পিটার মুর। কাল সংবাদ সম্মেলনে
পিটার মুর। কাল সংবাদ সম্মেলনে

সেই বাংলাদেশে এবার আয়ারল্যান্ডের মুর

জিম্বাবুয়ে কেন ছাড়লেন?

প্রশ্ন শুনে পিটার মুরের মুখে ফুটে উঠল শুষ্ক হাসি। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ টি-টোয়েন্টির আগের দিন অনুশীলনে এসেছিলেন শুধু আয়ারল্যান্ড টেস্ট দলে থাকা পাঁচ ক্রিকেটার, মুর তাঁদেরই একজন। সংবাদ সম্মেলন শেষে হাতে লাঞ্চ বক্স আর কফির কাপ নিয়ে বাসে ওঠার আগে একটু সুযোগ পেয়েই প্রশ্নটা করা।

জিম্বাবুয়ে ছাড়ার কারণ সরাসরি বলতে চাইলেন না মুর। তবে জিম্বাবুয়ে ছেড়ে আসায় কোনো আক্ষেপ আছে কি না, এমন প্রশ্নে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না! কোনো আক্ষেপ নেই।’ এরপর হাসতে হাসতে বলেন, ‘আশা করি, দুই দেশের হয়ে টেস্ট খেলা ১৭তম ক্রিকেটার হব আমি।’

বোঝা গেল ক্রিকেট পরিসংখ্যানের খোঁজখবর ভালোই রাখেন মুর। এখন পর্যন্ত দুই দেশের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ১৬ জন ক্রিকেটার। যার মধ্যে সর্বশেষ খেলোয়াড় গ্যারি ব্যালেন্স, এক সময় যিনি ওপেন করেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। সম্প্রতি তাঁর ‘অভিষেক’ হয়েছে জিম্বাবুয়ের হয়ে, মুরের টেস্ট অভিষেক যে দলে।

আয়ারল্যান্ডের অনুশীলনে সতীর্থের সঙ্গে পিটার মুর

৮ টেস্ট ক্যারিয়ারের সর্বশেষ এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান খেলেছিলেন বাংলাদেশে, ২০১৮ সালে মিরপুরে। সে সফরে সিলেটে লো-স্কোরিং টেস্টে স্মরণীয় জয় পেয়েছিল জিম্বাবুয়ে, মুর প্রথম ইনিংসে গুরুত্বপূর্ণ ফিফটি করেছিলেন। দ্বিতীয় টেস্টে বড় ব্যবধানে হারলেও শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করেছিল জিম্বাবুয়ে। এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ক্যারিয়ারসেরা ৮৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মুর।

মুরের স্মৃতিতে এখনো তাজা সেই স্মৃতি, ‘আমার শেষ টেস্ট ম্যাচ ছিল ঢাকায়। আমি বেশ ভালো খেলেছিলাম। ম্যাচটি আমরা পঞ্চম দিনে নিয়েছিলাম।’

পরের বছর জিম্বাবুয়ের সহ-অধিনায়কত্ব পান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে সিরিজে দলকে নেতৃত্বও দেন। জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দেওয়া জীবনের ‘অন্যতম বড় লক্ষ্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন একসময়। সে লক্ষ্য কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছিল তখন।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট থেকে উঠে আসা মেধাবী এক তরুণ ক্রিকেটার ছিলেন মুর। স্কুলজীবন থেকেই ক্রিকেট খেলতেন। বাবার ক্রিকেট পছন্দ ছিল, দুই ভাইও খেলতেন—সব মিলিয়ে তিনি বড়ই হয়েছেন ক্রিকেটীয় আবহে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ২৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেক। শুরুতে অফ স্পিন করতেন, উইকেটকিপিং শুরু করেন বেশ পরে।

২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে মুর বলেছিলেন, আর্থিকভাবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য সেরা জায়গা না হলেও তিনি অন্য কোথাও যেতে চান না। কিন্তু পরে সেই মুরকেই জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার আশা ছাড়তে হয়। ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দেশের মাটিতে হওয়া দুই টেস্ট সিরিজের দল থেকে হুট করেই বাদ পড়েন। অথচ তার আগে জিম্বাবুয়ের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মুর খেলেছিলেন ৬০ বলে ৯২ রানের ইনিংস। জিম্বাবুয়ের হয়ে মুরের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়ে আছে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে সেই টি-টোয়েন্টিই।

আয়ারল্যান্ডের অনুশীলনে কিপিং করছেন মুর

জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার আশা কেন বাদ দিয়েছিলেন, সেটি সরাসরি না বললেও মুরের কথায় তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল, ‘একটা সময় ছিল, যখন কোনো কিছুই এমন ভালো যাচ্ছিল না। তখনই আমি দল বদলানোর সিদ্ধান্ত নিই।’

ক্রিকেটে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ২০১৯ সালে জিম্বাবুয়েকে নিষিদ্ধ করেছিল আইসিসি। সে কারণে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বও মিস করেছিল দেশটি। মুরের ‘দল বদলের’ সিদ্ধান্তে প্রভাব রেখেছে সেই টালমাটাল অবস্থাও। পাড়ি জমালেন আয়ারল্যান্ডে। দাদির জন্মসূত্রে আইরিশ পাসপোর্ট ছিল তাঁর আগে থেকেই।

ডাবলিনে বসবাস শুরু করেন। মাঝেমধ্যে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে জিম্বাবুয়ে যান। মুরের ভাই অ্যান্থনি মুরও একসময় ক্রিকেট খেলতেন, জিম্বাবুয়েতে ঘরোয়া ক্রিকেটও খেলেছেন। তবে আইনের ছাত্র অ্যান্থনি ক্রিকেটে বেশি দূর এগোতে পারেননি। আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে গেছেন জিম্বাবুয়েতে।

মুরের ক্ষেত্রে উল্টো। জিম্বাবুয়েতে পড়াশোনা, আন্তর্জাতিক খেলা শুরুর পর পাড়ি জমান আয়ারল্যান্ডে। মাঝে করোনাভাইরাসের সময়টা বাদ দিলে সর্বশেষ তিন মৌসুমে আয়ারল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন। বাদ দেননি জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটও। আয়ারল্যান্ডে যেহেতু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়মিত নয়, মাঠে থাকার জন্য মুরের ভরসা জিম্বাবুয়েই। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি সে কারণেই। মুর বলছিলেন, ‘জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনো ভালো। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আবার উন্নতি করছে, দারুণ একজন কোচ এসেছেন। অনেক ভালো ক্রিকেটারও আছে, দারুণ সমর্থন পাচ্ছে।’

অনুশীলনে কিপিংয়ে মনোযোগি পিটার মুর

আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা মুরের জন্য বিশেষ কিছুই। টি-টোয়েন্টি সিরিজের মাঝে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলার জন্য বিবেচ্য হতে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এটি আমার আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলার প্রথম সুযোগ। এর জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি, যাত্রাটাও দীর্ঘ ছিল বেশ। আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করতে মুখিয়ে আছি।’

২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের হয়ে বাংলাদেশেই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল মুরের। এবার মিরপুরের একমাত্র টেস্টের দলে থাকলে ৯ বছর পর সেই মাঠেই ভিন্ন একটি দলের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক হবে তাঁর। একসময় জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখা মুরের কাছে বাস্তবতাটাই বড় এখন, ‘জিম্বাবুয়ের অধিনায়কত্ব করা অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল, দারুণ সম্মানের। তবে আমার মনে হয়, আয়ারল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলতে পারলে সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয় হবে সেটিই।’

জিম্বাবুয়ের মুর যে এখন হয়ে গেছেন আয়ারল্যান্ডের!