অকুতোভয় আয়াক্স কি পারবে সোনালি দিন ফেরাতে?

চমকে দিচ্ছে আয়াক্স। ছবি : এএফপি
চমকে দিচ্ছে আয়াক্স। ছবি : এএফপি
>সবার প্রত্যাশা ছাড়িয়ে এবার চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে উঠেছে আয়াক্স। একঝাঁক তরুণের হার না–মানা মানসিকতাকে পুঁজি করে একের পর এক বাধা পেরোনো আয়াক্স সেমিতে কোন কৌশলে খেলবে? টটেনহামকে আদৌ আটকাতে পারবে তো?

‘কখনো টাকার বস্তাকে গোল করতে দেখেছ?’

ডাচ্‌ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফের করা প্রশ্নটি ছোট, কিন্তু গভীরতা ব্যাপক। ইউরোপের দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের—বার্সেলোনা ও আয়াক্স আমস্টারডাম—মেরুদণ্ড গড়ে দিয়েছিলেন ক্রুইফ। টাকা দিয়ে নামীদামি খেলোয়াড় কেনা গেলেও মাঠের লড়াইয়ে রক্ত–মাংসের ১১ জন মানুষের বিরুদ্ধে রক্ত–মাংসের ১১ জন মানুষই নামে, কোনো টাকার বস্তা নয়। মাঠের লড়াইয়ে অকুতোভয় হয়ে খেললে কোন ক্লাব কত বড়, কার দাম কত বেশি, এসবের কোনো মূল্য থাকে না।

আয়াক্সের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তির কথাটা আপ্তবাক্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন এরিক টেন হাগ।

কে এই টেন হাগ? হল্যান্ডের এই ভদ্রলোক এখন দেশটির সবচেয়ে সফল ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডামের কোচের দায়িত্বে আছেন। ক্লাবটির একগাদা পুঁচকে ছেলের মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন ক্রুইফের কথাটা। ফলও পাচ্ছেন হাতেনাতে। হল্যান্ডের ঘরোয়া লিগে অখ্যাত এক্সেলসিওর থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়নস লিগের কুলীন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ-জুভেন্টাস-বায়ার্ন মিউনিখ, সবার বিপক্ষেই আয়াক্সের ছেলেরা খেলছে একই উদ্যমে, জয়ের একই স্পৃহায়। বাঘা বাঘা ক্লাবের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে তাদের দিকে আঙুল তুলে শাসানো আয়াক্সের সাহস দেখে চমকে যাচ্ছে ফুটবলবিশ্বও।

আয়াক্স এবার জায়গা করে নিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে। এমন ভয়ডরহীনভাবে ফুটবল খেলেই সত্তরের দশকে যে আয়াক্স শাসন করত ফুটবল বিশ্ব, এরিক টেন হাগের ছোঁয়ায় সেই আয়াক্সের যেন পুনর্জাগরণ ঘটছে! দলটির সম্ভাবনাময় তরুণেরা জানাচ্ছে, তাদের ধমনিতেও বইছে রাজার রক্ত।

টেন হাগের হাত ধরেই হচ্ছে আয়াক্স-বিপ্লব। ছবি : এএফপি

দুটি ছোট্ট উদাহরণ দিই।

চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলোর প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ২-১ গোলে হেরেছিল আয়াক্স। পরের রাউন্ডে উঠতে হলে ফিরতি লেগটাই ছিল আয়াক্সের জন্য শেষ সুযোগ। আর এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর উন্মাতাল প্রতিপক্ষ দর্শক-সমর্থকদের সামনে। আর ফিরতি লেগের সেই ম্যাচে আয়াক্স কী করল, মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং আক্ষরিক অর্থেই রিয়ালের ব্যালন ডি’অরজয়ী তারকা লুকা মদরিচকে মাঠে চরকির মতো ঘোরালেন। পাশে যে মদরিচের মতো বিশ্বমানের একজন মিডফিল্ডার আছেন, ডি ইয়ংয়ের খেলা দেখে মনে হয়নি। সুন্দর মতো মদরিচকে পাত্তা না দিয়ে একের পর এক পাসের ফুলঝুরি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন ডি ইয়ং।

কিংবা দুসান তাদিচের কথা ভাবুন। ম্যাচের দ্বিতীয় গোলে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ডেভিড নেরেসকে সহায়তা করার আগে মিডফিল্ড থেকে যেভাবে বল টেনে কাসেমিরোকে ঘোল খাওয়ালেন, কাসেমিরো সেই লজ্জায় ‘ধরণি দ্বিধা হও, আমি প্রবেশ করি’ বলে ওঠেননি, সেটাই অনেক বেশি!

নতুন দিনের আয়াক্স এমনই। কোনো ভয়ডর নেই। কার বিরুদ্ধে খেলছে না খেলছে, এই নিয়ে ভাবনা সামান্যই। বরং কীভাবে খেলছে, ও ক্লাবের মূলমন্ত্র অনুযায়ী খেলতে পারছে কি না, সেটাই তাদের জন্য বড় কথা।

আয়াক্সের এই পুনর্জাগরণের শুরু দুই বছর আগে। কোচ পিটার বশচের হাত ধরে ইউরোপা লিগের ফাইনালে উঠেছিল দলটি। পুরো টুর্নামেন্টে চোখধাঁধানো ফুটবল খেলা আয়াক্স সেবার ফাইনালে হোসে মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারাতে পারেনি। পিটার বশচের কাছ থেকে মার্সেল কাইজার ও মাইকেল রেইজিগারের হাত ঘুরে আয়াক্সের দায়িত্ব পান টেন হাগ। 

ইউরোপা লিগের ফাইনালে সেবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে পারেনি আয়াক্স। ছবি : টুইটার

বশচ থেকে টেন হাগ, এই যাত্রাপথে আয়াক্স হারিয়েছে বেশ কিছু খেলোয়াড়কে। রক্ষণভাগের ৭৫ ভাগ এই দুই বছরে বদলে গেছে। ইউরোপার সেই ফাইনালে রাইটব্যাক হিসেবে খেলা ডাচ সেন্টারব্যাক জোয়েল ভেল্টম্যান এখন আর মূল একাদশের অংশ নন। তাঁর জায়গায় অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক মরক্কোর রাইটব্যাক নওসির মাজরাউইকে একাডেমি থেকে তুলে এনেছেন টেন হাগ। ৪২ মিলিয়ন পাউন্ডে কলম্বিয়ার সেন্টারব্যাক ডেভিনসন সানচেজকে টটেনহামের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আনা হয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ না করতে পারা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক লেফটব্যাক ডেলেই ব্লিন্ডকে, ১৪ মিলিয়ন পাউন্ডে।

লেফটব্যাক জাইরো রাইডেওয়াল্ডকে ৮ মিলিয়ন পাউন্ডে পাঠানো হয়েছে ক্রিস্টাল প্যালেসে। তাঁর অর্ধেক দামে আর্জেন্টিনার ইন্দিপেন্দিয়েন্তে থেকে এসেছেন লেফটব্যাক নিকোলাস তাগলিয়াফিকো। রক্ষণভাগে শুধু একজনকে পাল্টানো হয়নি। তিনি ম্যাথিস ডি লিট। আয়াক্স একাডেমির এই রত্ন মাত্র ১৯ বছর বয়সে এখন ক্লাবের অধিনায়ক।

ডেনমার্কের লাসে শোনে ছাড়া বাকি দুজনকেও বদলানো হয়েছে। মাত্র এক ইউরোর বিনিময়ে আয়াক্সে আসা ডি ইয়ং এই দুই বছরে এতটাই ভালো খেলেছেন যে, গত জানুয়ারিতে ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে বার্সেলোনা তাঁকে কিনে নিয়েছে। সামনের মৌসুম থেকে বার্সেলোনায় খেলবেন ডি ইয়ং। একডেমি থেকে তুলে আনা হয়েছে আরেক ডাচ মিডফিল্ডার ডনি ফন ডে বিক কে।

ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং—এই তরুণ প্রতিভাকে সার্জিও বুসকেটসের উত্তরসূরি ভাবছে বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি

ইউরোপার ফাইনালে আক্রমণভাগে খেলা মরক্কোর উইঙ্গার হাকিম জিয়েখ এখনো আছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও পরিশীলিত, আরও ক্ষুরধার। জার্মান উইঙ্গার আমিন ইউনেসকে নাপোলিতে পাঠিয়ে ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে ১০.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে উড়িয়ে আনা হয়েছে ডেভিড নেরেসকে। আরেক ইতালিয়ান ক্লাব রোমার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় উইঙ্গার জাস্টিন ক্লুইভার্টকে।

তবে এই দুই বছরে আয়াক্সের সবচেয়ে চমক জাগানিয়া দলবদল হলো ইংলিশ ক্লাব সাউদাম্পটন থেকে সার্বিয়ান উইঙ্গার দুসান তাদিচকে নিয়ে আসা। তাদিচের প্রতিভা নিয়ে কস্মিনকালেও কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ডাচ্‌ ক্লাব এফসি টুয়েন্টেতে আলো ছড়িয়ে সাউদাম্পটনে যাওয়া তাদিচ গত চার বছরে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন সামান্যই। আর ইংল্যান্ড জায়গাটাও তাদিচের পছন্দ হতো না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে সব সময় কৌশলগত দিককে প্রাধান্য দিয়ে ফুটবল খেলানো হয় না, বরং অনেক ক্লাব শরীরনির্ভর ফুটবলও খেলে। প্রায়ই দেখা যেত একেকটা ম্যাচ শেষে তাদিচ ড্রেসিংরুমে ফিরতেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে, ঊরুতে আইসব্যাগ লাগিয়ে। শেষ দিকে এমন অবস্থা হলো, বরফ জিনিসটাই সহ্য করতে পারতেন না তাদিচ!

তাদিচের এই ত্রাহি দশায় ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হলো আয়াক্স। ডাচ্‌ লিগে কৌশলগত ফুটবলই শেষ কথা। বিশেষ করে আয়াক্সের মতো ক্লাব হলে তো কথাই নেই। তাদিচ চলে এলেন আয়াক্সে। সাউদাম্পটনে যেখানে বাকি ১০ জন খেলোয়াড় তাদিচের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন বল পায়ে জাদুকরি কিছু করার জন্য, আয়াক্সে সে দায়িত্বটা থাকল না। কেননা আয়াক্সের প্রতিটি খেলোয়াড়ই বল পায়ে চূড়ান্ত দক্ষ। ফলে সাউদাম্পটনে খেলা বানিয়ে দেওয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া তাদিচ আয়াক্সে গোল বানিয়ে দেওয়ার থেকে গোল দেওয়ার দিকে বেশি নজর দিলেন। কোচ টেন হাগও সুযোগ বুঝে নিজের দলের ‘ফলস নাইন’ বানিয়ে দিলেন তাদিচকে। অর্থাৎ যিনি প্রথাগত স্ট্রাইকার না হয়েও স্ট্রাইকারের দায়িত্ব পালন করেন, যিনি স্ট্রাইকারের চেয়েও বেশি কিছু।

উইঙ্গার থেকে স্ট্রাইকার হয়ে গেছেন দুসান তাদিচ। ছবি : এএফপি

কাগজে-কলমে তাদিচ স্ট্রাইকার হলেও তাঁর কাজ শুধু এই একটা নয়। বার্সেলোনার লিওনেল মেসি, লিভারপুলের রবার্তো ফিরমিনো বা টটেনহামের সন হিউং মিনের মতো তিনিও নিচে নেমে দলের আক্রমণ তৈরিতে অংশ নেন। আয়াক্স সাধারণত ৪-৩-৩ ছকে খেললেও ক্ষেত্রবিশেষে সেটা প্রায়ই ৪-২-৩-১ হয়ে যায় যেখানে শোনে, ডি ইয়ং ও ডে বিক—এই তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে সবচেয়ে সামনে অবস্থান করেন ডে বিক। আক্রমণ তৈরিতে তাদিচ নেমে আসলে ডে বিক তখন স্ট্রাইকারের জায়গা পূরণ করতে ওপরে উঠে যান।

জুভেন্টাসের বিপক্ষে ডে বিকের গোলটা দেখলেই তাঁর এই ভূমিকা বোঝা যায়। আবার রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ডেভিড নেরেসের গোলটা দেখলে তাদিচের খেলা বানিয়ে দেওয়ার উদাহরণও পাবেন। তাদিচকে মাঝে রেখে দুপাশে খেলেন নেরেস ও জিয়েখ। দুজনের ভূমিকা আলাদা আলাদা। দুজনের মধ্যে নেরেসের গতি ও ড্রিবলিং ক্ষমতা বেশি বলে সে একদম প্রথাগত উইঙ্গার হিসেবে খেলে, বক্সে তাদিচ থাকুক বা ডে বিক—ক্রস দেওয়ার কাজটা তখন নেরেসকে করতে হয়।

ওদিকে জিয়েখ আবার মাঝখানে এসে ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাম পায়ের জোরালো শটে গোল করতে পারেন বলে তাঁর ভূমিকা নেরেসের চেয়ে আলাদা। দুই উইঙ্গারকেই প্রায়ই মাঝখানে চলে আসতে হয়। তখন আক্রমণভাগে কোনার জায়গা থেকে ক্রস দেওয়ার জন্য দুই ফুলব্যাক মাজরাউই ও তাগলিয়াফিকোকে উঠে যেতে হয়। ওপরে উঠবেন কি উঠবেন না, তা নির্ভর করে দুই উইঙ্গার মাঠের মাঝে চলে আসছেন কি না তাঁর ওপর। 

আয়াক্সের ছক মোটামুটি এটাই। প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা অনুযায়ী ৪-৩-৩ ও ৪-২-৩-১ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ছবি : সংগৃহীত

এই কৌশলে আয়াক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ডি লিট ও ডি ইয়ং। সতীর্থদের পায়ে বল থাকুক আর না থাকুক, প্রতিপক্ষের অবস্থান নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আয়াক্স কোচের ব্রহ্মাস্ত্র এ দুজন। প্রতিপক্ষ আক্রমণ করলে ৪-২-৩-১ ছকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা ডি ইয়ং তখন দলের তৃতীয় সেন্টারব্যাক হিসেবে ব্লিন্ড আর ডি লিটের পাশে এসে পড়েন। রক্ষণভাগ থেকে বল নিয়ে ওপরে উঠে আক্রমণ গঠন করার দায়িত্ব থাকে তাঁর ওপর। এ জন্য তিনি আসলে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার না সেন্টারব্যাক, বোঝা দুষ্কর।

ওদিকে ব্লিন্ড আর ডি লিট, আয়াক্সের দুই সেন্টারব্যাকই বল পায়ে যে কোনো পুরোদস্তুর সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মতো দক্ষ। ব্লিন্ড তো আগে মিডফিল্ডারই ছিলেন। যে কারণে বলের দখল যখন আয়াক্সের কাছে থাকে, ডি লিট তখন ডি ইয়ং আর শোনের পাশাপাশি সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হয়ে যান। তখন একমাত্র সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলেন ব্লিন্ড। দলের ছক হয়ে যায় ১-২-৩-৪। ভাবা যায়!

পেপ গার্দিওলা যখন বায়ার্নের কোচ, টেন হাগ তখন গার্দিওলার সহকারী ছিলেন। গার্দিওলার কাছ থেকেই পেয়েছেন আক্রমণাত্মক হওয়ার দীক্ষা। টটেনহামের বিপক্ষে সেমিতেও আয়াক্স এই ছকে, এই কৌশলে খেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০৪-০৫ মৌসুমের পর এই প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম রাউন্ডের বৈতরণি পেরোনো আয়াক্স কি পারবে তরুণদের নিয়ে ফাইনালে উঠতে?

জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আগামী ১ মে পর্যন্ত।