করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ইতালি। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে এই ভাইরাসের সংক্রমণে। ২০০৬ সালে ইতালিকে বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক ফাবিও ক্যানাভারো তাঁর দেশের মানুষকে উদ্দেশ করে একটা খোলা চিঠি লিখেছেন। তিনি মনে করেন এ যুদ্ধে ইতালীয়রা জিতবেই।
কী ভয়াবহ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইতালি। করোনা-সংক্রমণে জেরবার দেশটিতে এখন মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ শিকার হচ্ছেন প্রাণঘাতী এই রোগের। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছেন শ’য়ে শ’য়ে। এ মিছিল কোথায়, কবে থামবে কেউ জানে না। তবে করোনাভাইরাস যে ইতালিকে পুরোপুরি বদলে দেবে, সেটা খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। করোনার আক্রমণের এই সময়টায় নিজ দেশের মানুষকে খোলা চিঠি লিখেছেন ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ফাবিও ক্যানাভারো। দেশ থেকে অনেক দূরে, চীনের গুয়াংজুতে বসে লেখা এই চিঠিতে ক্যানাভারো বলেছেন, এ বিপদের সময় দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে না পেরে কতটা উদ্বিগ্ন, কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডার চীনে আটকে গেছেন করোনাভাইরাসের কারণেই। চীনা সুপার লিগের দল গুয়াংজু এভারগ্রান্দেতে কোচ হিসেবে কাজ করা ক্যানাভারোর হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনই যেন ফুটে উঠেছে তাঁর লেখা সেই চিঠিতে।
প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে লেখা সেই চিঠিতে সাবেক জুভেন্টাস তারকা প্রথমেই তুলে ধরেছেন দেশ থেকে দূরে বসে অনুভব করা তাঁর তীব্র ব্যথা আর উদ্বেগের বিষয়টি, ‘আমার দেশ ইতালিতে এ মুহূর্তে যা হচ্ছে সেটি খুব উদ্বেগ আর ব্যথাতুর হৃদয়ে অনুভব করছি। আমি আপনাদের বোঝাতে পারব না নিজের দেশকে এমন অবস্থায় দেখাটা কতটা কষ্টের। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে শতশত। করোনাভাইরাসের নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার যারা হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের কথা ভেবে আমি মর্মাহত। বিশেষ করে যারা করোনায় তাদের নিকটজনকে হারিয়েছেন, তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই।’
এ দুঃসময়ের আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ইতালির অসংখ্য চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। যাঁরা নিজেদের পরিবার-পরিজন, জীবনকে তুচ্ছ করে রাত দিন ২৪ ঘণ্টা আর্ত-অসহায়দের পাশে থেকে সেবা করে যাচ্ছেন। ক্যানাভারোর ভাষায় সেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই হচ্ছেন সত্যিকারের জাতীয় বীর, ‘আমি অভিবাদন জানাই সেই সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেও অন্যের জীবন বাঁচানোর কাজে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। আমাদের দেশের সত্যিকারের বীর আপনারাই। আপনাদের মতো বীর সন্তানদেরই এ মুহূর্তে খুব প্রয়োজন আমাদের এই আক্রান্ত, অসহায় দেশের।’
চিঠিতে কিছুটা খেদও প্রকাশ করেছেন ক্যানাভারো। করোনাভাইরাসকে অবহেলা করার ব্যাপারেই সেই খেদ। প্রথমে ইতালীয়রা যে এই রোগকে খুব একটা পাত্তা দেননি, সেটিই ফুটে উঠেছে ইতালির সর্বকালের সেরা এই ফুটবল তারকার চিঠিতে, ‘আমরা কেউই সুপারম্যান নই। আমরা কেউই এই করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত নই। চীনে যখন এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমি ভেবেছিলাম এটি হয়তো ইতালীয়দের স্পর্শ করতে পারবে না। আমরা অবশ্যই এ ভয়ংকর ভাইরাসটিকে পাত্তা দিইনি। ছোট করে দেখেছিলাম। চীনে আমি গুয়াংজু এভারগ্রান্দের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি কয়েক সপ্তাহ আগে কোয়ারেন্টিনে কাটিয়েছি। চীনের জনগণ ইতিমধ্যেই সার্স ভাইরাসের শিকার হয়েছিল। সুতরাং তারা জানে মহামারির সময় কী করতে হয়। কিন্তু ইতালির জন্য এটি পুরোপুরি নতুন একটা বিষয়। এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা ইতালীয়রা কখনোই পড়িনি। তবে এখন, এ মুহূর্তে আমরা লড়াইয়ের মাঝামাঝি আছি। এটা একটা যুদ্ধ। এ লড়াইয়ে আমাদের অবশ্যই জিততে হবে। নিজেদের সেরাটা দিলেই এ যুদ্ধে আমরা জিততে পারব।’
করোনার ভবিষ্যতে ইতালির সামাজিক চেহারাটা যে বদলে দেবে, সেটা জানেন ক্যানাভারো। সে কারণেই তাঁর দেশের মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন তিনি, ‘একদিন এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু তখন ইতালির চেহারা হবে পুরোপুরি ভিন্ন। অনেকে নিজেদের ব্যবসা হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাবেন। অনেকে হারাবেন তাঁদের চাকরি। তখন আকাশসম পরিশ্রমের প্রয়োজন হবে সবকিছু আবার আগের জায়গায় নিয়ে আসতে। আশা করি, খুব শিগগিরই করোনাভাইরাসের টিকা বাজারে পাওয়া যাবে। একমাত্র সেই টিকার মাধ্যমেই আমরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে পুরোপুরি জিততে পারব। শত্রুকে পরাভূত করতে পারব।’
আপাতত যুদ্ধে জেতার অন্যতম কৌশল যে ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সেটি সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন ক্যানাভারো, ‘আপাতত আমরা ঘরে থেকে যুদ্ধটা লড়ি। পরিবার-পরিজনকে সময় দিই। যতটা সম্ভব কম মানুষের সঙ্গেই যেন এ মুহূর্তে আমাদের দেখা হয়, সেটারই চেষ্টা চালিয়ে যাই।’