ইউরোপের ‘বিদ্রোহী লিগে’ রিয়াল–বার্সাসহ ১২ ক্লাব

ইউরোপের শীর্ষ ১২ ক্লাব অংশ হবে এ সুপার লিগের।
ছবি: সংগৃহীত।

২০০৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে শঙ্কাটা প্রকাশ করেছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভেতরে-ভেতরে বেশ কিছু কর্তা-ব্যক্তি নাকি জোট বেঁধেছেন, সেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে আলাদা একটা লিগ করার জন্য। মাঝে এ নিয়ে দীর্ঘ সময় কিছু শোনা যায়নি। ফিসফাস শুরু হয় গত বছর থেকে। দর্শক-সমর্থকদের কথা মাথায় রেখে একই মৌসুমে ইউরোপের বড় বড় দলকে অন্তত একবার মুখোমুখি করাতে ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগ’ নামে একটা টুর্নামেন্টের কথা নাকি ভাবা হচ্ছে। ফিফা ও উয়েফার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে অবশেষে কাল এই লিগের আত্মপ্রকাশের কথা ঘোষণা করল ১২টি ক্লাব। অনেকের কাছেই ‘বিদ্রোহী’ তকমা পাওয়া এই লিগ মাঠে গড়ালে ইউরোপিয়ান ফুটবলের চিরাচরিত কাঠামো পাল্টে যেতে পারে।

যে পরিমাণ অর্থের হাতছানি এই টুর্নামেন্টে, তাতে ফিফা ও উয়েফার হুমকি উপেক্ষা করে হলেও সুপার লিগে মাঠে নামতে পারে ক্লাবগুলো। সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, সুপার লিগের (ইএসএল) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ১২টি ক্লাবের কথা জানানো হয়েছে ইএসএলের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে রয়েছে ছয়টি ক্লাব—লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহাম। ইংল্যান্ডের মতো স্পেন থেকে নাম লিখিয়েছে শীর্ষ তিন ক্লাব—রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও আতলেটিকো মাদ্রিদ। ইতালিয়ান সিরি ‘আ’ থেকে যোগ দিয়েছে, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান ও এসি মিলান। কিন্তু জার্মানি ও ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগ থেকে সুপার লিগে যোগ দেয়নি কোনো ক্লাব। অর্থাৎ ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে তিনটি লিগের সেরা দলগুলোর যোগসাজশে আবির্ভাব ঘটছে সুপার লিগের।

সুপার লিগের লোগো এমনই হবে?

ইএসএলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলো ‘নিজেদের ঘরোয়া জাতীয় লিগগুলো খেলা’র পাশাপাশি ‘সপ্তাহের মাঝে নতুন এক প্রতিযোগিতা’ শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছে। ‘যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নযোগ্য’ পরিস্থিতি তৈরি হলেই সুপার লিগের প্রথম সংস্করণ মাঠে গড়াবে বলে জানানো হয়েছে। ইএসএল এক বিবৃতিতে জানায়, আরও তিনটি ক্লাব রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলোর তালিকায়। অর্থাৎ মোট ১৫টি ক্লাব। এই ১৫ দল সব সময় এই লিগে থাকবে। আরও পাঁচ দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে প্রতি মৌসুমে। অর্থাৎ মোট ২০ দল নিয়ে হবে সুপার লিগ।

১০ দলে ভাগ হয়ে দুটি গ্রুপ বানিয়ে খেলবে ক্লাবগুলো। এখনকার মতোই ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ ভিত্তিতে ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি গ্রুপ থেকে শীর্ষ তিন দল উঠবে কোয়ার্টার ফাইনালে। বাকি দুটি স্থানের জন্য দুটি গ্রুপের চতুর্থ ও পঞ্চম দল দুই লেগের প্লে-অফ ম্যাচ খেলবে। এরপর বাকি পথটা চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো। ফাইনাল ছাড়া কোয়ার্টার ও সেমিফাইনাল হবে দুই লেগের ভিত্তিতে। আর্থিক বিষয় নিয়ে আয়োজকেরা জানিয়েছেন ‘বর্তমান ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার তুলনায় বেশি অর্থ আয় হবে।’ নতুন এই লিগে অংশ নেওয়ার জন্য ‘প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলো ৩.৫ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা) করে পাবে।’

গুরুত্ব হারাবে চ্যাম্পিয়নস লিগ?

এদিকে বিদ্রোহী তকমা পাওয়া লিগের আয়োজকদের ‘লোভী’ ও ‘ধূর্ত’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করেছেন খেলার দুনিয়া ও রাজনৈতিক মহলের উচ্চপদস্থরা। সুপার লিগের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলো নিজ নিজ দেশের ঘরোয়া লিগ খেলার কথা জানালেও সে ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে তাদের ফুটবল বোর্ড। যে তিনটি দেশের (ইংল্যান্ড, স্পেন ও ইতালি) ক্লাবগুলো এই সুপার লিগ আয়োজন করছে, তাদের ঘরোয়া লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছে উয়েফা ও সেসব দেশের বোর্ড। ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হুমকি দিয়েছে খেলোয়াড়দেরও। অংশ নেওয়া দলগুলোর হয়ে যেসব খেলোয়াড় খেলবেন, তাদের ‘জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হবে না’ বলে হুমকি দিয়েছে উয়েফা। এসব দেশের ফুটবল বোর্ড ও উয়েফার পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই লোভী প্রকল্প বন্ধ করতে আমরা একত্র থাকব। কিছু ক্লাবের ব্যক্তিগত স্বার্থ মেটাতে এই প্রকল্প, সেটা এমন এক সময়ে করা হচ্ছে যখন সবার মধ্যে সংহতি প্রয়োজন।’

ইএসএল এই বিদ্রোহী লিগের ঘোষণা দিয়েছে হিসেব কষেই। কাল চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান ফরম্যাট সংস্করণ করা নিয়ে বসার কথা ছিল উয়েফার কর্তা-ব্যক্তিদের। বর্তমানের ৩২ দলের ফরম্যাট থেকে ৩৬ দলের প্রতিযোগিতায় উন্নীত করার কথা ভাবছে উয়েফা। তার আগ আগ দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো সুপার লিগ চালুর। এই সুপার লিগের ধারণা ২০১২ সালেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে আনা হচ্ছিল না। করোনাকালে সব বড় ক্লাব আর্থিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। আর এ কারণেই সুপার লিগ আয়োজনে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চ্যাম্পিয়নস লিগ তো আর প্রতি মৌসুমেই সব বড় দলকে অন্তত একবার করে একে-অপরের মুখোমুখি করতে পারে না। দর্শকদের এই চাহিদাকে পুঁজি করেই টাকা কামানো ও নতুন এই টুর্নামেন্ট চালু করবে ১২টি ক্লাব। এমন এক টুর্নামেন্টে ব্যস্ত থাকা মানেই তো চ্যাম্পিয়নস লিগের বিদায়। ঘরোয়া লিগ ও এই সুপার লিগে খেলার পর মৌসুমের সূচিতে আর কিছু (চ্যাম্পিয়নস লিগ) রাখা তো ভীষণ কঠিন।