প্রথম ম্যাচের ৫০ বছর

আবাহনীর গৌরবযাত্রার প্রথম দিন

১৯৭২ সালের ১১ জুন। ঢাকা লিগে প্রথম ম্যাচ খেলেছিল নবাগত আবাহনী ক্রীড়া চক্র। বিআইডিসির সঙ্গে সেই ম্যাচের এই ছবি পরদিন ছাপা হয় তৎকালীন দৈনিক বাংলায়।
১৯৭২ সালের ১১ জুন। ঢাকা লিগে প্রথম ম্যাচ খেলেছিল নবাগত আবাহনী ক্রীড়া চক্র। বিআইডিসির সঙ্গে সেই ম্যাচের এই ছবি পরদিন ছাপা হয় তৎকালীন দৈনিক বাংলায়।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিপুল স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল আবাহনী ক্রীড়া চক্র। কালের স্রোতে ভেসে ক্লাবটির ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। শেখ কামালের হাত ধরে আবাহনীর প্রতিষ্ঠা ঠিক কত তারিখে, এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ১৯৭২ সালের ১১ জুন তৎকালীন আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রথম মাঠে নামে ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে। সেই ম্যাচের আজ ৫০ বছর পূর্ণ হলো।

এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব কাভার করতে কুয়ালালামপুর আসার আগে আবাহনীর সেই প্রথম ম্যাচ নিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় গোলাম সারোয়ার টিপু ও শেখ আশরাফ আলীর সঙ্গে। দুজনই আবাহনীর জার্সিতে খেলেছিলেন প্রথম ম্যাচটি। গোলাম সারোয়ার পেছন ফিরে বলেন, ‘একটা স্বপ্ন নিয়ে আবাহনী যাত্রা করেছিল। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তারা আধুনিকতার ছাপ এনেছে। এ অনেক বড় প্রাপ্তি।’

ডিফেন্ডার আশরাফ আলীর স্মৃতিতে দিনটি এখনো জ্বলজ্বলে, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রথম ম্যাচে অন্তত ড্র করা, যাতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সেদিন বিআইডিসির সঙ্গে ড্র করায় সত্যিই অনেক আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল আমাদের।’

সেদিনই তৎকালীন দৈনিক বাংলা স্বাধীনতা-উত্তর দেশের প্রথম ফুটবল লিগের দলগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে এক পাতার বিশেষ আয়োজন প্রকাশ করেছিল। তাতে নবাগত আবাহনী ক্রীড়া চক্র সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘স্থাপিত: ১৯৬৬। জার্সির রং: হালকা নীল। প্রেসিডেন্ট: নাজমুল হক। সেক্রেটারি: হারুনুর রশিদ। ফুটবল সেক্রেটারি: মোহাম্মদ ফারুক। কোচ: কবির। অধিনায়ক: আবদুস সাদেক। সহকারী অধিনায়ক: আলী ইমাম। প্রথম বিভাগ খেলছে: ১৯৭২ সাল থেকে। ১৯৭০ সালে লিগ পজিশন: ইকবাল স্পোর্টিং নামে দ্বিতীয় বিভাগ লিগ বিজয়ী। খেলার পদ্ধতি: ৪-২-৪ বা ৩-২-৫।’

সেবার (১৯৭২) আবাহনীর গোলে ছিলেন আবুল কাশেম, মুসলিম, জুবায়ের। ব্যাক: সাদেক, শেখ জামালুদ্দীন, হাশেমুদ্দিন, ফারুক, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, মোজাম্মেল কাদের, আনোয়ার। হাফ: মহসিন, কিউ এম রফিক (দিপু), শেখ আশরাফ আলী, বেলাল হোসেন, আলী ইমাম। ফরোয়ার্ড: রণজিৎ কুমার সাহা, গফুর ভূঁইয়া, শেখ ফরিদ, কাজী আবু সিদ্দিক (ভোলা), গোলাম সারোয়ার টিপু, সালাউদ্দিন, মোহাম্মদ হোসেন (নইম), আবদুল কাদের, মাসুদ হাসান (দিলু)।

রক্ষণ ও আক্রমণভাগ মিলিয়ে আবাহনীর শক্তি সেরা যেকোনো দলের চেয়ে কম ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম সারির কয়েকজন ফুটবলার ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় ছিলেন দলটিতে। লিগ বিজয়ী না হোক, সেরা কয়েকটা দলের বিপক্ষে ভালো ফল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু সেই লিগ মাঝপথে পন্ড হয়ে যায়।

এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

লিগের প্রথম দিনেই নবাগত আবাহনী মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৭০ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন তৎকালীন ইপিআইডিসি, স্বাধীনতার পর যা হয়েছিল বিআইডিসি। প্রথম দিনেই মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়ে তারা। কেমন হয়েছিল ম্যাচটি? পরদিন ১২ জুন ১৯৭২, দৈনিক বাংলার ম্যাচ রিপোর্টে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।

যার শিরোনাম ছিল, ‘উদ্বোধনী দিনের নিষ্প্রাণ খেলায় কোনো গোল হয়নি।’ তাতে লেখা হয়, ‘নবাগত আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রথম দিনেই একটি পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়েছে। গতকাল রোববার ঢাকা স্টেডিয়ামে বেলা পাঁচটায় ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ খেলার উদ্বোধন হয়। খেলায় নবাগত আবাহনীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ১৯৭০ সালে লিগ বিজয়ী শক্তিশালী বিআইডিসি স্পোর্টস ক্লাব। খেলার গোলশূন্য অমীমাংসিত ফলাফল এবং খেলার নিষ্প্রাণ, উদ্দেশ্যহীন ও উত্তেজনাবিহীন ধারা ছুটির দিনের বিরাট দর্শককে বিপুলভাবে হতাশ করে।’

আবাহনীর খেলোয়াড়েরা হালকা নীল রঙের মোজা, প্যান্ট ও জার্সি পরে ৩-৩-৪ পদ্ধতিতে খেলা শুরু করেন। বিআইডিসির পদ্ধতি ছিল ৪-২-৪। তবে দুই দলের এক জায়গায় মিল দেখা গিয়েছিল। এটা হচ্ছে, দুই দলের হাফের খেলোয়াড়েরা তাঁদের ফরোয়ার্ডদের নিপুণভাবে খেলাতে ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন দলের জন্য সুন্দর পরিকল্পনায় আক্রমণের ধারা রচনা করতে।

খেলার অধিকাংশ সময় বল মাঝমাঠে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এতে বিআইডিসি দল প্রচ্ছন্ন প্রাধান্য বিস্তার করলেও কার্যকর কিছু করতে পারেনি। আবাহনীর গোলকিপার ছাড়া সারা খেলায় মোট ২৩ জন (পরে ১ জন) উল্লেখযোগ্য কোনো খেলা দেখাতে পারেননি। দুই দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যবিহীন ও পরিকল্পনাহীন খেলায় গোল করার আলতো কয়েকটি সুযোগ এসেছিল। বিআইডিসির এনায়েত ও ফারুক বা আবাহনীর অমলেশ ও গফুর কেউ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। মাঝে সত্যিকারের কোনো সুযোগ ছাড়াই দূর থেকে আবাহনীর দিপু কামানের গোলার মতো প্রচণ্ড শট করে বারপোস্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। খেলার সময়ের মেঘাচ্ছন্ন মাঠের মতো নিষ্প্রাণ ও উত্তেজনাহীন এ খেলায় এটাই ছিল সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্য।

ম্যাচের আগে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ বীর ও খেলোয়াড়দের স্মৃতির উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালিত হয় এবং আবাহনী দলের খেলোয়াড়েরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের খেলোয়াড়দের মাল্যভূষিত করেন।

আবাহনী ক্রীড়া চক্র: কাশেম, দিপু, আশরাফ ও সাদেক, বেলাল, আলী ইমাম, বাদশা, কাদের (অমলেশ), সালাউদ্দিন, গফুর ও টিপু। বিআইডিসি: ননী, ফারুক, নাজির, জহুর, হাকিম, সলিমুল্লাহ, আনোয়ার, শাহজাহান, মালা, এনায়েত ও গাজী। রেফারি: জেড আলম।

আবাহনীর প্রথম সেই দলের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু এক গৌরবময় যাত্রার সঙ্গে তাঁদের নামটিও থাকবে চিরকাল।