কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় ১০০ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন হওয়ার পর তাদের ইতিহাসে আন্দ্রেই শেভচেঙ্কোর চেয়ে বড় ফুটবলার আর আসেনি। সাবেক ফিফা বর্ষসেরা এই খেলোয়াড় এখন জাতীয় দলের দায়িত্বে। আর দেশের সবচেয়ে বড় তারকা যখন শিক্ষক হিসেবে থাকেন, তখন অনুপ্রাণিত না হয়ে পারা যায়? যে দল গত ইউরোতে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়েছিল প্রতিটি ম্যাচ হেরে, এবার তারা একেবারেই অন্যরূপে যাচ্ছে ইউরো খেলতে। সে রূপটা কেমন?
দল: ইউক্রেন
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২৪
দলে আছেন যাঁরা
গোলরক্ষক
আন্দ্রিই পিয়াতভ (শাখতার দোনেৎস্ক), হিওর্হি বুশচান (দিনামো কিয়েভ), আনাতোলি ত্রুবিন (শাখতার দোনেৎস্ক)
সেন্টারব্যাক
মাইকোলা মাতভিয়েঙ্কো (শাখতার দোনেৎস্ক), সের্গেই ক্রিভোৎসভ (শাখতার দোনেৎস্ক), ইলিয়া জাবারনি (দিনামো কিয়েভ), ডেনিস পোপোভ (দিনামো কিয়েভ)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
ওলেকসান্দর কারাভায়েভ (দিনামো কিয়েভ), ওলেকসান্দর তিমচিক (দিনামো কিয়েভ)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক
এদুয়ার্দ সোবোল (ক্লাব ব্রুগা), ভিতালি মাইকোলেঙ্কো (দিনামো কিয়েভ)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
তারাস স্তেপানেঙ্কো (শাখতার দোনেৎস্ক), সের্গেই সিদোরচুক (দিনামো কিয়েভ), মাইকোলা শাপারেঙ্কো (দিনামো কিয়েভ), ইয়েভগেন মাকারেঙ্কো (কেভি করত্রিক), ওলেকসান্দর জিনচেঙ্কো (ম্যানচেস্টার সিটি)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
রুসলান মালিনভস্কি (আতালান্তা), গিওর্গি সুদাকভ (শাখতার দোনেৎস্ক), রোমান বেজুস (গেন্ট)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার
আন্দ্রিই ইয়ারমোলেঙ্কো (ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেড), মারলোস রোমেরো (শাখতার দোনেৎস্ক), ভিক্তর সিহানকভ (দিনামো কিয়েভ), ওলেকসান্দর জুবকভ (ফেরেনৎভারোস)
স্ট্রাইকার
রোমান ইয়ারেমচুক (জেন্ট), আর্তেম বেসেদিন (দিনামো কিয়েভ), আর্তেম দোভবিক (দনিপ্রো)
কোচ
আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো
অধিনায়ক
আন্দ্রিই ইয়ারমোলেঙ্কো
ইউরোয় সেরা সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন (সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে, ১৯৬০)
গ্রুপ পর্ব (২০১২, ২০১৬)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
নেদারল্যান্ডস (১৩ জুন)
উত্তর মেসিডোনিয়া (১৭ জুন)
অস্ট্রিয়া (২১ জুন)
শক্তি
দলের সবচেয়ে বড় তারকা খোদ কোচ শেভচেঙ্কো। ফলে আলাদা করে কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি করার সম্ভাবনা কম। খেলোয়াড়দের ওপর থেকে কোচ নিজেই আলো কেড়ে নেবেন। আর এটাই ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় সুবিধা, খেলোয়াড়েরা নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন নিরবচ্ছিন্নভাবে, মিডিয়ার উটকো আগ্রহ থাকবে না।
শেভচেঙ্কোর কোচিং সঙ্গীরা এর মধ্যেই দলের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পেরেছেন। এত দিন সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে কোনো আগ্রহ জাগাত না ইউক্রেনের খেলা, সেই দল এখন বেশ দৃষ্টিনন্দন খেলে। কৌশলগত দিক দিয়ে শেভচেঙ্কো অত বেশি একগুঁয়ে নয়, খেলোয়াড়েরাও বেশ বুদ্ধিমান। কোচ মাঠে যা চান, দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের সেটা মাঠে করে দেখানোর সামর্থ্য আছে। দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় হয় দিনামো কিয়েভ (১০ জন), না হয় শাখতার দোনেৎস্কের (৭ জন)। তাই ক্লাবে একসঙ্গে খেলার কারণে খেলোয়াড়দের মধ্যে যে রসায়ন গড়ে উঠেছে, সে রসায়ন জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও ফলদায়ক হতে পারে।
মাঠের ভেতর দলটার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা মাঝমাঠ। ক্লাব ক্যারিয়ারে যথাক্রমে জিয়ানপিয়েরে গাসপেরিনি ও পেপ গার্দিওলার মতো দুজন তুখোড় মস্তিষ্কের কোচের কাছ থেকে মালিনভস্কি ও জিনচেঙ্কোর মতো মিডফিল্ডাররা কী শিখলেন, সেটার একটা বহিঃপ্রকাশ দেখা যেতে পারে এই ইউরোতে। সঙ্গে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে নির্ভরযোগ্য স্তেপানেঙ্কো তো আছেনই।
দুর্বলতা
রক্ষণভাগের দুর্বলতা একটু হলেও ভোগাতে পারে দলটাকে। গত দশকে দলের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ইয়ারোস্লাভ রাকিতস্কিকে সেই ২০১৯ সাল থেকেই দলে নেওয়া হচ্ছে না রাশিয়ার ক্লাব জেনিতে যোগ দিয়েছেন বলে। এই কুশলী ডিফেন্ডারের অভাব এখনো ইউক্রেনকে ভোগায়। দলের ডিফেন্ডারদের মধ্যে অতটা বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। তাই সম্প্রতি ধারাবাহিক ফলাফল করতে পারছে না দলটি। অধিকাংশ খেলোয়াড়ের বড় পর্যায়ের টুর্নামেন্টে খেলার অভিজ্ঞতা নেই।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-৩-৩)
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন ছকে খেলানো শেভচেঙ্কো অবশেষে থিতু হয়েছেন ৪-৩-৩-এ। গোলকিপার হিসেবে অভিজ্ঞ পিয়াতভ খেলবেন, না বুশচান—এখনো ঠিক হয়নি সেভাবে। তবে ৩৭ বছর বয়সী পিয়াতভের চেয়ে বুশচানের খেলার সম্ভাবনাই বেশি। দুই সেন্টারব্যাক হিসেবে বাঁ পায়ের খেলোয়াড় মাইকোল মাতভিয়েঙ্কোর জায়গা নিশ্চিত।
পজিশনিং, পেছন থেকে নিখুঁত পাস দিয়ে আক্রমণের সূচনা করে দেওয়ার জন্য এর মধ্যেই বেশ নাম কামিয়েছেন মাতভিয়েঙ্কো, নজরে পড়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি ও আর্সেনালের। তাঁর পাশে খেলার জন্য লড়াই করবেন মূলত তরুণ প্রতিভাবান সেন্টারব্যাক জাবারনি ও ক্রিভোৎসভ। লেফটব্যাক হিসেবে জায়গা পাওয়ার জন্য লড়াই করবেন সোবোল ও মাইকোলেঙ্কো। রাইটব্যাকে কারাভায়েভের জায়গা নিশ্চিত।
তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে স্তেপানেঙ্কোকে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায় রেখে অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবেন আতালান্তার মালিনভস্কি ও ম্যানচেস্টার সিটির ওলেকসান্দর জিনচেঙ্কো। জিনচেঙ্কো ক্লাবে লেফটব্যাক হিসেবে খেললেও এখানে পুরোদস্তুর মিডফিল্ডার। আক্রমণভাগে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন ইয়ারেমচুক, দুই উইঙ্গার হিসেবে অভিজ্ঞ ইয়ারমোলেঙ্কোর পাশাপাশি খেলতে পারেন ২০২০ সালে ইউক্রেন লিগের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া ভিক্তর সিহানকভ।
ছোট ছোট পাসে আক্রমণ গড়তে আগ্রহী এই দল। রক্ষণে অনেকটা ৪-১-৪-১ ছকে রূপ নেয়। বল পায়ে মাইকোলেঙ্কো, মাতভিয়েঙ্কো, সোবোলদের মতো ডিফেন্ডারদের দক্ষতার কারণে প্রয়োজনে ৩-৪-১-২ ছকেও দলকে খেলাতে পারেন শেভচেঙ্কো।
আমি ম্যাচের ফলাফলের দিকে তাকাই না কখনো। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমরা কেমন খেললাম, সেটা। খেলোয়াড়দের যা যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সেটা ঠিকঠাক করতে পেরেছে কি না, আমরা আরও ভালো খেলতে পারতাম কি না। আমি আমার খেলোয়াড়দের নিয়ে গর্বিত। কারণ, তারা সব সময় শেষ পর্যন্ত লড়ে যায়।আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো, ইউক্রেন কোচ
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
তুলনামূলকভাবে ইউক্রেনের গ্রুপটা বেশ সহজ। যে দল বাছাইপর্বে ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালকে হারিয়েছে ও গ্রুপের শীর্ষে থেকে বাছাইপর্ব শেষ করেছে, সে দলের মূল খেলোয়াড়েরা ছন্দে থাকলে গ্রুপ পর্ব পেরোতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। আর সেটা যদি হয়ে যায়, তাহলে ইউক্রেন গঠিত হওয়ার পর দেশটার সবচেয়ে বড় ফুটবলীয় সাফল্য সেটাই হবে। ইউক্রেনের প্রত্যাশা থাকবে নকআউটে ওঠার পর কোনো একটা চমক দেখানো। সেটা করতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।