চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে সাকিব আল হাসানকে ব্যাটিংয়ের সময় কালো একটি স্ট্র্যাপ কামড়ে ধরে রাখতে দেখা যায়। সেই স্ট্র্যাপটি ব্যাটিংয়ের সময় তিনি গলায় পরে ছিলেন। টেলিভিশন থেকে নেওয়া ওই দৃশ্যের কিছু স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এটা নিয়ে শুরু হয় ‘গবেষণা’। পরে জানা যায়, ব্যাটিংয়ের সময় মাথার অবস্থান ঠিক রাখতে তিনি এটা করছেন। তবে প্রথার বাইরে গিয়ে ক্রিকেটারদের এমন কিছুর আশ্রয় নেওয়া এটাই প্রথম নয়। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট গ্লাভসের ভেতরে স্কোয়াশ বল ব্যবহার করেছেন। লাসিথ মালিঙ্গা নেটে বানিয়ে নিয়েছেন ব্যাটসম্যানের নকল পা। ক্রিকেটের ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর এক ফিচার থেকে জানা যাবে এর বিস্তারিত—
সাকিবের সমস্যা
ভারতের বিপক্ষে এই সিরিজেই সাকিব প্রথম রবারের স্ট্র্যাপ কামড়ে ধরে ব্যাটিং করছেন না। শুরুতে নেটে ব্যাট করার সময় এটি করতেন। পরে ভারতে গত বছরের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং কানাডায় গ্লোবাল টি–টোয়েন্টিতেও রবারের কালো স্ট্র্যাপ কামড়ে ধরে ব্যাটিং করেছেন। ব্যাটিংয়ের সময় সাকিবের মাথার অবস্থানের সমস্যা মূলত তাঁর চোখের একটি সমস্যা থেকে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকলে সাকিবের চোখের রেটিনার নিচে একধরনের তরল পদার্থ জমে, যেটা ঝাপসা করে দেয় দৃষ্টি। এমনটা হলে তিনি যেন ব্যাটিংয়ের সময় বল ঠিকভাবে দেখতে পারেন, তার জন্যই মাথার অবস্থান ঠিক রাখতে ওই রবার স্ট্র্যাপ থেরাপি।
গিলক্রিস্টের স্কোয়াশ বল
ব্যাটিংয়ের সময় গ্রিপ নিয়ে কাজ করছিলেন গিলক্রিস্ট। তারই অংশ হিসেবে ২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সময় ব্যাটের হাতলের নিচের দিকে রাখা হাতের গ্লাভসের ভেতরে একটি স্কোয়াশ বল নিয়ে খেলেছিলেন। ফল, বিশ্বকাপের ফাইনালের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ইনিংস—১০৪ বলে ১৪৯ রান। গিলক্রিস্টের স্কোয়াশ বল ব্যবহারের কারণ ছিল, ব্যাটের হাতলের নিচের দিকে থাকা হাতের শেষ দুই বা তিন আঙুলে বেশি জোর দিয়ে ব্যাট ধরে না রাখা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া।
গিলক্রিস্টকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর ব্যাটিং কোচ বব মিউলেম্যান। এটা গিলক্রিস্টকে ব্যাটের হাতলের নিচের দিকে রাখা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনীর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। শট খেলায় ওপরের হাতের ভূমিকাও অনেক বেড়ে যায়।
মালিঙ্গার সিমুলেটর
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বোলিং করার সময় লাসিথ মালিঙ্গার দর্শন ছিল খুব সরল—বেশি বেশি ইয়র্কার করো। শৈশবে তিনি ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিসকে ইয়র্কারের পর ইয়র্কার করতে দেখে বড় হয়েছেন। এই দুজনকে দেখে মালিঙ্গার মনে হয়েছিল—এটাই (ইয়র্কার) সেরা বল। এরপর তিনি যখন চামড়ার বল দিয়ে খেলতে শুরু করেন, সেই সময় দেখা করেন বোলিং কোচ চম্পকা রমানায়েকের সঙ্গে। চম্পকা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সোজা এবং জোরে বল করতে।
সরল এই দর্শনের সঙ্গে মালিঙ্গার ইয়র্কার বল করার প্রশিক্ষণে নেটে যোগ হয়েছিল আরেকটি সহজ অনুশীলন। ব্যাটিং ক্রিজে তিনি দুটি জুতা রাখতেন, সেটা এমনভাবে যে দেখে মনে হতো গার্ড নিয়ে কোনো ব্যাটসম্যান দাঁড়িয়ে আছেন। ফলে নেটে কোনো ব্যাটসম্যান না থাকলেও মালিঙ্গা ব্যাটসম্যানের পায়ের ওপর বল করার অনুশীলন করতে পারতেন।
বেইলির মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া স্ট্যান্স
২০১৬ সালের ডিসেম্বরের কথা, জর্জ বেইলি প্রথমবারের মতো প্রথাবিরুদ্ধ একটা ব্যাটিং স্ট্যান্স বের করেন। তিনি বোলারের দিকে পেছন ফিরে স্ট্যান্স নেন। পরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে তিনি বলেছেন, ‘এটা আসলে পাগুলে ব্যাপার ছিল। এ কারণে আমি এটা দেখতেও চাই না।’ কিন্তু কী কারণে তিনি এমন করেছিলেন?
বেইলি বুঝতে পারছিলেন, প্রথাগত ব্যাটিং স্ট্যান্স তাঁকে বলের আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে সুইঙ্গিং কন্ডিশনে। যে কারণে তাঁর হাত শরীর থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছে। এটা ঠিক করতে অভিনব ওই স্ট্যান্সে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন বেইলি। বাঁ পা রাখেন ডান পায়ের সামনে, দুই পা–ই থাকে ডিপ থার্ডম্যানমুখী।
পিটারসেনের প্যাড ছাড়া অনুশীলন
টেস্ট ক্রিকেটে ১৮১ ইনিংসে ২৯ বার বাঁহাতি স্পিনে আউট হয়েছেন কেভিন পিটারসেন। যদিও এটা কোনো উদ্বেগের বিষয় ছিল না। কারণ, এরপরও বাঁহাতি স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর গড় ৫২.৮৬। কিন্তু তিনি একটা সময়ে অনিয়মিত বা নতুন বাঁহাতি স্পিনারদের বলেও আউট হচ্ছিলেন। তাঁকে লেখা রাহুল দ্রাবিড়ের চিঠি থেকে এর একটা সমাধানের একটা পথ খুঁজে পান তিনি। গ্রায়েম সোয়ান ও মন্টি পানেসারের বিপক্ষে নেটে প্যাড ছাড়া খেলতে শুরু করেন। ভাবনাটা ছিল এ রকম যে এতে করে তাঁর সামনের পা একটু দেরিতে সামনে আসবে। এর ফলে টার্নিং বল বেশি জোরে মারতে যাবেন না। পা আগে চলে এলে যা হতে বাধ্য।
রণজিৎসিংজির ফ্লিকে স্কোরিংয়ের নতুন জায়গা
বিশ্ব ক্রিকেটে পরিচিতি পাওয়া প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার রণজিৎসিংজি। ভারতের বিখ্যাত ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট রঞ্জি ট্রফির নামকরণ তাঁর নামেই। বর্তমানে ক্রিকেটের অন্যতম একটি স্কোরিং শট লেগ গ্ল্যান্সের আবিষ্কারক বলে মানা হয় তাঁকে। তা কীভাবে এই শটটা খেলতে শুরু করলেন তিনি? রণজিৎসিংজি তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ছাত্র। সেই সময় কেমব্রিজে ক্রিকেটারদের কোচিং করাতেন সারের এক পেশাদার ক্রিকেটার। শোনা যায়, সেই শিক্ষক একদিন ক্রিজে রণজিৎসিংজির পেছনের পা আটকে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, রঞ্জি যেন বলের কাছ থেকে সরে যেতে না পারেন। সত্য হোক বা না–ই হোক, এটা থেকে লেগ সাইডে বল পাঠানোয় তাঁর যে নতুন সামর্থ্য আবিষ্কার হয়েছে, সেটা ব্যাটিংয়ে একটা বিপ্লবই এনেছে। আগে মাঠের যে অঞ্চলগুলোয় রান হতো না, সেই অঞ্চলগুলোও রানের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।