>ইউরোপের বড় কোনো ক্লাবের হয়ে কোনো এশিয়ান তারকা চ্যাম্পিয়নস লিগ মাতাচ্ছেন, সর্বশেষ কবে দেখেছেন? ইউরোপ-সেরাদের মঞ্চে এশিয়ার পতাকা ওড়াতে এবার চলে এসেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার হিউং-মিন সন। সনের পিঠে চড়ে ইউরোপের সেরা ক্লাব হওয়ার স্বপ্ন দেখছে টটেনহাম
একটু এদিক-সেদিক হলে সনের এখন ফুটবল খেলারই কথা না, ফুটবল-টুটবল বাদ দিয়ে মিলিটারি ট্রেনিং করার কথা। ২০১৮ এশিয়াড ফুটবলে সোনা না জিততে পারলে দুই বছরের জন্য বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীর চাকরি করতে হবে, সনদের ওপর এমন বাঁচা-মরার এক শর্ত জুড়ে দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। ফাইনালে জাপানকে হারিয়ে সেবার নিজেদের ফুটবল-স্বপ্নটাকে জিইয়ে রেখেছিলেন সনরা। ভাগ্যিস স্বপ্নটা বেঁচেছিল! না হয় এশিয়াড ফুটবলের গণ্ডি পেরিয়ে কীভাবে বিশ্ব দেখতে পেত সনের উত্থান?
হামবুর্গ ও বেয়ার লেভারকুসেনের হয়ে জার্মান বুন্দেসলিগায় যখনই সুযোগ পেতেন, দর্শকদের দেখাতেন বল পায়ে কী কী করতে পারেন সন। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও দলগুলোর মূল খেলোয়াড় ছিলেন না সন। ২০১৫ সালে পা রাখেন ইংল্যান্ডে। এখানেও একই অবস্থা। প্রতিভা থাকলেও কখনোই টটেনহামের মূল খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। পাশে খেলতেন হ্যারি কেইন, ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, ডেলে আলির মতো তারকারা। বেঞ্চ থেকে যখনই মূল দলে সুযোগ পেতেন, নিজের জাতটা চেনাতে ভুলতেন না সন। কিন্তু ওই যে এশিয়ার কোনো এক খেলোয়াড় নিয়মিত ইউরোপের একটি শক্তিশালী ক্লাবের অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলবেন, এটা কেউ কল্পনাই করতে পারে না যেন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আরেক দক্ষিণ কোরিয়ার তারকা পার্ক-জি সুং যখন খেলতেন, তেভেজ-রোনালদো-রুনি-গিগসদের আলোকচ্ছটায় পার্শ্বচরিত্র হয়েই থাকতে হয়েছে তাঁকে। এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা ক্যারিয়ার। জাপানিজ তারকা শিনজি কাগাওয়া তো ইউনাইটেডে নিজেকে মেলেই ধরতে পারেননি। সবাইকে চমকে দিয়ে লেস্টার সিটি প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতলেও সে দলের স্কোয়াড খেলোয়াড় হয়ে ছিলেন শিনজি ওকাজাকি। মায়া ইয়োশিদা মোটামুটি ভালো সেন্টারব্যাক হলেও সাউদাম্পটন ইউরোপে খেলে না, তাই তাঁর প্রতিভার কথাও ইংল্যান্ডের বাইরে তেমন কেউ জানে না। একই কথা প্রযোজ্য ইন্টার মিলানের সাবেক জাপানিজ লেফটব্যাক ইউতো নাগাতোমোর ক্ষেত্রেও। সাবেক জাপানি তারকা হিদেতোশি নাকাতা রোমায় গিয়ে টট্টির ছায়ায় আড়াল হয়ে গিয়েছিলেন। মাকোতো হাসেবে বুন্দেসলিগার মাঝারি মানের ক্লাবগুলোর মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন ক্যারিয়ার।
এ রকম উদাহরণ চাইলে ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। ইউরোপের বড় কোনো ক্লাব এশিয়ার কোনো তারকার ওপর নিয়মিত নির্ভর করে বড় কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, এমনটা দেখাই যায় না। কেউই এশিয়ার ফুটবলের মহাতারকা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
এই তালিকায় না থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সন। এশিয়ার মহাতারকা হয়েই ছাড়বেন, এমনটা পণ করেছেন যেন। ২০১৬ সালে সন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে টটেনহাম ছাড়ার একটা সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন, সে সনই এখন স্পারদের চোখের মণি। সেবার টটেনহামের কোচ মরিসিও পচেত্তিনো আস্থা রেখেছিলেন তাঁর প্রতি। সেই লাভের গুড় এত দিনে এসে খাচ্ছে টটেনহাম।
সনের উত্থানটা স্বপ্নের মতোই। আর এই উত্থানকাব্য শুরু হয়েছে ২০১৮ বিশ্বকাপ থেকে। সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে না পারলেও সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে লজ্জায় ডুবিয়ে ২-০ গোলে হারিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। জার্মান বুন্দেসলিগায় খেলার অভিজ্ঞতার কারণেই কী না, সে ম্যাচে জার্মান রক্ষণভাগকে তটস্থ করে রেখেছিলেন সন।
এরপর আসল এশিয়াড। এশিয়াডে সোনা জিততেই হবে, পাহাড়সম চাপ নিয়ে টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলেন সন। দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ম, যেকোনো সুস্থ পুরুষকে বয়স ২৮ হওয়ার আগে সামরিক বাহিনী যোগ দিয়ে অন্তত ২১ মাস কাজ করতে হয়। কারও জন্যই এতে ছাড় নেই, তবে ক্রীড়াবিদদের জন্য নিয়মটা একটু শিথিল করা হয়। অলিম্পিক বা বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে পদক জিততে পারলে সামরিক বাহিনীতে কাজ করা থেকে ছাড় পাওয়া যায়। এশিয়ার আঞ্চলিক ‘অলিম্পিক’ এশিয়ান গেমসের ক্ষেত্রে আবার যেকোনো পদক হলেই চলবে না, জিততে হবে সোনাই। এশিয়াড যখন খেলতে যান, সনের বয়স তখন ২৬। কিন্তু সে শর্ত পূরণ করেননি। ইনচনে ২০১৪ এশিয়ান গেমসের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়াকে হারিয়ে অবশ্য সোনা জিতেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু সনের তখনকার ক্লাব বায়ার লেভারকুসেন তাঁকে ছাড়েনি বলে সেটিতে খেলা হয়নি তাঁর। ওদিকে ২০২০ অলিম্পিক শুরু হওয়ার মাত্র ১৬ দিন আগেই ২৮-এ পা দিয়ে ফেলবেন। তার মানে এশিয়াডই তাঁর শেষ সুযোগ ছিল। জিততে না পারলে টটেনহামের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে চলে যেতে হতো দক্ষিণ কোরিয়ায়। সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে এশিয়াডে সোনা জেতে দক্ষিণ কোরিয়া। সনের বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে!
দেশের জার্সিতে উজ্জ্বল সন এবার নজর দিলেন ক্লাবে। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলছে টটেনহাম, দলের মধ্যমণি যথারীতি অধিনায়ক হ্যারি কেইন। গ্রুপপর্বে এই কেইনের ওপর ভর করেই নকআউট রাউন্ডের বৈতরণি পার হলো স্পাররা। কিন্তু নকআউট রাউন্ডে চোটে পড়ে সে কেইনই চলে গেলেন মাঠের বাইরে। এখন উপায়? কে সামলাবে স্পারদের আক্রমণভাগের ভার?
সবাই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকলেও কোচ মরিসিও পচেত্তিনো চুপচাপ ছিলেন। মনে মনে যে জানতেন কে হ্যারি কেইনের জায়গা নেবে!
পার্শ্বনায়কের জায়গা থেকে সরে এসে পাদপ্রদীপের নিচে নায়কের জায়গাটায় এলেন সন। আর চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে সেই সনের আগুনেই পুড়ে খাক হলো পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। দুই লেগ মিলে তিন গোল করে বলতে গেলে একাই টটেনহামকে তুললেন সেমিতে। আক্রমণভাগে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, দেলে আলি ও লুকাস মৌরাদের সঙ্গে যেভাবে এক দুর্বোধ্য রসায়নের জন্ম দিয়েছেন, সেমিতে আয়াক্স কীভাবে সে ধাঁধার সমাধান করবে, দেখার বিষয় হবে সেটা।
সনকে নিয়ে গড়া সেই দুর্বোধ্য আক্রমণভাগের রহস্য আয়াক্স সমাধান করতে পারুক আর না পারুক, হিউং-মিন সন যে এশিয়ার মহাতারকা বেশ হতে পেরেছেন, এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়!