জয়-পরাজয় নিয়ে কোনো সংশয় নেই, শুধুই খেলার জন্য খেলা। এমন টেস্ট বাংলাদেশ অনেক খেলেছে। একটা লম্বা সময় তো এটাই হয়ে ছিল বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচের নিয়মিত চিত্র। খেলা হচ্ছে শুধুই পরাজয়ের ব্যবধান জানতে, কখনোবা চেষ্টা শুধুই ব্যক্তিগত অর্জনে একটু সান্ত্বনা খোঁজার। কখনো তা মিলছে, কখনো না।
যে সিলেটে সর্বশেষ টেস্টেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয়, সেখানেই আবার সেই পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া। চাওয়া-পাওয়া বলতে শুধুই পরাজয়ের ব্যবধান একটু কমানো। শ্রীলঙ্কার বড় জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে গতকাল বিকেলেই। আজ চতুর্থ দিনের খেলা তো হলো শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই—বড় জয় মানে কত বড়?
যে প্রশ্নের উত্তর পেতে যে ৩ ঘণ্টা ৭ মিনিট লাগল, এই টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দুরবস্থা মনে রাখলে এটাকেই মনে হচ্ছে অনেক কিছু! সেই ‘অনেক কিছু’র পরও প্রথমবারের চেয়ে ৬ রান কমেই শেষ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। দুই দলের রানের ব্যবধান ৩২৮। টেস্টে রানের হিসাবে শ্রীলঙ্কার এর চেয়ে বড় জয় আর একটিই।
ঘটনাচক্রে সেটিও বাংলাদেশের বিপক্ষেই। ২০২৪-এর সিলেটের সঙ্গে ২০০৯-এর চট্টগ্রামের একটা মিলও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেই মিলের নাম—জোড়া সেঞ্চুরি। সিলেটে যা করে ফেলেছেন শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান। চট্টগ্রামে অবশ্য একজনই ছিলেন। তবে সেই জোড়া সেঞ্চুরিয়ানের এমনই দাপট ছিল যে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের লড়াইটা হচ্ছে শুধুই তাঁর সঙ্গে।
দুই ইনিংসে তিলকরত্নে দিলশান করেছিলেন ১৬২ ও ১৪৩। যোগ করলে হয় ৩০৫ রান। পুরো বাংলাদেশ দল মিলে দুই ইনিংসে করতে পেরেছিল মাত্র ৬১ রান বেশি। এত বড় বড় দুটি সেঞ্চুরিতেই তৃপ্ত থাকেননি তিলকরত্নে। অফ স্পিনে ১০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস ধসিয়ে দিয়ে দ্রুত সমাপ্তি টেনে দিয়েছিলেন সেই টেস্টের। জোড়া সেঞ্চুরির সঙ্গে ৪ উইকেট—এমন অলরাউন্ড-কীর্তি টেস্ট ক্রিকেট আর দেখেনি।
টেস্ট ক্রিকেট আগে কখনো দেখেনি, এমন একটা কীর্তি সিলেটেও হয়েছে। ৭ বা এর পরে ব্যাটিংয়ে নেমে জোড়া সেঞ্চুরি কামিন্দু মেন্ডিসের আগে কেউ করতে পারেননি। ১৫ বছর আগে সেই চট্টগ্রাম টেস্টে যা করার একাই করেছিলেন তিলকরত্নে দিলশান। আর এখানে তো মনে পড়ে গেছে সেই প্রবাদবাক্য—এক রামে রক্ষা নাই তায় সুগ্রীব দোসর। কামিন্দু মেন্ডিসকে ‘রাম’ বলবেন, না ‘সুগ্রীব’, এই আলোচনা এখানে জরুরি নয়। নাকি তা নিয়ে আলোচনারই দরকার নেই? ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা যেহেতু অধিনায়ক, এখানে ‘রাম’ তো তাঁকেই বলতে হয়। বেশি রান করার পরও যে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা কামিন্দু মেন্ডিসকে না দিয়ে ধনাঞ্জয়াকেই দেওয়া হলো, তার সম্ভাব্য একমাত্র কারণও এটাই।
বাংলাদেশের পুরোনো দিনের টেস্টে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ব্যক্তিগত অর্জনে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টার কথা বলেছিলাম। সেখানেও মিলে যাচ্ছে সিলেটের এই টেস্ট। চতুর্থ দিনে একটা সময় ম্যাচ নিয়ে একমাত্র কৌতূহল বলতে মুমিনুল হক টেস্টে তাঁর ত্রয়োদশ সেঞ্চুরিটা পাবেন কি পাবেন না! দিন শুরু করেছিলেন ৭ রান নিয়ে। নাইটওয়াচম্যান তাইজুল প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং-বীরত্বের পুনরাবৃত্তি করতে না পারার পর মুমিনুলের বলার মতো সঙ্গী বলতে এক মেহেদী হাসান মিরাজ। লাঞ্চের আগেই যাঁর বিদায়ে মুমিনুলের সেঞ্চুরি নিয়ে আলোচনাই হওয়ার কথা নয়। লাঞ্চে গেছেন ৪৬ রান নিয়ে, সঙ্গী শুধু তিন পেস বোলার। সেঞ্চুরির কথা আসে কীভাবে?
এই টেস্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে দু–একটা যা ইতিবাচক দিক আছে, তার একটা হলো টেল এন্ডারদের ব্যাটিং। এতটাই যে শ্রীলঙ্কা দলের ব্যাটিং কোচ তাঁর দলের টেল এন্ডারদের বাংলাদেশের কাছ থেকে তা শিখতে বলেছেন। বলেছিলেন প্রথম ইনিংসে তাইজুল, শরীফুল আর খালেদের ব্যাটিং দেখে। দ্বিতীয় ইনিংসের শরীফুলকে দেখিয়েও যা বলতে পারেন তিনি। মুমিনুলের সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জেগেছিল শরীফুলের কারণেই। কিন্তু টেল এন্ডারদের ধৈর্য তো বালির বাঁধ। যেটি ভেঙে গেল উইকেটে তাঁর ৬৬তম মিনিটে। কাসুন রাজিতার বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে তাই ফিরতি ক্যাচে শরীফুলের বিদায়। পরের বলেই নেই খালেদও। মুমিনুলের রান তখন ৬৯।
উইকেটে শেষ ব্যাটসম্যান নাহিদ রানা। ক্রিকেটের তিনটি স্কিল-সেটের মধ্যে বলতে গেলে যাঁর শুধু বোলিংটাই আছে। মুমিনুলের তা অজানা নয়। বাঁহাতি স্পিনার প্রবাত জয়াসুরিয়ার ওপর চড়াও হওয়াও হয়তো সে কারণেই। পরপর তিন বলে ৬, ৪, ৪ মুমিনুলকে নিয়ে গেল ৮৩ রানে। জয়াসুরিয়ারই পরের ওভারে আরেকটি চারে ৮৭। যদিও ওভারের পঞ্চম বলে ওই চারের চেয়ে বেশি জরুরি ছিল শেষ বলে সিঙ্গেল নেওয়া। কাসুন রাজিতার আগের ওভারটা কীভাবে কীভাবে যেন পার করে দিয়েছিলেন নাহিদ রানা। এবার আর পারলেন না। দ্বিতীয় বলেই স্লিপে ক্যাচ তুলে দিয়ে অপরাজিত ৮৭ রানেই থামিয়ে দিলেন মুমিনুলের লড়াই। টেস্টে ১২ সেঞ্চুরির ৪টিতে অপরাজিত ছিলেন মুমিনুল। তবে সেঞ্চুরির এত কাছে গিয়ে অপরাজিত থাকা এই প্রথম। দুঃখটা তাই মুমিনুলের জন্য নতুনই।
জয়ের সঙ্গে এই টেস্টে আরও অনেক কিছুই পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। টেস্ট ইতিহাসে মাত্র তৃতীয়বারের মতো কোনো টেস্টে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেটই নিয়েছেন শ্রীলঙ্কান পেসাররা—এটাকেও কি প্রাপ্তি বলা যায়? দুই দলের ঝাঁজালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাম্প্রতিক ইতিহাস মনে রাখলে শ্রীলঙ্কার কাছে এই জয়কেও অনেক বড় মনে হওয়ার কথা। তবে পেসার-আধিপত্যের আগের দুই টেস্টের তুলনায় এটা কিছুই নয়। ১৯৮৫ সালে এর প্রথমটিতে ভারতকে হারিয়ে টেস্টে শ্রীলঙ্কার প্রথম জয়। পরের বছর কলম্বোরই আরেক মাঠে পাকিস্তানকে হারিয়ে দ্বিতীয়। পেসার-আধিপত্যের সাক্ষী তিনটি জয়ই যে উপমহাদেশীয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে, এটা কি কিছু বলে?