এউইন মরগান হো হো করে হেসে উঠলেন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে স্কাই স্পোর্টসের সঙ্গে কথা বলছিলেন বেন স্টোকস, গলায় ঝোলানো চ্যাম্পিয়ন মেডেলটা। বিশ্বকাপের সঙ্গে স্টোকসের সম্পর্ক, ফাইনালের রান তাড়ার পর এল অধিনায়ক জস বাটলারের প্রসঙ্গ। স্টোকস বললেন, ‘...সে এখন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক’। পাশে দাঁড়ানো মরগানকে ইঙ্গিত করে এরপর যোগ করলেন, ‘সে-ও সুযোগটা পেয়েছিল (বিশ্বকাপ জেতার)। কেউ একজন গুবলেট পাকানোয় হয়নি।’
ইয়ান ওয়ার্ড স্টোকসের কথা শুনে হাসলেন, হাসলেন নাসের হুসেইন। তবে মরগানের হাসিটা হলো সবচেয়ে উচ্চ স্বরের। ২০১৬ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে গুবলেট পাকিয়েছিলেন স্টোকস নিজেই। এরপর ধারাভাষ্যে বলা ইয়ান বিশপের ‘রিমেম্বার দ্য নেম’ ঢুকে গেছে ক্রিকেট-লোকগাথায়। সে ফাইনালটা নিয়ে মরগানের আক্ষেপ আছে। তিনি দলকে আরেকটু সময় দিতে পারতেন, আরেকটু গুছিয়ে অধিনায়কত্বটা করতে পারতেন ম্যাচের অমন মুহূর্তে।
সেটি তখন করতে পারেননি মরগান। করতে পারেননি স্টোকস। সে রাতে চাপে ভেঙে পড়া স্টোকসের ক্যারিয়ারটাই তো বদলে গেছে এরপর।
****
‘আমি শুধু চাই আমার বন্ধু ভালো থাকুক’, স্টোকসকে নিয়ে বলেছিলেন জো রুট।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে স্টোকস তখন অনির্দিষ্টকালের বিরতিতে। রুট তখন টেস্ট অধিনায়ক, স্টোকসের মতো খেলোয়াড়ের না থাকা বড় ধাক্কাই। তবে রুটের তখন খেলোয়াড় স্টোকসের কথা ভাবার সময় নেই, তিনি শুধু চেয়েছিলেন, তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর যাতে কিছু না হয়।
বাবার মৃত্যু, নিজের আঙুলের চোট মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে ক্রিকেট থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতিতে গিয়েছিলেন স্টোকস। ফলে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছিলেন না।
পুরো টুর্নামেন্টে দাপুটে পারফরম্যান্স দেখানো ইংল্যান্ড গুবলেট পাকাল সেমিফাইনালে গিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭তম ওভারে ক্রিস জর্ডান দিলেন ২৩ রান, ড্যারিল মিচেল ম্যাচটা ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন নিউজিল্যান্ডের দিকে। বিদায় নিতে হলো ইংল্যান্ডকে। ২০১৬ সালের দায়মোচনটা হলো না মরগানের ইংল্যান্ডের।
এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে স্টোকস সর্বশেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন ২০২১ সালের মার্চে। এ ইংল্যান্ড দলে স্টোকসের ভূমিকা কী হবে, সেটি নিয়ে ছিল প্রশ্ন। বাটলার তাঁকে বোলিংয়ে ইনিংস ওপেনিংয়ে এনেছেন, স্টোকস তিনে ব্যাটিংয়ে এসেছেন। ফাইনালের আগে ৫ ম্যাচে ৫ উইকেটের পারফরম্যান্সটা আহামরি নয়, তবে বোলিং করেছেন মাত্র ৬.৪০ ইকোনমি রেটে। স্টোকস বোলিংয়ে নিজের ভূমিকাটা পালন করছিলেন।
স্টোকসকে ব্যাটিংয়েও কেন দরকার, সেটি প্রথম দেখা গেল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে। আয়ারল্যান্ডের কাছে হারের পর থেকেই ইংল্যান্ডের প্রতিটি ম্যাচ বাঁচামরার, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও তা–ই ছিল। জিতলে সেমিফাইনাল, হারলে বাদ। জস বাটলার ও অ্যালেক্স হেলসের দারুণ শুরুর পরও ইংল্যান্ড পথ হারাতে শুরু করল। পথ দেখালেন সেই স্টোকস। কেন তাঁকে ইংল্যান্ড দলে এমন কন্ডিশনে এমন টুর্নামেন্টে দরকার—তিনি দেখালেন।
এরপর এল ফাইনাল। টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে সেরা ব্যাটিং লাইনআপের লড়াই। ‘ইমমুভেবল অবজেক্ট’-এর সামনে ‘আনস্টপেবল ফোর্স’। তবে ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডারের পাশে একটা প্রশ্ন ছিল। বাটলার ও অ্যালেক্স হেলস যেভাবে খেলেছেন, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা সেভাবে সুযোগই পাননি চাপের ম্যাচগুলোয় ব্যাটিং করার! লিয়াম লিভিংস্টোন খেলেছিলেন মাত্র ৭২ বল, মঈন আলী খেলেছিলেন ৩৩ বল, তিনে আসা ফিল সল্ট এর আগে কোনো বলই খেলেননি। সেই মিডল অর্ডার ঠিকই পড়ল পরীক্ষায়।
বিশ্বকাপ ফাইনাল, এমসিজি, ইংল্যান্ড চাপে। চারে নামা স্টোকসের জন্য মঞ্চটা আদর্শ।
****
‘বড় মুহূর্ত আসলে তাকে খুঁজে নেয়।’
স্টোকসের জীবনিভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘ফিনিক্স ফ্রম দ্য অ্যাশেজ’-এ তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন রুট। ২০১৯ সালে দুটি বড় মঞ্চে স্টোকস দুই দফা দিয়েছিলেন তাঁর সামর্থ্যের প্রমাণ—ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল, ওই বছরই হেডিংলি টেস্টে। তবে মেলবোর্নে পাকিস্তান পেসাররা অন্য রকমের এক পরীক্ষায় ফেললেন তাঁকে। বল যত পুরোনো হচ্ছিল, ততই ব্যাটিং কঠিন মনে হচ্ছিল স্টোকসের। নাসিম শাহ করলেন উইকেট না পাওয়া সেরা স্পেলগুলোর একটি। অফ স্টাম্পের বাইরের ওই চ্যানেলে বলই লাগাতে পারছিলেন না স্টোকস। ডাগআউটে থাকা অধিনায়ক বাটলার পাশের কাউকে বলেছিলেন, ‘টেস্টেও এভাবে খেললে তো সে নিজেই নিজেকে বাদ দিয়ে দিত!’
অ্যাডিলেডের পর এমসিজি—দুই ভেন্যুতেই প্রতিপক্ষের সমর্থকসংখ্যার কারণে ইংল্যান্ডকে খেলতে হয়েছে ‘অ্যাওয়ে ম্যাচ’। এর আগে সিডনিতেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তেমনই ছিল পরিস্থিতি। সাধারণত ইংল্যান্ডের কোনো সফরে তাদের সঙ্গে সমর্থকদের লম্বা বহরও থাকে, অনেক দেশেই তারা পান ‘হোম’ দলের সমর্থন। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছিল আলাদাই। তবে দর্শকের চাপ, পাকিস্তান পেসারদের আগুন ঠিকই সামলে নিলেন স্টোকস।
****
শুধু ইংল্যান্ড নয়, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া অধিনায়ক মরগান ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে এসে শিরোপা জিতেছিলেন, ফাইনালে স্টোকসের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর। এবারও হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় অধিনায়ক হিসেবেই যেতেন। তবে হুট করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেওয়ার পর মরগান অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন ধারাভাষ্যকার হিসেবে। ফাইনালের পর একেকজন স্কাই স্পোর্টসের সঙ্গে কথা বলতে আসেন, আগে মরগানকে জড়িয়ে ধরেন।
আদিল রশিদ এসে কথা বলার সময় তো সরাসরিই বললেন, ‘আমাকে সে সময় নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’ ক্রিস জর্ডান, বাটলার, স্টোকসরা কথা বলার সময়ও ‘গর্বিত নেতা’ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকেন মরগান। এরপর স্টোকসের ওই কথা শুনে মরগান হাসেন।
এর আগে বা পরে স্টোকসকে নিয়ে বলেন, ‘মিথ্যা বলব না, আমার অধিনায়কত্বের সময় তো একপর্যায়ে গিয়ে (স্টোকস কিছু করবে), সেটা ধরেই বসে থাকতাম যেন। কারণ, সে চাপের মুখে সব সময়ই কিছু না কিছু করবে। সব সময়ই খেলার মধ্যে থাকতে চাইবে। বোলিং চাইবে, বল যেখানে যাবে ফিল্ডিং করতে চাইবে সেখানে। অথবা অনেক চাপের মুহূর্তে সামনে আসতে চাইবে। বেন স্টোকসকে দলে পাওয়া আসলে বিলাসিতা।’
এ টুর্নামেন্টে স্যাম কারেন ডেথ বোলিংয়ে শুধু নয়, বাটলার যখনই চেয়েছেন এগিয়ে এসেছেন। আদিল রশিদ দেখিয়েছেন, কেন এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনার বলা যায় তাঁকে। মার্ক উড গতির ঝড় তুলেছেন, তবে ইংল্যান্ডের এই দলের ‘ডেপথ’ এমন, সেমিফাইনাল-ফাইনালেও উডের অভাব টের পেতে দেননি কারেন-ক্রিস জর্ডানরা। অ্যালেক্স হেলসের গল্পটাও দায়মোচনের, নির্বাসনে হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ পাওয়া সুযোগ কাজে লাগানোর দুর্দান্ত উদাহরণ।
আর আছেন জস বাটলার। শুধু ইংল্যান্ডের সব সময়ের সেরা সীমিত ওভারের ব্যাটসম্যান নন, এ মুহূর্তে বিশ্বেরই অন্যতম সেরা। মরগানের কাছ থেকে পাওয়া অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেছেন, এ টুর্নামেন্টে তাঁর নেতৃত্বও কৌশলগত দিক দিয়ে ছিল দেখার মতো।
তবে স্টোকসকে বাদ দিন, হয়তো ইংল্যান্ডের শিরোপাটাই বাদ দিতে হয়। ৪৯ বলে ৫২ রানের ইনিংসে ৫টি চার ও ১টি ছয়—টি-টোয়েন্টিতে শুধুই সংখ্যার বিচারে হয়তো তেমন কিছুই নয়। স্টোকস নিজেও পরে বললেন, ফাইনালের প্রকৃতিই এমন। যে কাজটা বোলাররা করেছেন, সেটি সবাই ভুলে যায়।
কিন্তু বাটলার বা ম্যাচসেরা স্যাম কারেন যেমন জানেন, তেমনি জানেন রশিদ বা মরগান—স্টোকসের এ ইনিংসটা কী।
****
শাহিন শাহ আফ্রিদির চোট একজন বোলারের স্লট ফাঁকা করে দিল, মঈন আলী ও স্টোকস চড়াও হওয়ার সুযোগটা নিলেন এরপরই। আফ্রিদির অসম্পূর্ণ ওভার করতে আসা ইফতিখার আহমেদের দ্বিতীয় বলটা স্টোকস তুলে মারলেন লং অফে। তবে এরপরই থমকে গেলেন। ক্যাচ হচ্ছে, সেটি যেন নিশ্চিতই তিনি। তবে বলটা পড়ল বাবর আজমের একটু সামনেই।
সে সুযোগটা কাজে লাগালেন দারুণভাবে, ইফতিখারের শেষ ২ বলে মারলেন চারের পর ছয়, যা চাপ ছিল ইংল্যান্ডের ওপর, অনেকটাই উড়ে গেল তাতে। ১৯তম ওভারে ব্যাকফুটে গিয়ে ওয়াসিমকে মারা চারে স্টোকস পেলেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ফিফটি, ক্যারিয়ারের ৪৩তম ম্যাচে এসে।
এক বল পর লেগসাইডে খেললেন, শটটা খেলার পরই গর্জন করে উঠলেন। ২০১৯ সালে হেডিংলিতে প্যাট কামিন্সকে কাট করার পর এমন গর্জন করেছিলেন স্টোকস, যেবার প্রায় একা হাতে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে ঠিক গর্জন করেননি। সুপার ওভারে জফরা আর্চার পার করানোর পর শুয়ে পড়েছিলেন লর্ডসের মাঠে। আর ২০১৬ সালের ওই রাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন।
ওয়াসিমের বলে আজ মেলবোর্নে যে শট খেলে চিৎকার করে উঠলেন স্টোকস, ধারাভাষ্যে তখন নাসের বলছেন, ‘ইটস বেন স্টোকস উইথ দ্য উইনিং রান, হু এলস, ইটস অলওয়েজ বেন স্টোকস।’
বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস, আর কে!