শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২৩। কেমন ছিল খেলার এই বছর? ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ ফিরে দেখা যাক বাংলাদেশ ক্রিকেট।
শেষনিশ্বাস ফেলতে থাকা বছরটা কেমন গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য? মানুষ বর্তমানে বাঁচে, যাতে ছায়া থাকে একেবারে নিকট অতীতের। যাতে ধূসর হয়ে যায় একটু দূরের অতীত। যে কারণে ওই প্রশ্নটার উত্তরে প্রায় সবাই হয়তো বলবেন, ‘ভালোই তো।’ সর্বশেষ ছয় ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। সেই তিন জয়ই আবার নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে। দেশে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারানোর পর নিউজিল্যান্ডে গিয়ে যোগ হয়েছে আরও দুটি ‘প্রথম’। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে জয়ের পর টি–টোয়েন্টিতেও প্রথম জয়। দারুণ একটা সময়ই যাচ্ছে বছরের শেষে।
কিন্তু তাতেও কি বিশ্বকাপ–ব্যর্থতা ভোলা যাচ্ছে? ২০২৩ সালের দিকে ফিরে তাকালে আরও অনেক অর্জনের পরও বিশ্বকাপে শোচনীয় ব্যর্থতাই কি সবচেয়ে বড় হয়ে উঠছে না! অথচ বাংলাদেশ বছরটা শুরু করেছিল ভারতকে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজে হারানোর আমেজে। এর মধ্যেই বাংলাদেশ ক্রিকেট ঢুকে পড়ে বিপিএলে।
বিপিএলে ভালো করা ক্রিকেটারদের হাত ধরেই বাংলাদেশ পেয়ে যায় নতুন বছরে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সাফল্য। কয়েক মাস আগেই অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ২-১–এ হারলেও টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে জিতে যায় বাংলাদেশ।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে নাজমুল হোসেন, তাওহিদ হৃদয়, হাসান মাহমুদ, নাসুম আহমেদের মতো তরুণদের হাত ধরে আসা সেই সাফল্যের পর টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান দাবি করলেন, বাংলাদেশ এশিয়ার সেরা ফিল্ডিং। এমনও বলেছিলেন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ এমন কিছু করবে, যা আগে কখনো করেনি। কথাটা বছর শেষে ওয়ানডে বিশ্বকাপে চোখ রেখেই। অথচ সেই বিশ্বকাপের দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই সাকিব নিজেই বলেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ।
তুমুল আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে এ নিয়ে, কিন্তু পাকিস্তান–শ্রীলঙ্কায় যেমন হয়েছে, বিশ্বকাপ–ব্যর্থতা বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোনো পরিবর্তনই আনতে পারেনি। ছেলেদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যখন এত ঝড়ঝাপটা, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে বছরের সেরা সাফল্য এনে দিয়েছেন বাংলাদেশের যুবারা। বছরের শেষে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মেয়েরাও বছরজুড়ে আলো ছড়িয়েছেন। দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশের মেয়েরা বছরজুড়ে ছিলেন ধারাবাহিক। দক্ষিণ আফ্রিকায় মেয়েদের প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে সুপার সিক্সে।
বিশ্বকাপ–ব্যর্থতার বছর
বিদায়ী বছরে বিক্ষিপ্ত হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্জন সেই অর্থে কম নয়। বছরের শেষ দিনে শেষ ম্যাচ খেলার আগেই বাংলাদেশ দল এ বছর তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৪৯ ম্যাচ খেলে জিতেছে ২৪টিতে। ২০১৮ সালে ৪৪ ম্যাচে ২১ জয় ছাপিয়ে যা নতুন রেকর্ড। কিন্তু বিশ্বকাপ–ব্যর্থতায় সেই সাফল্য উদ্যাপন করার পথ রাখেনি। বছরের শুরু থেকেই অবশ্য ওয়ানডেতে অধারাবাহিক ছিল বাংলাদেশ।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ হার দিয়ে শুরু। এরপর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দেশে ও ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজ জিতলেও ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হার। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের অর্জন মাত্র দুটি জয়। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে সিরিজে হার। আর বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশ ফিরেছে মাত্র দুটি জয় নিয়ে। সেই দুই জয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সরাসরি খেলার সুযোগ হয়তো করে দিয়েছে, কিন্তু তাতেও বাকি সাত ম্যাচে পরাজয়ের গ্লানি মুছে যায়! যে সাত পরাজয়ের মধ্যে সবচেয়ে দগদগে ক্ষত অবশ্যই নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও হেরে যাওয়া।
টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে সাফল্য
অন্য দুই সংস্করণে বছরটা ভালোই কেটেছে। ৪ টেস্টের ৩টিতেই জয়। নিউজিল্যান্ডের আগে দুটি জয় আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়টা এসেছে ৫৪৬ রানে, যা টেস্ট ইতিহাসে রানের ব্যবধানে তৃতীয় সর্বোচ্চ জয়।
টি-টোয়েন্টিতেও ১০ ম্যাচে জয় ৮টি, একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় হেরেছে মাত্র একটিতেই। বেশির ভাগ সাফল্যই অবশ্য ঘরের মাঠে। ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হারানোর পর আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষেও টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। বছরের শেষে এসে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম জয়ের কথা তো বলা হয়েছে আগেই।
চোট থেকে সুস্থ হয়ে তামিম খেলায় ফিরেছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগে, নিউজিল্যান্ড সিরিজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামিমকে ছাড়াই বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে বিসিবি।
মাঠের বাইরের বিতর্ক
শুরুটা হয় বোর্ড সভাপতি নাজমুল হোসেনের এক সাক্ষাৎকারে। যেখানে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের কথা না বলার বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন বোর্ডপ্রধান। তামিমের ফিটনেস নিয়েও সংবাদমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য করেন তিনি। যার সূত্র ধরে গত জুলাইয়ের আফগানিস্তান সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন তখনকার ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম।
পরের দিন প্রধানমন্ত্রীর চাওয়ায় অবসর ভেঙে খেলায় ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আফগানিস্তান সিরিজটি আর খেলেননি। ছিলেন না এশিয়া কাপেও। চোট থেকে সুস্থ হয়ে তামিম খেলায় ফিরেছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগে, নিউজিল্যান্ড সিরিজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামিমকে ছাড়াই বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে বিসিবি।
তামিমের অবর্তমানে সাকিবকে বিশ্বকাপ পর্যন্ত অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। আর বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে, তখন এক সাক্ষাৎকারে তামিমের কড়া সমালোচনা করেন সাকিব। বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে, তখন দেশের ক্রিকেটের দুই মহাতারকা মুখোমুখি অবস্থানে। মাঠের খেলার চেয়ে সাকিব–তামিম বিবাদই হয়তো বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
নারী ক্রিকেটের জাগরণ
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটারদের জন্য ২০২৩ সাল স্মরণীয় এক বছর। শুধু জাতীয় দলের কথাই বললে বছরের শুরুতে পূর্ণ শক্তির ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়, ওয়ানডে সিরিজ ড্র—দুটোই বড় অর্জন।
জয় এসেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজেও। এশিয়ান গেমস থেকে মিলেছে ব্রোঞ্জপদক। শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে জয়ও এ বছর। প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সাদা বলের দুই সংস্করণেই জয়ের দেখা পেয়েছে নিগারের দল।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টিতে প্রথম অর্জনের যে হ্যাটট্রিক করেছে বাংলাদেশ, তাতে অধিনায়ক নাজমুলের বড় ভূমিকা।
অধিনায়ক নাজমুল
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম অর্জন ‘অধিনায়ক’ নাজমুল হোসেনকে খুঁজে পাওয়া। ব্যাটিংয়ে দলের মূল ভরসা হয়ে উঠেছিলেন আগেই। নিয়মিত অধিনায়ক সাকিবের অনুপস্থিতিতে বছরের শেষে এসে সেই নাজমুল পান তিন সংস্করণেই নেতৃত্বের দায়িত্ব।
সেটিকে শুধু ঠেকা চালানোর কাজ না রেখে নিজের নেতৃত্বগুণের প্রমাণ দিয়েছেন প্রথম সুযোগেই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টিতে প্রথম অর্জনের যে হ্যাটট্রিক করেছে বাংলাদেশ, তাতে অধিনায়ক নাজমুলের বড় ভূমিকা।
এশিয়ার সেরা যুবারা
আকবর আলীর দলের একটাই আক্ষেপ—২০১৯ অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৫ রানের হার। ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অবশ্য সেই ভারতকে হারিয়েই শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। এবার যুবাদের এশিয়ার সেরা হওয়ার আক্ষেপ মেটায় মাহফুজুর রহমানের অনূর্ধ্ব-১৯ দল।
শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো বড় দলকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে জায়গা করে নেন বাংলাদেশের যুবারা। ফাইনালে স্বাগতিক সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারিয়ে আসে প্রথম এশিয়া–সেরা হওয়ার গৌরব।