গ্রায়েম স্যুনেস বুঝতে পারছেন না, কী করা উচিত। শেষ কবে এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিলেন, মনে করতে পারছেন না।
খেলোয়াড়ি জীবনে স্যুনেস ছিলেন প্রতিপক্ষের মনে ভীতিজাগানিয়া এক খেলোয়াড়, লিভারপুলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। আশির দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা রক্ষণাত্মক এই মিডফিল্ডারের সময়ে লিভারপুলও তাদের ইতিহাসের সেরা সময়টা কাটিয়েছে। খেলার মাঠে কিংবা বাইরে একই রকম দুর্দমনীয় ছিলেন স্যুনেস।
মাঠে এমন সব ট্যাকল করতেন যে প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা তাঁকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন। খেলা ছাড়ার পর ম্যানেজার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। প্রিয় লিভারপুলের পর গ্যালাতাসারাই, তুরিনো, সাউদাম্পটনের মতো ক্লাব ঘুরে কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সে। পেশা বদলালেও স্যুনেস নিজে বদলাননি মোটেও। সেই একই রকম রগচটা, অনমনীয়।
সেই রগচটা স্যুনেসের মাথায় ঢুকছেই না, কী করা উচিত। চেশায়ারের ব্যস্ত সড়ক ধরে মার্সিডিজ চালিয়ে যাচ্ছেন সাবেক এই স্কটিশ মিডফিল্ডার, পাশে বসে আছেন এক রুশ। পেছনে আরও তিনজন। স্যুনেসের পাশে যিনি বসে আছেন, গোটা গাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। জানালা দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন বাইরে। অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য কাটাতে গলা খাঁকারি দিয়ে দু-একবার কথা বলার চেষ্টাও করলেন স্যুনেস। দেখলেন, ভাব বিনিময়ে তেমন আগ্রহ নেই ভদ্রলোকের। ইংরেজিতেও ঠিক অতটা সড়গড় নন।
‘আরে, আমাকে চেনে না নাকি!’—একটু বিরক্তই হলেন স্যুনেস। সারা জীবন মানুষের মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত স্যুনেস অসন্তুষ্ট হলেন পাশে থাকা মানুষটার নির্বিকারত্বে। কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন।
ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন পেছনে বসে থাকা তিনজনের মধ্যে একজন—পিনি জাহাভি। ইসরায়েলের সাবেক এই ফুটবলার তত দিনে জাঁদরেল এজেন্ট। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা বাকি তিন রুশ ইংল্যান্ডে এসেছেন তাঁর আমন্ত্রণেই। উদ্দেশ্য, ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে বসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ দেখা।
সেদিন স্বাগতিক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মুখোমুখি হবে ফুটবল দুনিয়ার আরেক পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গাড়ি চালাতে থাকা স্যুনেসের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন জাহাভিই। স্যুনেসের পাশে বসে থাকা মানুষটার উদ্দেশে বললেন, ‘ইনি হলেন আমার বন্ধু, গ্রায়েম স্যুনেস। ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের ম্যানেজার।’
স্যুনেসের পরিচয় পেয়ে একটু অপ্রস্তুতই হয়ে গেলেন পাশে থাকা ভদ্রলোক। এতক্ষণ যে তাঁকে স্রেফ একজন গাড়িচালকই ভেবেছিলেন। চোখে একটু সমীহ ফুটিয়ে তুলে স্যুনেসের হাঁটু স্পর্শ করলেন। ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুশি হলাম!’
স্যুনেস সেদিন বুঝতেও পারেননি, এতক্ষণ ধরে তাঁর পাশে যে মানুষ চুপচাপ বসে রইলেন, যাঁকে বিমানবন্দর থেকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে গাড়িতে করে ‘লিফট’ দিলেন, কয়েক মাস পর সেই চুপচাপ লোকই ইংল্যান্ডের ফুটবল অঙ্গনে ঝড় বইয়ে দেবেন। যে ঝড়ে ওলট-পালট হয়ে যাবে স্যুনেসের প্রিয় লিভারপুল থেকে শুরু করে আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, টটেনহাম, ম্যানচেস্টার সিটি—ইংলিশ ফুটবলই।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ডে দুই সঙ্গী নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ দেখতে আসা ভদ্রলোকের নাম রোমান আব্রামোভিচ।
সেদিন রোমান আব্রামোভিচ ব্যতিক্রম কিছু করেননি। তিনি মানুষটাই এমন! চুপচাপ, নির্বিকার। পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। নিজের কণ্ঠ নয়, বরং কাজই তাঁর হয়ে কথা বলবে, এমন মন্ত্রে বিশ্বাসী। আগে ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট বার্থেলেমিতে নিজের মিলিয়ন ডলারের ইয়টে নিয়মিত নতুন বছর উদ্যাপনের জন্য পার্টির আয়োজন করতেন।
ব্রিটিশ রাজপুত্র থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র তারকা, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব—কে আসতেন না সেই পার্টিতে! তবে যাঁরা আসতেন, তাঁদের অধিকাংশই আব্রামোভিচের দেখা পেতেন না। অতিথি আপ্যায়নে আব্রামোভিচের সে সময়কার স্ত্রী ড্যাশা ঝুকোভা থাকলেও কয়জন আব্রামোভিচের সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলার সুযোগ পেতেন, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। আব্রামোভিচ এমনই!
গোটা নেট দুনিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটার বেশি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় না আব্রামোভিচের। ২০০৩ সালে চেলসির মালিক হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক কয়েকটা বিবৃতি ছাড়া তেমন কোথাও নিজেকে জাহির করতে যাননি, মিডিয়াকে অনুমতি দেননি মনের অন্দরমহলে প্রবেশ করার। আর সেই বিবৃতিগুলোর ভাষাও কী ক্লিশে, কী ম্যাড়মেড়ে!
পড়ে মনে হতেই পারে, লোকটা ফুটবলের ‘ফ’-ও বোঝেন না। খেলাটার প্রতি আগ্রহ নেই বিন্দুমাত্র, আগ্রহ শুধু চেলসির নাম ব্যবহার করে ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি অর্জনের।
আর এখানেই ধোঁকা খেয়ে যান সবাই। ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে ২০০৭ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর স্টামফোর্ড ব্রিজে চেলসির প্রতিটা ম্যাচ ভিআইপি গ্যালারিতে বসে দেখেছেন। ব্যবসায়িক কারণে কখনো কখনো লন্ডনে না আসতে পারলেও যখনই সুযোগ পেয়েছেন, ছুটে এসেছেন প্রাণের চেলসির কাছে। কখনো ল্যাম্পার্ড-দ্রগবাদের একেকটা গোলে উদ্বেলিত হয়েছেন, কখনো টেরি-চেকদের গোল খাওয়া দেখে হতাশায় মুষড়ে পড়েছেন।
২০১২ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগে ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে বায়ার্নের আরিয়ান রোবেনের পেনাল্টি মিস করার কথা মনে পড়ে যায়। নখকামড়ানো উত্তেজনাপূর্ণ সেই মুহূর্তে সাবেক চেলসি উইঙ্গারের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেন পিওতর চেক। তা দেখে গ্যালারিতে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে আব্রামোভিচের সে কী উল্লাস! তা দেখে কে বলবে, এই লোক নিছক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চেলসিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন?
অবাক লাগতে পারে, যে চেলসির জন্য এত ভালোবাসা, সেই চেলসি কিন্তু তাঁর পছন্দের তালিকার প্রথম ক্লাব ছিল না। ফুটবল নিয়ে আগ্রহ কমবেশি ছিলই, চেয়েছিলেন একটা ক্লাব কিনতে। নিজের দেশের সিএসকেএ মস্কো ছিল প্রথম পছন্দ। যে পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে আব্রামোভিচের নজর পড়ে ইংল্যান্ডে।
নিজে ইহুদি, সে সূত্রে ইহুদি ফুটবল এজেন্ট পিনি জাহাভির সঙ্গে গলায়–গলায় দোস্তি বহু আগে থেকে। এই জাহাভিই কেনার জন্য আব্রামোভিচকে বেশ কয়েকটা ক্লাবের নাম প্রস্তাব করেন। যে তালিকায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে শুরু করে পোর্টসমাউথ, আর্সেনাল, টটেনহাম—এমন অনেক ক্লাবই ছিল। আর্সেনাল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মালিকানা বদলে আগ্রহী হয়নি। ওদিকে পোর্টসমাউথ আর টটেনহাম কেনার ব্যাপারে আব্রামোভিচের নিজের মনই সায় দেয়নি। টটেনহাম ক্লাবটা লন্ডনের যে অঞ্চলে, সেটাই পছন্দ হয়নি আব্রামোভিচের।
সব দিক বিবেচনা করে দেখা গেল, চেলসিই আব্রামোভিচের জন্য একদম উপযুক্ত। লন্ডনের অভিজাত এলাকার ক্লাব, অর্থসংকটে আছে, তাই মোটামুটি কম দামে পাওয়া যাবে। ১৫ মিনিটের আলোচনায় তৎকালীন মালিক কেনেথ বেটসের কাছ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নেন চেলসিকে।
কিছুদিন আগেই ইউনাইটেডের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদোর হ্যাটট্রিক দেখে আসা আব্রামোভিচ এবার নজর দিলেন নিজের ক্লাবে বর্তমান ও আগামীর রোনালদোদের আনার ব্যাপারে। শুরু হলো টাকার মচ্ছব, যা এর আগে ব্রিটিশ ফুটবল দেখেনি কখনো।
প্রতিদিন কেউ না কেউ স্টামফোর্ড ব্রিজে আসতে লাগলেন। ওয়েস্ট হামের ইংলিশ রাইটব্যাক গ্লেন জনসন ও মিডফিল্ডার জো কোল; রিয়াল মাদ্রিদের ক্যামেরুনিয়ান মিডফিল্ডার জেরেমি ও ফরাসি মিডফিল্ডার ক্লদ ম্যাকেলেলে; সাউদাম্পটনের ইংলিশ লেফট ব্যাক ওয়েইন ব্রিজ; ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের আইরিশ উইঙ্গার ড্যামিয়েন ডাফ; পারমার রোমানিয়ান স্ট্রাইকার আদ্রিয়ান মুতু; ইন্টারের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার এর্নান ক্রেসপো; চার্লটনের ইংলিশ মিডফিল্ডার স্কট পার্কারকে দেখা গেল চেলসির জার্সি ধরে পোজ দিচ্ছেন।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও রুশ অর্থের ভাগ পেল। ওল্ড ট্রাফোর্ড থেকে প্রধান নির্বাহী পিটার কেনিওনকে উড়িয়ে আনা হলো, কেনিওনের পিছু পিছু এলেন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন। ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকেও আনতে চেয়েছিলেন আব্রামোভিচ, ফার্গুসন নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে আসতে চাননি বলে যা শেষ পর্যন্ত পারেননি।
সব মিলিয়ে আব্রামোভিচের অধীন প্রথম মৌসুমে খেলোয়াড় বাবদ চেলসির খরচ হলো প্রায় সাড়ে ১২ কোটি পাউন্ডের মতো। সে মৌসুমে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের একজন যে পর্তুগাল ছেড়ে ইংল্যান্ডে এলেন, চেলসির হাঁকডাকে সেটা পর্যন্ত চাপা পড়ে গেল।
ফার্গুসনের চেলসিতে না আসার সিদ্ধান্তই দুয়ার খুলে দিল জোসে মরিনিওর। মাত্রই এফসি পোর্তোকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো তরুণ এই কোচ চেলসিতে এসেই নিজেকে ঘোষণা করলেন ‘স্পেশাল ওয়ান’ বলে। পরের মৌসুমে আব্রামোভিচের অর্থের সঙ্গে যুক্ত হলো মরিনিওর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। পাওলো ফেরেইরা, পিওতর চেক, আরিয়ান রোবেন, মাতেজা কেজমান, দিদিয়ের দ্রগবা, তিয়াগো মেন্দেস, রিকার্দো কারভালিও শক্তি বাড়ালেন চেলসির। ফলাফল? মৌসুম শেষে চেলসিতে এল পরম আরাধ্য লিগ শিরোপা, যে শিরোপার জন্য পাঁচ দশক ধরে হাপিত্যেশ করছিল দলটা।
এমন লিগ-সাফল্য পরের ১৭ বছরে আরও চারবার উপভোগ করতে পেরেছে চেলসি। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে দুবার। এফএ কাপ, লিগ কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ—এসবের হিসাব না হয় বাদই থাক। এত সাফল্যের পরও আব্রামোভিচের ১৯ বছরের রাজত্বে কোনো সাংবাদিকের সাধ্য হয়নি রুশ ধনকুবেরের ‘এক্সক্লুসিভ’ কোনো সাক্ষাৎকার নেওয়ার। হবে কী করে, ওই যে, আজীবন যে আড়ালেই থাকতে চেয়েছেন!
অনেকের মতে, আব্রামোভিচের চুপচাপ থাকার পেছনে প্রভাব ফেলেছে তাঁর কষ্টকর শৈশব। এক বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন, চার বছর বয়সে বাবাকে। এরপর চাচা, দাদি যে-ই তাঁর দায়িত্ব নিয়েছেন, কারও বাড়িতেই দীর্ঘদিন থাকতে পারেননি। মা–বাবাহীন জীবন যে কতটা কঠিন, তখনই বোঝা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। হয়তো এটাও বুঝে গিয়েছিলেন, কঠিন এ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নিজেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
১৮ বছর বয়সে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। উদ্যোক্তা হওয়ার গুণাবলি যে তাঁর মধ্যে বেশ ভালোই আছে, সেটা বোঝা গেল ওখানে থাকার সময়টাতেই। সে সময়ে আব্রামোভিচের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, নিকোলাই পান্তেলেইমোনোভ তাঁদের একজন। বহু বছর পর এই পান্তেলেইমানোভ রুশ পত্রিকা ঝিজনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান তরুণ আব্রামোভিচের ‘উদ্যোক্তা’ হয়ে ওঠার গল্প।
সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো থেকে ড্রাইভারদের মাধ্যমে তেল বের করে আনতেন, সে তেল কম দামে বিক্রি করতেন অন্য ড্রাইভারের কাছে। এভাবে খুব অল্প সময়েই টাকাপয়সার মুখ দেখা শুরু করলেন আব্রামোভিচ। প্রথম স্ত্রী ওলগা লিসোভার মা–বাবার কাছ থেকে বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া অর্থ দিয়ে প্লাস্টিকের খেলনা কিনে বিক্রি করতেও শুরু করেন। ঝানু ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার শুরু সেখান থেকেই।
চুপচাপ থাকলে কী হবে, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারতেন বেশ। সে সূত্রেই পরিচয় বরিস বেরেজোভস্কির সঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ভেঙে গেছে, বরিস ইয়েলৎসিনের নবগঠিত সরকারের আদেশে রাষ্ট্রের অধীন থাকা সব সম্পদ তখন ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাচ্ছে। রাশিয়ার যেসব ব্যবসায়ী এই নিয়মের সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটেছেন, আব্রামোভিচ-বেরেজোভস্কি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
৩০০ কোটি ডলার মূল্যের সোভিয়েতের বিখ্যাত তেল কোম্পানি সিবনেফটকে মাত্র ২০ কোটি ডলারে কিনে নেন এই দুজন। পরে ২০০৫ সালে নিজের ভাগের শেয়ার সরকারের কাছে আবার বিক্রি করে দেন ১ হাজার ২০ কোটি ডলারের বিনিময়ে। আব্রামোভিচের ব্যবসায়িক মস্তিষ্কের ধারণা একটু হলেও পাচ্ছেন তো?
শুধু কি তেল? ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, খনিজ দ্রব্য থেকে শুরু করে বিনিয়োগ কোম্পানি—একে একে সব জায়গায় নিজের ছাপ রেখেছেন আব্রামোভিচ। আর এর পেছনে তাঁকে সাহায্য করেছেন দুই রুশ প্রেসিডেন্ট। প্রথমে বরিস ইয়েলৎসিন, পরে ভ্লাদিমির পুতিন। ইয়েলৎসিন যখন ক্ষমতা ছাড়েন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্রামোভিচই প্রস্তাব করেছিলেন পুতিনের নাম। পুতিন-আব্রামোভিচের বন্ধুত্ব এতটাই গভীর। তাই বলে আব্রামোভিচ নিজেও হয়তো কখনো ভাবেননি, এই বন্ধুত্বের কারণেই নিজের অন্যতম ভালোবাসার জায়গা চেলসিকে হারাতে হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচ পুতিনের ‘কাছের লোক’ হওয়ায় তাঁর সম্পদ জব্দ করাও এর একটি। এমনটা হতে পারে জেনে তাঁর আগেই অবশ্য চেলসির মালিকানা থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন আব্রামোভিচ।
কিন্তু যতই সরে আসুন না কেন, ইংলিশ ফুটবল বদলে দেওয়ার পেছনে এই মানুষের অবদান স্বীকার না করে উপায় নেই। একজন আব্রামোভিচ ছিলেন দেখেই ইংলিশ ফুটবলে টাকা ঢালার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবের ধনকুবেররা। আর তাঁদের আগমনে শুধু চেলসিই নয়, প্রতিটা ক্লাবেই এসেছে নামকরা সব খেলোয়াড়।
মাঠের ভেতরে তো বটেই, মাঠের বাইরেও ইংলিশ লিগের জৌলুশ বেড়েছে বহুগুণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ক্রমে দুর্বল হতে থাকা লিভারপুল-আর্সেনাল যখন মাঠের খেলায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে পেরে উঠছিল না, আব্রামোভিচের চেলসিই তখন লিগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলে। চেলসির দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে এসেছে ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি কিংবা হালের নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মতো ক্লাবগুলো।
আর কিছু না হোক, অন্তত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য, জৌলুশ বাড়ানোর জন্য রোমান আব্রামোভিচ একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন!