জান্নাতুল ফেরদৌসের দিকে এগিয়ে গেলেন মুর্শিদা খাতুন। জড়িয়ে ধরলেন, দুজনের মধ্যে একটু খুনসুটি হলো। সিলেটে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে হারের পর সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন বাংলাদেশ দলের সর্বোচ্চ স্কোরার মুর্শিদা। একটু আগে মুর্শিদা ছিলেন মঞ্চে, মাইক্রোফোনের ওপাশে। জান্নাতুল প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর উদ্দেশে। দুজনের সে পরিচয়ের পার্থক্যটা মিলিয়ে গেল একটু পর। দুজন তখন বন্ধু।
অবশ্য জাতীয় দলে সতীর্থের সঙ্গে বন্ধুত্বটা যে আগের মতোই আছে, অফ স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার জান্নাতুল সেটি দাবি করেন না, ‘যোগাযোগ ছিল, কথা হতো। কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় বাইরে ছিলাম, ওই যে বলে না—চোখের আড়াল হলে নাকি মনের আড়ালও হয়ে যায়। এখানে থাকলে যেমন বন্ধুত্ব, সেটা তো সেখানে থেকে হয় না।’
২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দুজনেরই আন্তর্জাতিক অভিষেক—প্রথম ওয়ানডেতে মুর্শিদার, পরের ম্যাচে জান্নাতুলের। মুর্শিদা এরপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলের অন্যতম সেরা ব্যাটার হিসেবে, এখন দলের অন্যতম অভিজ্ঞ সদস্য এই বাঁহাতি ওপেনার। আর জান্নাতুলের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে গেছে ২০১৮ সালেই। সে সফরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন, পরে এশিয়া কাপজয়ী দলের সদস্যও ছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ মেলেনি আর।
জান্নাতুল এরপর ‘দূরে’ চলে যান। দূরে বলতে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন, কোচিং করিয়েছেন। সিলেটে এবার এসেছেন একটু ভিন্ন পরিচয়ে। তবে স্বপ্নটা আগের মতোই আছে—জাতীয় দলের হয়ে আবার খেলা। যেটি পূরণ হলে মুর্শিদা আর তাঁর পরিচয়ে ভিন্নতা থাকবে না আর।
****
জান্নাতুল দেশে ফিরেছেন মাসখানেক আগে। নিজ শহর রংপুর গিয়েছিলেন। এরপর সিলেটে আসার উদ্দেশ্য ধারাভাষ্য দেওয়া। মাইক্রোফোন হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বললেন, ‘একদমই অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে সব সময়ই ইচ্ছা ছিল ক্রিকেট ছাড়ার পর ধারাভাষ্য করব। তবে এত দ্রুত করব ভাবিনি। একেবারেই আনাড়ি এখন। প্রথম দিন মাইক্রোফোন হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতাটা বলতে পারেন প্রথম দিন ক্রিকেট ব্যাট ধরার মতো।’
অবশ্য তাঁর ধারাভাষ্যের এই অধ্যায়টাকে বলা যায় ভবিষ্যতের জন্য একটু এগিয়ে থাকা হিসেবে। মাইক্রোফোনের সামনে এসে বুঝেছেন, সেটির জন্য প্রস্তুতির ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। তবে জান্নাতুলের এবারের দেশে ফেরার উদ্দেশ্য একটাই। পাঁচ বছর আগে যে জাতীয় দলের হয়ে খেলার ব্যাপারটি পেছনে ফেলে গিয়েছিলেন, সেটির পথে আরেকবার ছোটা।
সিলেটে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ শেষের পর প্রথম আলোকে যেমন বললেন, ‘যেহেতু আগেও জাতীয় দলে খেলেছি, এখনো খেলার ইচ্ছা। সব সময়ই সে ইচ্ছাটা ছিল। কিন্তু এত দিন দূরে ছিলাম বলে যোগাযোগের একটা ঘাটতি তো ছিলই। ওখানে হয়তো ভালো করছিলামও। তবে ওখানে ভালো করলেই তো হবে না, এখানে এসে বাংলাদেশের যে একটা পদ্ধতি, প্রক্রিয়া—সেসব অনুসরণ করে যেতে হবে। এ কারণেই আসা। আবার বাংলাদেশে খেলার আশা আছে। সামনে যেহেতু অনেক খেলা। আমার কাছে মনে হয়েছে যে নিজের দেশকে দেওয়ার অনেক কিছু আছে এখনো।’
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সেখানকার ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন, নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিতও করেছিলেন। ২০২১ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের হয়ে আবার খেলার স্বপ্নটা বিসর্জন দেননি। কিন্তু তাঁর চোখ ছিল অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলেও, ‘ওখানে থাকার সময় আসলে ওভাবেই চিন্তা করছিলাম। ওখানে ভালো করছিলাম, সম্ভাবনাও ছিল।’
এরপরও তাহলে আবার ফেরা কেন? জান্নাতুলের উত্তর, ‘দিনশেষে পরিবার এখানে, সবকিছু এখানে। সে সবের বাইরেও মনে হয়েছে দেশকে দেওয়ার আছে। ওখানে তো পরে আবার যেতে পারব। তবে এখন আমার বয়স ২৪, বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু যদি করতে পারি।’
জাতীয় দলে ফেরার ক্ষেত্রে জান্নাতুলের প্রথম ধাপ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। এ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু সেই লিগে রূপালী ব্যাংকের হয়ে খেলার কথা আছে তাঁর। জাতীয় দলের দিক থেকেও ইতিবাচক বার্তাই পেয়েছেন তিনি, ‘প্রিমিয়ার লিগে কেমন করি, দেখা যাক। এরপর বোঝা যাবে। দলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, “তুমি খেলো, যদি ভালো করো, দরজা সব সময়ই খোলা আছে।”’
বিসিবির উইমেনস উইংয়ের হেড অব অপারেশনস হাবিবুল বাশারও বেশ খুশি জান্নাতুলের ফিরে আসায়, ‘ব্যাপারটা তো বেশ উৎসাহজনকই। আমি খুব খুশি যে সুমনা (জান্নাতুলের ডাক নাম) ফিরে এসেছে। তাকে অনুশীলনের সব রকম সুযোগ-সুবিধাই করে দিয়েছি। সামনে প্রিমিয়ার লিগ আছে। আশা করি, ভালো পারফর্ম করবে।’
এটিকে নারী ক্রিকেটের জন্য ‘অনেক ইতিবাচক’ হিসেবেই নিচ্ছেন বাশার, ‘আমরা তো চাই যত বেশিসংখ্যক খেলোয়াড় আসুক। আগেও বলেছি, আমাদের আসলে পাইপলাইনে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আশা করছি প্রিমিয়ার লিগে ভালো করবে। তাকে বিবেচনা করা যাবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় দলের পুলটাও বড় হবে।’
****
‘একজন কমেন্টেটরকে দেখলাম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের নাকি সাবেক খেলোয়াড়, ২৪ বছর বয়স। আবার অস্ট্রেলিয়ায় থেকেছে। এই বয়সে এত কিছু!’
ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন বিসিবির কিউরেটর টনি হেমিং। এ বয়সে জান্নাতুলের এত কিছু করার গল্প শুনে হেমিং বেশ অবাকই হয়েছেন। সেই হেমিংয়ের সঙ্গেও তৃতীয় ম্যাচের আগে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখা গেল জান্নাতুলকে।
সে আলোচনা প্রসঙ্গে জান্নাতুল বলেন, ‘প্রথমে সিলেটের উইকেট দেখে মনে হয়েছে অনেক আলাদা। আমাদের মিরপুরের উইকেট থেকে বেশ আলাদা। এটা অস্ট্রেলিয়ান উইকেটের মতো মনে হয়েছে, মানে মেলানো যায়। ফেয়ার উইকেট, বল ব্যাটে আসছে। এ ধরনের উইকেটে খেললে ব্যাটার বা বোলার হিসেবে অনেক শেখা যায়। আমি একটু শেখার চেষ্টা করছিলাম। ওর কাছ থেকে একটু জানার চেষ্টা করছিলাম।’
ধারাভাষ্য দিতে এলেও মাঠের ক্রিকেটটা একেবারে দূরে সরিয়ে রাখেননি জান্নাতুল। জাতীয় দলের নেটেও অফ স্পিন করতে দেখা গেছে তাঁকে।
গত পাঁচ বছরে নিজেকে অস্ট্রেলিয়ায় নাকি বেশ গুছিয়েই এনেছিলেন জান্নাতুল। সিডনির গ্রেড ক্রিকেট পেরিয়ে খেলেছেন সেখানকার জাতীয় নারী ক্রিকেট লিগে। এর বাইরে এগিয়েছেন কোচিংয়েও, ‘ক্রিকেট কোচিংয়ে লেভেল টু করেছি। প্রাইভেট একটা স্কুলে ছিলাম। সঙ্গে নিউ সাউথ ওয়েলসে কমিউনিটি ক্রিকেট অফিসার হিসেবে ছিলাম। পেশাদার ক্রিকেট খেলেছি, কোচিংটাও উপভোগ করেছি।’
এরপর যোগ করলেন, ‘আমাদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ানদের একটা পার্থক্য হলো, খেলোয়াড় থাকা অবস্থাতেই ওরা কোর্সগুলোও করে রাখে। আর আমার মনে হয়, কোচিংটা আসলে আমাকে ক্রিকেট বুঝতে আরও সহায়তা করে। সঙ্গে মনে হয় যে এটা উপভোগ করতাম, বাচ্চাদের সঙ্গ।’
দেশ ছাড়ার আগের জান্নাতুলের চেয়ে এখনকার জান্নাতুল কি তাহলে সব মিলিয়ে আরও ভালো ক্রিকেটার? এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে চাইলেন না তিনি, ‘খেলোয়াড় হিসেবে আত্মবিশ্বাস থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা তো আছেই। আসলে পারফর্ম করেই দেখাতে চাই।’
জান্নাতুলের এভাবে ফিরে আসা, পারফর্ম করার ইচ্ছা, জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন—পুরো ব্যাপারটিকে তাঁর বাংলাদেশে দ্বিতীয় শুরু কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এরপর বললেন, ‘বলা যেতেই পারে। ওভাবে আসলে ভাবিনি। সব সময়ই আমার মনে হয়, জাতীয় দলই আমার জায়গা। আসলে এভাবে ভাবিনি। হতে পারে। “টার্ম”টা কী হবে, সেটি আপনারাই ঠিক করবেন।’
****
সিলেটে তৃতীয় টি-টোয়েন্টির পর পুরস্কার বিতরণী শেষ, সংবাদ সম্মেলনও তাই। ড্রেসিংরুমের সামনে এক ভারতীয় ব্রডকাস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন হারমানপ্রীত কৌর ও স্মৃতি মান্ধানা। স্মৃতি কয়েকজনের ছবির আবদারও মেটালেন।
এদিকে আলাপ শেষে চলে যাওয়ার পথে পেছন ফিরে জান্নাতুলের জিজ্ঞাসা, ‘পোস্ট ম্যাচ কি শেষ?’ পুরস্কার বিতরণী নাকি সংবাদ সম্মেলনের কথা বলছেন, সেটি ঠিক বোঝা গেল না বলে আবার নিশ্চিত হতে হলো। সংবাদ সম্মেলনে রাবেয়া খান এসেছিলেন শুনে জান্নাতুল এরপর আফসোস করা শুরু করলেন, ‘আহা, যেতে চেয়েছিলাম। আমি ওকে একটা প্রশ্ন করতাম।’
সেই সুযোগটা পরের দুই ম্যাচে আবার পেতে পারেন জান্নাতুল। যেমন পেতে পারেন প্রায় ছয় বছর পর জাতীয় দলে আবার খেলার সুযোগ।