সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের মূল মাঠে তখন খেলা শুরু হয়ে গেছে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মেঘ মাথায় নিয়ে ব্যাটিং করছিলেন তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। স্কোরবোর্ডে কন্ডিশনের ছাপ স্পষ্ট। ৫ ওভারে রান মাত্র ১৭। কোনো বাউন্ডারি নেই। কিন্তু সিলেট স্টেডিয়ামের আউটারের নেটে কন্ডিশনের ভয়ভীতি নেই। রনি তালুকদার সেখানে যা করছিলেন, তাতে ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছিল।
দলের বাইরে থাকা রনি ও আফিফ হোসেনকে নিয়ে আলাদা করে নেট অনুশীলন করাচ্ছিলেন সিডন্স। আফিফ ব্যাটিং করছিলেন থ্রোয়ারের বলে। রনির দায়িত্ব নিলেন সিডন্স নিজেই। ডক স্টিক দিয়ে প্রথম বলেই ছুড়লেন বাউন্সার। রনি একটু চমকে গেলেন। যা দেখে সিডন্স মজাই পেলেন, ‘দেখলে তো, আমি সব সময় শুরু করি বাউন্সার দিয়ে।’ সিডন্সের মুখের হাসিটা নিভে গেল রনির উত্তরে, ‘বাউন্সার না, স্লোয়ার বাউন্সার।’
রনির নেট সেশনের শুরুটা হলো ব্যাটিং কোচের সঙ্গে মজা করে। এরপর যেটি রূপ নেয় দারুণ এক লড়াইয়ে। যে লড়াইয়ে রনিই জিতেছেন বারবার। সিডন্স নতুন কুকাবুরা বলটা ফুল লেংথে ফেলে রনির পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আর রনি করে যাচ্ছিলেন একের পর এক স্ট্রেট ড্রাইভ। মিড অন-মিড অফের দিকে রনির শটগুলো যাচ্ছিল সিডন্সের মাথার আশপাশ দিয়ে।
একবার তো সিডন্সের মাথার খুব কাছ দিয়েই। চমকে উঠে রনির দিকে তাকিয়ে সিডন্স বললেন, ‘এ কী করছ! আমার পরিবার আছে, বাচ্চা আছে, জানো তো!’ রনি ইংরেজিতে একটু কাঁচা। সিডন্সের অস্ট্রেলীয় উচ্চারণে বলা কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারেননি। পরে বুঝেছেন, যাতে সাহায্য করেছে পাশের নেট থেকে আফিফের হাসি।
কাল চট্টগ্রামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি–টোয়েন্টিতেও ঠিক সে রকমই একেকটা স্ট্রেট ড্রাইভ খেলেছেন রনি। আইরিশ পেসার মার্ক এডেয়ারের ফুল লেংথের বলটা উড়িয়ে মেরেছেন লং অফ বাউন্ডারির ওপারে। মাঠের ‘ভি’–তে খেলা সেই শটটার মতো মনে ছাপ রেখে যাওয়া আরও অনেক শট খেলেছেন ৩৮ বলে ৬৭ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে। যেখানে ছিল টাচ ও পাওয়ারের দুর্দান্ত মিশেল। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রনির প্রথম ফিফটিটি আরও স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পাওয়ায়।
অথচ যে স্ট্রেট ড্রাইভ নিয়ে এত কথা, সেই শটের পেছনে একটা অন্য রকম গল্পও আছে। বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ সরোয়ার ইমরানের সঙ্গে ব্যাটিং নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন রনি। এবারের বিপিএলের আগে মূলত টি–টোয়েন্টির ব্যাটিং নিয়ে অনুশীলন করেছেন। তখনই বেরিয়ে আসে একটা সমস্যা। ব্যাটিংয়ের সময় রনির মাথা অফ স্টাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রিকেটের পরিভাষায় যেটিকে বলে ‘হেড ফলিং ওভার’। এর ফলে যা হয়, অফ স্টাম্পের বাইরের বলও লেগের দিকে টেনে খেলার প্রবণতা ছিল রনির ব্যাটিংয়ে।
সমস্যাটা ধরার পর রনির হেড পজিশন ঠিক করার কাজটাও করেছেন সরোয়ার ইমরান। ছোট্ট এই কৌশলগত পরিবর্তনই রনির সোজা ব্যাটের শটগুলোকে এমন কার্যকর করে তুলেছে। প্রথম টি–টোয়েন্টিতে রনির ইনিংসে যে পরিবর্তনটা পরিষ্কার চোখে পড়েছে সরোয়ার ইমরানের।
ও যখন স্টান্স নিত, তখন মাথাটা অফ স্টাম্পের বাইরে থাকত। সে জন্য বেশির ভাগ বল অন সাইডে খেলার একটা প্রবণতা কাজ করত। স্ট্রেট ড্রাইভ কম খেলত। শুধু মাথাটা ঠিক করা হয়েছে, মাঝবরাবর আনা হয়েছে। ব্যালান্সটা ভালো হয়েছে। এখন অন ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ আগের থেকে অনেক ভালো খেলে। বলও এখন বেশি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।সরোয়ার ইমরান
সেটাই বললেন বিস্তারিত, ‘ও যখন স্টান্স নিত, তখন মাথাটা অফ স্টাম্পের বাইরে থাকত। সে জন্য বেশির ভাগ বল অন সাইডে খেলার একটা প্রবণতা কাজ করত। স্ট্রেট ড্রাইভ কম খেলত। শুধু মাথাটা ঠিক করা হয়েছে, মাঝবরাবর আনা হয়েছে। ব্যালান্সটা ভালো হয়েছে। এখন অন ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ আগের থেকে অনেক ভালো খেলে। বলও এখন বেশি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।’
সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের টনিকও ছিল। সরোয়ার ইমরান বিশ্বাস করেন, রনি বাংলাদেশের সেরা তিন ওপেনারদের একজন, ‘সে অনেক আগে থেকেই ভালো ক্রিকেটার। সে বাংলাদেশের সেরা দুই-তিনজন ওপেনারদের একজন। তবে ও নিজে এটা বিশ্বাস করত না। আমি এটা বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সে কাট, পুল, ড্রাইভ খেলতে পারে। হাতে সব শট আছে। ও যেমন স্ট্রোক খেলতে পারে, বাংলাদেশে খুব কম প্লেয়ারের তা খেলার সামর্থ্য আছে। টি-টোয়েন্টির জন্য সে ভালো ক্রিকেটার, কারণ তার পাওয়ার আছে। আস্তে আস্তে নিজের ওপর বিশ্বাস আসার পর ও এখন ভালো করছে।’
কদিন আগে রনিও প্রথম আলোকে এই মানসিকতার পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে আট বছর পর জাতীয় দলের প্রত্যাবর্তনের পর বলেছিলেন, ‘এবার বিপিএলে সম্পূর্ণ আলাদা মানসিকতা ছিল। টুর্নামেন্টের আগে অনুশীলন করার সময় আমার ভাবনাটা ছিল অন্যান্যবারের চেয়ে ভিন্ন। সরোয়ার ইমরান স্যার আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।’
প্রায় আট বছর পর আবার জাতীয় দলে ফেরাও বিপিএলের পারফরম্যান্স দিয়ে। রংপুর রাইডার্সের হয়ে ১৩ ইনিংসে ১২৯ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৪২৫ রান। টুর্নামেন্টে তাঁর চেয়ে বেশি রান করেছেন মাত্র একজনই (নাজমুল হোসেন)। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি দিয়ে ফেরার পর জাকির হাসানের চোটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দলেও জায়গা পেয়ে যান রনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য, রনির এই জায়গায় এসে পৌঁছেছেন ৩২-এ এসে।
দুর্ভাগ্য রনিরও। নিজের সামর্থ্য উপলব্ধি করতে অনেকটা দেরিই হয়ে গেল। যে কারণে তাঁর সাফল্য খেলাপাগল বাবা মনোরঞ্জন তালুকদার দেখে যেতে পারেননি। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগেই চলে গেছেন রনির বাবা।
দুর্ভাগ্য রনিরও। নিজের সামর্থ্য উপলব্ধি করতে অনেকটা দেরিই হয়ে গেল। যে কারণে তাঁর সাফল্য খেলাপাগল বাবা মনোরঞ্জন তালুকদার দেখে যেতে পারেননি। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগেই চলে গেছেন রনির বাবা। মনোরঞ্জন তালুকদারের স্বপ্ন ছিল, তিন ছেলের একজন জাতীয় দলে খেলবে। মেজ ছেলে রনি বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
রনির বড় ভাই রাজীব তালুকদারও ক্রিকেট খেলতেন। রনির ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বড় ভাই রাজীবেরই। তাঁর হাত ধরেই ২০০৫ সালে ধানমন্ডি ক্লাবে প্রয়াত কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীর সংস্পর্শে আসেন রনি। রনির ছোট ভাই জনি তালুকদারও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত।
‘বাবা তোমাকে অনেক মনে পড়ছে। আমি জানি তুমি ওপর থেকে আমাদের দেখছ।’ম্যাচ সেরা হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রনি
দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতার পর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে রনির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রনি লিখেছেন, ‘বাবা তোমাকে অনেক মনে পড়ছে। আমি জানি তুমি ওপর থেকে আমাদের দেখছ।’
শুধু বাবা কেন, এখন রনির কীর্তি দেখছে সারা বাংলাদেশ।