশি সময় নিলেন না ম্যারাডোনা। দ্বিতীয় ম্যাচেই পুসকাসের উত্তরসূরিদের বিপক্ষে দুই গোল করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করলেন। হাঙ্গেরির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা জিতল ৪-১ গোলে। তৃতীয় ম্যাচের প্রতিপক্ষ এল সালভাদর আবার বেলজিয়ামের পথই ধরল। গোটা ম্যাচ ম্যারাডোনাকে বাক্সবন্দী রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেল। লাভ হয়নি। ম্যাচ জিতেই দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে আর্জেন্টিনা।
ব্রাজিল, ইতালির গ্রুপে দ্বিতীয় রাউন্ডে পড়ল আর্জেন্টিনা। ফুটবলীয় স্টাইলের দিক দিয়ে যারা একদমই বিপরীতমুখী। সক্রেটিস, জিকোদের ব্রাজিল যেখানে সুন্দর ফুটবলের পসরা সাজিয়েছে, ইতালি সেখানে 'কাতেনাচ্চিও'কে অবলম্বন মেনে গোল না খাওয়ার দিকে মন দিয়েছে। ইতালির বিপক্ষে মাঠে নেমে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ম্যারাডোনা। ইতালির কোচ এনজো বিয়ারজোত জুভেন্টাসের সেন্টারব্যাক ক্লদিও জেন্টাইলকে দায়িত্ব দিলেন ম্যারাডোনাকে আটকে রাখার। লিবিয়ান বংশোদ্ভূত এই ইতালিয়ান সব সময়েই গা-জোয়ারি খেলতে পছন্দ করতেন। গোটা ম্যাচে ম্যারাডোনার পায়ে সেভাবে বলই এল না। আর এলেও জেন্টাইল একের পর এক ফাউল করে কেড়ে নিতে থাকলেন। রেফারিও নীরব। যেন ম্যারাডোনার মতো শৈল্পিক তারকাদের বাঁচানোর কোনো ইচ্ছেই নেই তাঁদের!
ইতালির বিপক্ষে ২-১ গোলে হারা আর্জেন্টিনার সামনে তখন পাহাড়সম বাধা। পরের রাউন্ডে উঠতে গেলে হারাতেই হবে ব্রাজিলকে। ম্যারাডোনা নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেলেন, তবে সতীর্থদের কাছ থেকে তেমন সহায়তা পেলেন না। শেষ হাসি হাসলেন জিকোরাই। শেষমেশ রেগেমেগে জোয়াও বাতিস্তাকে লাথি মেরে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন ম্যারাডোনা। জানলেন, অনেকে তাঁকে ঈশ্বর মানলেন, দিন শেষে তিনিও একজন মানুষই। যার রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, আছে হতাশা।
কজনই বা জানত তখন? লাল কার্ড দেখে নতমুখে মাঠ ছাড়া সে তারকাই চার বছর পর করবেন বিশ্বজয়?