ব্রেন্ডন ম্যাকমুলান—নামটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো দিন ভুলবে বলে মনে হয় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থকেরাও না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ খেলা সংশয়ে পড়ে গিয়েছিল আগেই, স্কটল্যান্ডের এই ২৩ বছর বয়সী অলরাউন্ডার তা চূড়ান্ত করে দিলেন। ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপেই থাকছে না। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ হবে দুইবারের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছাড়া!
ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে গেছে, তারপরও কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগতেই পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছাড়া বিশ্বকাপ! বাছাইপর্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সুপার সিক্স পর্বের তিনটি ম্যাচই ক্যারিবীয়দের জিততে হতো। এরপর তাকিয়ে থাকতে হতো অন্য দলগুলোর দিকে। কিন্তু আজ হারারেতে সুপার সিক্স পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হেরে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেরেছে স্কটল্যান্ডের কাছে, যে স্কটল্যান্ড এর আগে কখনোই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারেনি। সেই হারও ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
স্কটিশ ইতিহাস গড়ার মঞ্চটা তৈরি করেছেন তাদের বোলাররা। ক্যারিবীয়দের ৪৩.৫ ওভারে ১৮১ রানে অলআউট করার পর ব্যাটসম্যানদের শুধু ঝুঁকিহীন ক্রিকেট খেলতে হতো। আর হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠ রান তাড়ার জন্য আদর্শ। সকালের সুইং ও সিম দুপুরে খুঁজে পাওয়া যায় না। নতুন বলটা দেখেশুনে খেললেই কাজটা সহজ হয়ে যায়। হোল্ডার অবশ্য স্কটিশদের শুরুটা সহজ হতে দেননি, ইনিংসের প্রথম বলেই তাঁর শিকার ওপেনার ক্রিস্টোফার ম্যাকব্রিড।
তবে আরেক ওপেনার ম্যাথু ক্রসকে নিয়ে শুরুর ধাক্কাটা সামলে নেন ম্যাকমুলান। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১৭৫ বলে ১২৫ রান যোগ করেন দুজন। দ্রুত রানের তাড়া না থাকায় দুজনই সময় নিয়ে খেলেছেন, অপেক্ষা করেছেন ক্যারিবীয়দের বাজে বোলিংয়ের। সেটি এসেছেও। আলজারি জোসেফের প্রথম স্পেল বাদ দিলে ক্যারিবীয় পেসারদের নিশানা ঠিক ছিল না। এলোমেলো বোলিংয়ের সে সুবিধাটা নিয়েছেন ম্যাকমুলান।
৮৫ বলে ৫০ পূর্ণ করে অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করে আসার চেষ্টায় ছিলেন তিনি। ৩০তম ওভারে শেফার্ডকে লং অন দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট না হলে হয়তো তা-ই হতো। আউট হওয়ার আগে ১০৬ বলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ৬৯ রান করেছেন ম্যাকমুলান। বাকি কাজটা করেছেন ক্রস। জর্জ মানসি ৩৩ বলে ১৮ রান করে আউট হলেও ১০৭ বলে ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলের জয় নিশ্চিত করেন ক্রস।
উল্টোটা হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ে। যেটির শুরুটাই দুঃস্বপ্নের মতো। ম্যাকমুলান ব্যাটিং দিয়ে ক্যারিবীয়ের ভোগানোর আগে দেখিয়েছেন তাঁর বোলিং সামর্থ্য। নিজের প্রথম স্পেলেই তাঁর শিকার জনসন চার্লস, শামার ব্রুকস ও ব্রেন্ডন কিং। ৫.২ ওভারে ২৫ রান তুলতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম তিন ব্যাটসম্যান আউট। এর মধ্যে চার্লস ও ব্রুকস আউট হন শূন্য রানেই।
৫টি চারে ২২ বলে ২২ রান করা কিং ভালো কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন। কিন্তু আউট হওয়ার পর টপ অর্ডারের আর কেউ বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। ইনিংসের সপ্তম ওভারেই ক্রিস সোলের বলে বোল্ড হন কাইল মেয়ার্স (৯ বলে ৫ রান)। পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ রান করেছে ৪৩, যা হারারের সকালের কন্ডিশন বিচারে খারাপ নয়। কিন্তু এই রান তুলতে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলাটাই সর্বনাশ করেছে।
সে বিপদ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সুফিয়ান শরিফ লম্বা হতে দেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক হোপের ইনিংস। ১৩তম ওভারে ১৩ রান কট বিহাইন্ড হন হোপ। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ৫ উইকেটে ৬০। সেখান থেকে ক্যারিবীয় ইনিংস মেরামতের চেষ্টা করেন নিকোলাস পুরান (২১), জেসন হোল্ডার (৪৫) ও রোমারিও শেপার্ড (৩৬)। তবে তা যথেষ্ট ছিল না। হোল্ডার ও শেপার্ডের ৯৬ বলে ৭৭ রানের জুটির সৌজন্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান দেড় শ ছাড়ায়। তবে এরপর জিততে হলে অবিশ্বাস্য বোলিং অথবা খুব বাজে ব্যাটিং হতে হতো। তা আর হয়নি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সুপার সিক্স পর্বটা শুরুই করেছে পিছিয়ে থেকে। কাগুজে সম্ভাবনায় বাছাইপর্বের ফেবারিট দলগুলোর একটি হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করলেও ক্যারিবীয়দের মাঠের পারফরম্যান্স শুরু থেকেই ছিল গড়পড়তা। গ্রুপ পর্বে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সুপার ওভারে হেরেছে শাই হোপের দল। এর আগে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও জিততে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হার।
হারারেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হারের খবরটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল লর্ডসেও। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলায় ধারাভাষ্য দিতে আসা অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের এক চোখ ছিল হারারেতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া নিয়ে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইক আথারটনের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি। আলোচনার ফাঁকে হতাশ হয়েই পন্টিং বললেন, ‘ওরা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) কত দ্রুত কতটা নিচে নেমে এসেছে, ভাবা যায়!’
পন্টিংয়ের মতো একই প্রশ্ন নিশ্চয়ই ক্রিকেট সমর্থকদের মনেও ঘুরপাক খাচ্ছে।