এই সেদিন সাইফ স্পোর্টিংকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে টানা তিন জয় তুলে নিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। লিগের দ্বিতীয় পর্বে সাদা–কালো জার্সিধারীরা কীভাবে যেন নিজেদের বদলে ফেলেছে। সেই একই দল কিন্তু সেটি বদলে যাওয়া। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে নিজেদের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা মোহামেডান সমর্থকেরা আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে দেখছেন এই বদলে যাওয়া। তাঁরা এখন স্বপ্ন দেখছেন দলটিকে নিয়ে। হালের বাস্তবতায় হয়তো বড় কিছু সম্ভব নয়, কিন্তু সমর্থকেরা খুশি মোহামেডানের এই বদলেই। লিগের চতুর্থ স্থানে উঠে আসা মোহামেডানের এই হঠাৎ বদলের নেপথ্যে আছে দেশের ফুটবলের অন্যতম দুই সেরা তারকার বোঝাপড়া।
এ মৌসুমে মোহামেডানের পাঁড় সমর্থকদের খুব প্রিয় দৃশ্য এটি। ডাগআউট দাঁড়িয়ে সলাপরামর্শ করছেন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব ও আলফাজ আহমেদ। বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম দুই সেরা স্ট্রাইকার। মোহামেডানের সমর্থকেরা এ দুজনকে দেখলে নস্টালজিক হয়ে ওঠেন। অতীত দিনের মাঠের অজস্র স্মৃতি ভিড় করে তাঁদের মানসপটে। আলফাজ-নকীব জুটি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মোহামেডানকে এনে দিয়েছেন কত জয়! কত সুন্দর মুহূর্ত। আলফাজের বল নিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বডি ডজে বোকা বানানো কিংবা দূরপাল্লার শটে গোল, যেকোনো সেটপিসে নকীবের মাথার ছোঁয়া। সাপের ছোবলের ভঙ্গিতে হেড। প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের লুকিয়ে থেকে আসল কাজ করে দেওয়া—মোহামেডান কেন, বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের অনেকেই তো এসব দৃশ্য ভুলতে পারবেন না। মোহামেডান ও বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুই তারকা এখন মোহামেডানকে এগিয়ে নিচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব থেকে। দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নকীব আর সহকারী কোচের দায়িত্ব আলফাজের কাঁধে।
মোহামেডানের প্রধান কোচ শন লেন ছুটিতে গেছেন। ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য জটিলতায় তিনি বাংলাদেশে ফিরতে পারেননি। এই অবস্থায় সহকারী কোচ আলফাজই এখন মোহামেডানের দায়িত্বে। কৌশল ঠিক করা, একাদশ নির্বাচন—সবই তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। নকীব ম্যানেজার হিসেবে তাঁর মস্তিষ্কেরও ব্যবহার করে যাচ্ছেন দলের প্রয়োজনে। দুই তারকার ‘মস্তিষ্ক’ একসঙ্গে যূথবদ্ধ হতেই অখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া মোহামেডান বদলে যাওয়া এক দল। এই দুই মাথার কৌশলেই লিগের দ্বিতীয় পর্বে টানা তিন ম্যাচে তিন জয় তুলে নিয়েছে মোহামেডান। ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাব ক্যাসিনো–কাণ্ড থেকে শুরু করে নানা অব্যবস্থাপনায় একদিন ধুঁকছিল। মোহামেডান সমর্থকেরা দলের কাছ থেকে শেষ কবে টানা তিন জয় দেখেছে, সেটাও গবেষণার বিষয়। আলফাজ-নকীব আসলে অনেক কিছুই সম্ভব করছেন। শৃঙ্খলা, কর্মকৌশল আর দায়বদ্ধতা কী করতে পারে, নকীব আর আলফাজ প্রমাণ করেছেন সেটিই।
ঋণ শোধেরও তো একটা ব্যাপার আছে। এই নকীবের ‘নকীব’ হয়ে ওঠা মোহামেডানের জার্সিতেই। ১৯৯০ সালে বাইন্ডিং খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন দলে। বাজিমাত করতে খুব বেশি সময় নেননি। নিজেকে দারুণ এক স্ট্রাইকার হিসেবে প্রমাণ করে হয়ে ওঠেন সাদা-কালো শিবিরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৯০-তে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথম জাতীয় দলের জার্সিতে খেলা নকীবের বিদেশের মাটিতে আছে গোল করার অনন্য এক নজির। যদিও সেটি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল না, ১৯৯১ সালে প্রি-অলিম্পিক ফুটবলে সিউলে ফিলিপাইন অলিম্পিক দলকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ অলিম্পিক দল। নকীব সে ম্যাচে একাই করেছিলেন ৫ গোল। বিদেশি দলের বিপক্ষে যেকোনো পর্যায়েই সেটা বাংলাদেশের পক্ষে রেকর্ড। ১৯৯৫ সাল মিয়ানমার চার জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম নায়ক নকীব। ফাইনালে মিয়ানমারের বিপক্ষে জয়সূচক গোলটি ছিল তাঁরই। মোহামেডানের জার্সিতে নকীবের আছে অনন্য কিছু কীর্তি। বহু আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের ভাগ্য তিনি নিজের গোলে গড়ে দিয়েছেন। আছে আবাহনীর বিপক্ষে হ্যাটট্রিকও।
আলফাজের গল্পটাও একই। তবে তিনি নানা ভূমিকাতেই মোহামেডানকে সমৃদ্ধ করেছেন নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে। শুরুর দিকে মিডফিল্ডার এরপর স্ট্রাইকার—আলফাজের ভূমিকা নানামুখী। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও বাংলাদেশের অনেক সুখস্মৃতির সাক্ষী আলফাজ। ১৯৯৯ সাফের ফাইনালে জয়সূচক গোল আলফাজের। নকীব-আলফাজের যুগলবন্দীও অনেক পুরোনোই। ২০০১ সালে আবাহনীর বিপক্ষে নকীবের যে হ্যাটট্রিক, তার দুই গোলে ছিল আলফাজের অ্যাসিস্ট। সেবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে ২ গোলে পিছিয়েও নকীবের হ্যাটট্রিকে ৪-৩ গোলের অবিস্মরণীয় জয় পেয়েছিল মোহামেডান।
সেই আলফাজ-নকীব এখন মোহামেডানে অন্য ভূমিকায়। মোহামেডান ও জাতীয় দলের দীর্ঘদিনের সতীর্থ এই দুই তারকা এখন জুটি বেঁধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মোহামেডানকে ব্যর্থতা আর বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলতে সমর্থকদের মুখে আবারও হাসি ফোটাতে। তবে আলফাজ নিজে কোনো কৃতিত্ব নিতে চান না। তবে তিনি নকীবকে তাঁর সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে উচ্ছ্বসিত, ‘আমি তেমন কিছুই করিনি। প্রধান কোচ শন লেনের পরিকল্পনাই মূলত আমি বাস্তবায়ন করি। আর কিছু না। তবে নকীবকে ম্যানেজার হিসেবে পেয়ে খুব ভালো হয়েছে। ওর সঙ্গে আমার শতভাগ মত মিলে যায়। একে অন্যকে সহজে বুঝতে পারি। খোলামেলা আলাপ করতে পারি। মতের মিল হয় খেলোয়াড় পরিবর্তনের বেলাতেও।’
নকীব আবার বড় সনদ দিচ্ছেন আলফাজকে, ‘আলফাজ কত বড় খেলোয়াড়, সবাই জানে। সে বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তি। আমরা তো একে অন্যের বন্ধু। কত বছর একসঙ্গে এক দলে খেলেছি। কত স্মৃতি আমাদের। আপাদমস্তক একজন সৎমানুষ। ইংলিশ কোচ শন লেনের সঙ্গে আমাদের দুজনের বোঝাপড়াই ভালো। আমরা দুজনই তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি।’
আলফাজ-নকীবে নস্টালজিক মোহামেডান-ভক্তরা অনেক দিন পর। এ জুটি সাফল্য পেলে সেটি বাংলাদেশের ফুটবলের জন্যই হবে দারুণ কিছু।