মেসি আর নেইমারের জন্য বিশ্বকাপটা দুরকম কাটতে পারে বলে জানাচ্ছে ইএসপিএনের বিশ্লেষণ
মেসি আর নেইমারের জন্য বিশ্বকাপটা দুরকম কাটতে পারে বলে জানাচ্ছে ইএসপিএনের বিশ্লেষণ

ইএসপিএনের বিশ্লেষণ

আর্জেন্টিনা বাদ দ্বিতীয় রাউন্ডে, ব্রাজিল জিতবে বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপের এখনো সাত মাস বাকি। এ সময়ে কত খেলোয়াড়ের চোটে পড়ে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়ার করুণ গল্প হয়তো দেখা যাবে, কেউ হয়তো আড়াল থেকে হঠাৎ আলোয় এসে বিশ্বকাপের দলে জায়গা পাওয়ার দারুণ গল্প লিখবেন। অনেক কোচের চাকরি চলে যেতে পারে। কত অজানা কিছুই তো ঘটতে পারে! অজানা কিছু কী, এখনো ৩২ দলের তিনটি চূড়ান্তই হয়নি, সেটি হবে জুনে ইউরোপিয়ান ও আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফগুলোর পর।

এ সময়ে বসে আগামী নভেম্বরে কাতারে শুরু হতে যাওয়া ২০২২ বিশ্বকাপে কী ঘটবে না ঘটবে, সেটি বিশ্লেষণ করতে বসা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পাগলামি’টা ইএসপিএন করেছে। আর বিশ্বকাপের মহিমাই সম্ভবত এই যে, বিশ্বকাপের বছরে এই পাগলামিতেও প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে হয়!

বিশ্বকাপের তিনটি দল এখনো চূড়ান্ত না হতে পারে, কিন্তু প্লে-অফ থেকে আসা তিন দল কোন গ্রুপে খেলবে, সেটি তো নিশ্চিত। দল তিনটি কারা হতে পারে, সেটিও ধারণা করে নেওয়া যায়। সব মিলিয়ে গ্রুপ পর্বে ৩২টি দলের খেলা কখন, কোথায়, কার সঙ্গে হবে, সেটি তো নিশ্চিতই।

সেসব বিবেচনায় নিয়েই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ৬৪ ম্যাচের প্রতিটির ফল কী হতে পারে, কোন দল কেমন করতে পারে, নকআউট পর্বে কারা উঠবে, শেষ পর্যন্ত শিরোপা কোন দল জিতবে—সব বিশ্লেষণ করেছে ইএসপিএন। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।

বিশ্লেষণের আগে অবশ্য প্লে-অফ থেকে কোন তিন দল আসতে পারে, সেটি ঠিক করে নিয়েছেন নিজেকে ‘পাগল’ দাবি করে ইএসপিএনে বিশ্লেষণটি নিয়ে হাজির হওয়া রায়ান ও’হ্যানলন। বাকি তিন দল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য একেবারেই সাধারণ একটি পরিমাপক ঠিক করে নিয়েছেন তিনি—র‍্যাঙ্কিং। সে হিসেবে পেরু, ওয়েলস আর কোস্টারিকা সুযোগ পাচ্ছে বিশ্বকাপে!

আর ম্যাচের ফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণে কোন কোন দিকগুলো কাজে লেগেছে? খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত রেটিং আর দলের পারফরম্যান্স মিলিয়ে প্রতিটি জাতীয় দলকে একটা রেটিং দেওয়ার মডেল তৈরি করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টোয়েন্টি ফার্স্ট গ্রুপ, সেটির সাহায্য নিয়েছে ইএসপিএন। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কোন দল গড়ে কেমন গোল খেয়েছে আর দিয়েছে, সর্বশেষ দুই বিশ্বকাপে দলগুলোর গোল খাওয়া-দেওয়ার হিসাব; আক্রমণে ওঠার ক্ষেত্রে কোন দল দ্রুতগতিতে ওঠে, কোন দল ধীর; কোন দল রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলে, কারা আক্রমণাত্মক; কার রেটিং কেমন...অনেক হিসাবই আছে মডেলে।

হিসাবে আসে বিশ্বকাপে ‘ট্রেন্ড’ও। যেমন ধরুন, বিশ্বকাপ ইতিহাসে ৮০ শতাংশ ম্যাচ জয়-পরাজয় দেখে, ২০ শতাংশ ম্যাচ দেখে ড্র। জয়ের ক্ষেত্রে ২-১ ব্যবধানটাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, ড্র বেশি হয় ১-১ গোলে। আবার দলের শক্তির বিশ্লেষণে ডেনমার্ক বিশ্বের দশম শক্তিশালী দল হিসেবে আসছে (দক্ষিণ আমেরিকায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল আর ইউরোপের সেরা সাত ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড, জার্মানি, পর্তুগাল, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের পর)।

গ্রুপ পর্ব:

বড় দলগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ড নিজেদের প্রথম ম্যাচে ইরানকে ২-০ গোলে হারাবে বলে জানাচ্ছে ইএসপিএনের বিশ্লেষণ। নেদারল্যান্ডস ১-১ গোলে ড্র করবে সেনেগালের বিপক্ষে, আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবকে ৩-০ গোলে হারাবে। গোল খাওয়া-দেওয়ায় ‘বেহিসেবি’ পেরুর বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতবে অনেক প্রতিভা নিয়েও রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলা ফ্রান্স। জার্মানি জাপানকে হারাবে ৩-২ গোলে, কোস্টারিকার সঙ্গে ২-০ গোলে জিতবে স্পেন। ব্রাজিল ২-০ গোলে হারাবে সার্বিয়াকে—গত বিশ্বকাপের মতোই, আর পর্তুগাল ২-০ গোলে জিতবে আফ্রিকান নেশনস কাপের গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ার পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পার হওয়া ঘানার বিপক্ষে।

চমকও থাকবে। ইএসপিএনের বিশ্লেষণ বলছে, আগের চেয়ে বুড়িয়ে যাওয়া ক্রোয়েশিয়া আর উরুগুয়ে প্রথম ম্যাচে হেরে যাবে। ৩৫ বছরের দুই স্ট্রাইকার সুয়ারেজ-কাভানির ওপর ভরসা রাখা, যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার থেকে বরখাস্ত হওয়া কোচের অধীন উরুগুয়ে ১-০ গোলে হারবে সন হিউং মিনের দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। তবে তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সবচেয়ে বড় চমক সম্ভবত সোনালি প্রজন্মের শেষ বিশ্বকাপ দেখতে আসা বেলজিয়ামের কানাডার কাছে ২-১ গোলে হেরে যাওয়া।

সুয়ারেজ কাভানির উরুগুয়ে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়বে বলে জানাচ্ছে ইএসপিএনের মডেল

ইএসপিএনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত গ্রুপসেরা ও গ্রুপ রানার্সআপের তালিকায় বেশ কিছু চমক থাকবে বটে। চমক বললেও হয়তো কম বলা হয়ে যায়! এমনই যে, কিছু কিছু গ্রুপের অবস্থা, কিছু কিছু দলের অবস্থান দেখে এই বিশ্লেষণের যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যেতে পারে!

যেমন ধরুন, মরক্কো, কানাডা, বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়ার গ্রুপ থেকে বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া দুই দলই বাদ পড়বে, এটা কজন বিশ্বাস করবেন? কিন্তু ইএসপিএনের বিশ্লেষণ তা-ই বলছে! যুক্তি? দুই দলই বুড়িয়ে গেছে, ২০১৮ বিশ্বকাপের পর ক্রোয়েশিয়া সেভাবে আলো ছড়াতে পারেনি, বেলজিয়াম প্রতিভা আর ফর্মেও পিছিয়েছে। বুড়িয়ে যাওয়া উরুগুয়েকেও গ্রুপ পর্বেই বাদ দেখাচ্ছে ইএসপিএনের বিশ্লেষণ, ডেনমার্কের চেয়ে পিছিয়ে ফ্রান্স হচ্ছে গ্রুপে দ্বিতীয়!

ইএসপিএনের বিশ্লেষণে শেষ পর্যন্ত গ্রুপ পর্ব থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে যাঁরা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠছে, সে তালিকাটা এ রকম—

গ্রুপ এ: নেদারল্যান্ডস, সেনেগাল

গ্রুপ বি: ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র

গ্রুপ সি: আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড

গ্রুপ ডি: ডেনমার্ক, ফ্রান্স

গ্রুপ ই: স্পেন, জার্মানি

গ্রুপ এফ: মরক্কো, কানাডা

গ্রুপ জি: ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড

গ্রুপ এইচ: পর্তুগাল, দক্ষিণ কোরিয়া

শেষ ষোলোতে কী হবে?

ফ্রান্স গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়ায় কপাল পুড়ছে আর্জেন্টিনার। ২০১৮ বিশ্বকাপের মতো এবারও শেষ ষোলোতে দেখা হচ্ছে মেসি আর এমবাপ্পের। তাতে এবারও মেসিরই বিশ্বকাপ শেষ হচ্ছে বলে জানাচ্ছে ইএসপিএনের বিশ্লেষণ। পার্থক্যটা হলো, সেবার ৯০ মিনিটেই ৪-৩ গোলে হেরেছে আর্জেন্টিনা, এবার অতিরিক্ত সময় শেষে আর্জেন্টিনার ২-১ গোলে হার দেখছে ইএসপিএনের মডেল।

প্রতিটি ম্যাচের ফল কী হতে পারে, ইএসপিএন সেটি তুলে ধরেছে—

নেদারল্যান্ডস ১: ২ যুক্তরাষ্ট্র

আর্জেন্টিনা ১: ২ ফ্রান্স (অতিরিক্ত সময়ের শেষে)

ডেনমার্ক ১: ০ পোল্যান্ড

ইংল্যান্ড ২: ০ সেনেগাল

স্পেন ১: ০ কানাডা

ব্রাজিল ২: ০ দক্ষিণ কোরিয়া

মরক্কো ১: ৩ জার্মানি

পর্তুগাল ১: ১ সুইজারল্যান্ড (টাইব্রেকারে পর্তুগাল যাবে পরের রাউন্ডে)

কোয়ার্টার ফাইনাল

আর্জেন্টিনার বিদায়েই বিশ্বকাপ অনেকটা রং হারাবে, অন্তত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের অর্ধেকের জন্য তো বটেই। তবে আকর্ষণীয় ম্যাচের কমতি থাকবে না। বিশ্বকাপে তা কখনো থাকেও না!

ইএসপিএনের বিশ্লেষণে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম ম্যাচটিই হবে ‘ফাইনাল’ হওয়ার দাবিদার এক ম্যাচ—ব্রাজিল বনাম স্পেন। তিতের অধীনে রক্ষণে দারুণ সংগঠিত ব্রাজিল, আর লুইস এনরিকে স্পেনকে খেলাচ্ছেন দুর্ধর্ষ কোনো ক্লাব দলের মতো—আক্রমণে ক্ষুরধার, বল কেড়ে নিতে প্রতিপক্ষের অর্ধেই তৎপর। দুই দলের এই ম্যাচে কী হবে? ইএসপিএনের মডেল জানাচ্ছে, অতিরিক্ত সময় শেষে ২-১ গোলে জিতবে ব্রাজিল।

তৃতীয় ম্যাচটিও কম কী! জার্মানি বনাম পর্তুগাল। হান্সি ফ্লিকের অধীনে আরও ক্ষুরধার জার্মানি সেখানে ২-১ গোলে হারাবে ফার্নান্দো সান্তোসের অধীনে অনেক প্রতিভা পেয়েও কাজে লাগাতে না পারা পর্তুগালকে। ইংল্যান্ড-ডেনমার্কও উত্তেজনা কম ছড়াবে না। গতিময় আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা দুই দলের ম্যাচে ইংল্যান্ডেরই শেষ হাসি দেখছে ইএসপিএন, তারা জিতবে ২-০ গোলে। অন্য ম্যাচে বেনজেমা, এমবাপ্পেদের দাপটের সামনে যুক্তরাষ্ট্র তেমন একটা পাত্তা পাবে না, সেখানে ফ্রান্সের ২-০ গোলের সহজ জয়ই দেখছে ইএসপিএনের মডেল।

সেমিফাইনাল

একদিকে ব্রাজিলের সামনে ফ্রান্স, অন্যদিকে জার্মানির মুখোমুখি ইংল্যান্ড। ইতিহাসের পাঠ দিয়ে যাওয়া দুই ম্যাচ। ১৯৮৬, ১৯৯৮, ২০০৬...তিন বিশ্বকাপের স্মৃতি বলে, ব্রাজিল আর ফ্রান্সের ম্যাচ মানেই রোমাঞ্চের হাতছানি। তবে সে তিনবারই ফ্রান্স জিতলেও এবার ব্রাজিলেরই ২-১ গোলে জয় দেখছে ইএসপিএন।

অন্য ম্যাচে ইউরোর ফাইনালে খেলা ইংল্যান্ডকেই বিশ্বকাপের ফাইনালে যেতে দেখে ইএসপিএন, ২-২ গোলে ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে জিতবে গ্যারেথ সাউথগেটের দল। সে জন্য অবশ্য অনেক যদি-কিন্তুর হিসাব রেখেছে তারা। ইংল্যান্ড কোচ সাউথগেট ৩-৪-৩ ছক ফেলে তিন ডিফেন্ডারের বদলে আক্রমণে খেলোয়াড় বাড়াবেন কি না, ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডের মতো বল পায়ে দারুণ মানসম্পন্ন একজনকে খেলানোর জায়গা বের করতে পারবেন কি না...এ দুটি উত্তরে হ্যাঁ এলেই ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত জানাচ্ছে ইএসপিএন।

ব্রাজিলের পঞ্চম বিশ্বকাপের আনন্দ। এবার ছয় নম্বরটি আসছে?

ফাইনাল: ইংল্যান্ড-ব্রাজিল

২০১৭ সালে ওয়েম্বলিতে প্রীতি ম্যাচে দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচটার মতো না হলেই হয়! সেদিন ম্যাচটা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। এবার তো আর ড্রয়ের সুযোগ নেই, তবে অতটা ম্যাড়মেড়ে হলে আর ফাইনাল কিসের!

দুই দলই সর্বশেষ মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনাল খেলে হেরেছে। ইএসপিএনের মডেল জানাচ্ছে, দুই দলই টুর্নামেন্টে রক্ষণে সেরা দুই দল হবে, সে ক্ষেত্রে ফাইনালেও গোল না খাওয়ার পণই দেখা যাবে দুই দলের ফুটবলে। এক মুহূর্তের ঝলক, বা একটা ভুলেই ম্যাচটার নিষ্পত্তি দেখছে ইএসপিএন।

সেটি কার পক্ষে যাবে? ইএসপিএনের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, ম্যাচের ফল হবে—ব্রাজিল ১: ০ ইংল্যান্ড।

এই বিশ্লেষণে ভরসা রাখলে ব্রাজিল সমর্থকেরা এখনই আনন্দের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন!