প্রথমবারেই চমক দেখিয়েছে জার্মানি।
প্রথমবারেই চমক দেখিয়েছে জার্মানি।

অভিষেকেই অপ্রতিরোধ্য বেকেনবাওয়ার-মুলারের জার্মানি

যে সময়ে হওয়ার কথা, করোনা সেই সময়ে ইউরো হতে দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে, করোনা তখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। তাতে কী! করোনার ভয়ে তো সব বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। আগামী ১১ জুন থেকে তাই মাঠে গড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতীয় দলগুলোর সবচেয়ে মর্যাদার আসর। তবে আনুষ্ঠানিক নামটা থাকছে আগের মতোই—ইউরো ২০২০। আরও একবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে ওঠার আগে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে ফিরে দেখা যাক আগের আসরগুলো।

জার্মানির সোনালি প্রজন্ম

গেরহার্ড ‘গার্ড’ মুলারের ক্যারিয়ারের সেরা বছরে ইউরো হবে, আর সেখান থেকে জার্মানি খালি হাতে ফিরে যাবে, তা হয় নাকি!

বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে এক মৌসুমে ৪০ গোলের রেকর্ড গড়ে জার্মানির হয়ে সেবার ইউরো খেলতে গিয়েছিলেন মুলার। যে রেকর্ড ৪৯ বছর পর অবশেষে এই মৌসুমে ভেঙেছেন বায়ার্নেরই পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কি। বায়ার্নে তখন সোনালি প্রজন্মের যুগ শুরু হয়েছে। ইউরোর জার্মানি দলেও সেই বায়ার্নেরই দাপট। মুলার তো ছিলেনই, ছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, সেপ মায়ার, পল ব্রেইটনার, উলি হোয়েনেস, হান্স-গিওর্গ সোয়ার্জেনবেকের মতো কিংবদন্তিরা।

পরে যাঁরা বায়ার্নের হয়ে জিতেছেন টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, জার্মানির হয়ে ১৯৭৪ বিশ্বকাপও। জার্মানির ইতিহাসের সেরা সেই দলের বিপক্ষে ১৯৭২ ইউরোর ফাইনালেও দাঁড়াতে পারেনি রাশিয়া। তখন অবশ্য দুই দেশ খেলেছিল পশ্চিম জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামেই।

ফাইনালে জোড়া গোল করেছেন মুলার।

ঠিক এর আগের মাসেই রাশিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে জার্মানির ৪-১ গোলের জয়ে চারটি গোলই করেছিলেন গার্ড মুলার। ফাইনালে সেই মুলারকে থামানোর সব চেষ্টাই করেছিল রাশিয়া। শেষ পর্যন্ত তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। উল্টো বেকেনবাওয়ার-মুলার-ব্রেইটনার-হোয়েনেসদের সামনে রাশিয়াকে মনে হচ্ছিল একেবারেই সাদামাটা এক দল। ইউরোর ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে একতরফা ফাইনাল খেলে জার্মানি জেতে ৩-০ গোলে। মুলারের জোড়া গোলের মাঝে একটা গোল করেন মনশেনগ্লাডবাখের মিডফিল্ডার হার্বার্ট ভিমার।

পরে সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মুলার বলেছেন, ‘ফাইনালে রাশিয়াকে নিয়ে আমরা আসলে একটুও চিন্তিত ছিলাম না। মাসখানেক আগেই ওদের হারিয়েছিলাম। জানতাম, ওরা কীভাবে খেলবে, কে কাকে মার্ক করবে। জানতাম, আমরাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছি।’

সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ২-১ গোলে হেরেছিল স্বাগতিক বেলজিয়াম। ওই দলের ফরোয়ার্ড পল ভ্যান হিমসৎ পরে বলেছিলেন, ‘বেকেনবাওয়ার, মুলার, গুন্টার নেৎসার ও গোলবারের নিচে সেপ মায়ার। ওটাই আমার দেখা সেরা জার্মানি। ওই দলকে তখন হারানো অসম্ভবই ছিল।’

জার্মানি সেই অসম্ভব কিছু হতে দেয়নি ১৯৭২ ইউরোতে।

মুলার ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে।

একনজরে ইউরো ১৯৭২

স্বাগতিক: বেলজিয়াম
ফাইনালের ভেন্যু: হেইসেল স্টেডিয়াম, ব্রাসেলস
চ্যাম্পিয়ন: জার্মানি (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি)
রানার্সআপ: রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)
তৃতীয়: বেলজিয়াম
চতুর্থ: হাঙ্গেরি

জার্মানি সেবারই প্রথম সুযোগ পেয়েছিল চূড়ান্ত পর্বে, তৃতীয় হওয়া বেলজিয়ামও। দুই বছরমেয়াদি বাছাইপর্বটা ছিল ১৯৬৮ ইউরোর মতোই। ৮ গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলেছে ৩২ দল। তারপর গ্রুপ–সেরা দলগুলোকে নিয়ে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে দুই লেগের কোয়ার্টার ফাইনাল। চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়েছিল সেমিফাইনাল থেকে। শেষ চারের দলগুলো নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ঠিক করা হয় টুর্নামেন্টের স্বাগতিক হবে বেলজিয়াম। সেমিফাইনালে রাশিয়া ১-০ গোলে হারায় হাঙ্গেরিকে, বেলজিয়ামের বিপক্ষে জার্মানির জয় ২-১ গোলে। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতে বেলজিয়াম।

আরও যত গল্প

মেসি বায়ার্নে কেন খেলেন না
টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচ ও ফাইনাল মিলিয়ে ৪ গোল গার্ড মুলারের। এর আগে বাছাইপর্বে করেছিলেন ৭ গোল। মুলারের আসলেই তখন অপ্রতিরোধ্য ফর্ম। বায়ার্নের হয়ে এক মৌসুমে ৪০ গোলের রেকর্ড করে আসা মুলার ১৯৭২ সালে ক্লাব ও দেশের হয়ে মোট ৮৫ গোল করেন। যেটা এক পঞ্জিকাবর্ষে কোনো খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড হয়ে ছিল ২০১২ সাল পর্যন্ত। ৪০ বছর পর বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার হয়ে এক বছরে ৯১ গোল করে লিওনেল মেসি ভেঙে দেন সেই রেকর্ড। সেই সময় মুলার বলেছিলেন, ‘ছেলেটার (মেসি) সবই ভালো, শুধু একটাই সমস্যা, সে বায়ার্নে খেলে না।’

ভ্যান হিমসৎ (সাদা জার্সি)।

ইউরো থেকে অভিনয়ে

সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে গেলেও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে জিতেছিল বেলজিয়াম। ওই ম্যাচে বেলজিয়ামের হয়ে একটা গোল করেছিলেন ফরোয়ার্ড পল ভ্যান হিমসৎ। ৯ বছর পরে ভ্যান হিমসৎ যখন অবসরে, তখন তিনি অভিনয় করেন জন হিউস্টন পরিচালিত ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ নামে বিখ্যাত এক ছবিতে। যেখানে ভ্যান হিমসতের সঙ্গে অভিনয় করেন পেলে, ববি মুর, ওসি আরদিলেসের মতো বিখ্যাত ফুটবলাররা।

অপ্রতিরোধ্য জার্মানি

১৯৭২ ইউরোর ফাইনালে রাশিয়ার বিপক্ষে জয় দিয়েই শুরু হয়েছিল জার্মানির এক অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। এরপর ১৯৯৬ পর্যন্ত ইউরো ও বিশ্বকাপ মিলিয়ে ১৩টি টুর্নামেন্টের ৯টিতে ফাইনাল খেলেছে জার্মানি। জিতেছে ১৯৭৪ ও ১৯৯০ বিশ্বকাপ এবং ১৯৮০ ও ১৯৯৬ ইউরোর ট্রফি।