বিশ্বকাপে মাঠের ভেতর দুর্দান্ত খেলছে ভারত
বিশ্বকাপে মাঠের ভেতর দুর্দান্ত খেলছে ভারত

ভারতীয় বিশ্বকাপ যেন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নতুন ঘ্রাণ

রোহিত শর্মার দল নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর ওয়াসিম আকরাম বলেছেন, ভারত ছুটছে ‘ব্রেক ফেল করা ট্রেনের মতো।’

তো সেই ট্রেনের গতির বিবরণটাও দেওয়া যাক। বিশ্বকাপে সেটি ছিল ভারতের পঞ্চম ম্যাচ। তখনো পর্যন্ত সব ম্যাচেই রান তাড়া করে জিতেছে ভারত। কোনো ম্যাচেই ২৭৪–এর বেশি করতে হয়নি। অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানকে অলআউট করেছে দুই শ-র নিচে। জেতার নমুনাগুলোও নিশ্চয়ই জানা, ৪, ৭, ৭, ৮ ও ৬ উইকেটে। ওয়াসিম আকরামের ব্রেক ফেল করা ট্রেনের সামনে ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাও উড়ে গেছে। বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা ২২৯ তাড়া করতে নেমে হেরেছে ১০০ রানে, আর ২৭ বছর আগের চ্যাম্পিয়নরা ৩৫৭ তাড়া করে ৩০২ রানে। জয়ের ব্যবধানগুলোয় একটি বার্তা স্পষ্ট। ভারতের গতির সঙ্গে টক্কর দেওয়া দূরে থাক, তাল মেলানোই কষ্ট!

মাঠের বাইরেও কি কেউ পারছে?

বিসিসিআই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড। শুধু বিশ্বকাপটা দেখেও কেউ বলতে পারেন, সবচেয়ে প্রভাবশালীও নয় কি? নইলে আইসিসির টুর্নামেন্টে পাকিস্তানি সমর্থক-সংবাদকর্মীদের যাওয়ায় ভারতীয় ভিসা বাধা হয় কীভাবে? বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টের সূচি কীভাবে একাধিকবার পাল্টানো সম্ভব? আর টেলিভিশনের দিকে তাকালে তো মনে হয় বিশ্বকাপে খেলছে ভারত এবং অন্যরা।

যে টুর্নামেন্টে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো না, সেখানে আলাদা করে বাদ্যবাজনা হলো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে। বিসিসিআই গ্যালারির দর্শকদের তেষ্টা মেটাতে মাঠে পানির ব্যবস্থা রেখেছে বটে, কিন্তু সেসব প্রত্যাশামতো খরচ হচ্ছে শুধু ভারতের ম্যাচেই। অন্য দলগুলোর ম্যাচে গ্যালারিতে তাকালে টুর্নামেন্টটা ঠিক বিশ্বকাপ বিশ্বকাপ লাগে না।

বিশ্বকাপে শুধু ভারতের ম্যাচেই গ্যালারিভর্তি এমন দর্শক দেখা যাচ্ছে

আইসিসিকে দুষে লাভ নেই। ইসিবির প্রধান নির্বাহী রিচার্ড গোল্ডের কথা শুনুন। গত জুলাইয়ে আইসিসির আয়ের বেশির ভাগ ভারত পাবে, এই সমর্থনে ‘দ্য ফাইনাল ওয়ার্ড পডকাস্টে’ বলেছিলেন, ‘ভারতের দাপুটে অবস্থান লভ্যাংশ এনে দেওয়া ও খেলাকে এগিয়ে নেওয়ার সামর্থ্যের কারণেই। তাদের ১৪০ কোটি মানুষ, একটা খেলা, ১০টি (আইপিএল) দল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল আছে।’

আইসিসির মোট বাণিজ্যিক আয়ের ৮৫.৩ শতাংশ বিসিসিআইয়ের। আইসিসির বোর্ড অনুমোদিত রাজস্ব বণ্টন কাঠামোর (২০২৪-২৭) কথা উল্লেখ করে ইএসপিএনক্রিকইনফো জানিয়েছিল এই তথ্য। সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা তারা না পেলেও অঙ্কটা যে অন্য একটি অঙ্কের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, তা বলা হয়েছিল ইএসপিএনক্রিকইনফোর প্রতিবেদনে। সেটি হলো বৈশ্বিক ক্রিকেট অর্থনীতির ৭০-৮০ শতাংশ অর্থ আসে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে। আগামী চক্রে বিসিসিআই তাই পাবেও বাকিদের চেয়ে ঢের বেশি—আইসিসির মোট আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। তাই আইসিসিকে দুষে কি লাভ! বরং জেনে রাখুন, ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক এ সংস্থাটির খুব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ অর্থ ও বাণিজ্যসংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান জয় শাহ। ঠিক ধরেছেন, তিনি বিসিসিআই সেক্রেটারিও।

জয় শাহ গ্যালারি থেকেই দেখছেন, মাঠের খেলায় রোহিতদের ওপরে কেউ নেই। ক্রিকেটে এখন আসলে ভারতের ওপরে কিছু নেই। আইসিসির সর্বোচ্চ টুর্নামেন্টে সেই প্রভাবটা কিন্তু স্পষ্ট।

বিসিসিআই সেক্রেটারি জয় শাহ

সূচি ও টিকিটে বিড়ম্বনা

২০১৯ বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল ৩০ মে। সূচি প্রকাশ করা হয়েছিল তার ১৩ মাস আগে। ২০১৫ বিশ্বকাপ আরেকটু সরেস। প্রথম ম্যাচের ১৮ মাস আগেই সূচি প্রকাশ করা হয়েছিল নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের। টিকিট ও বিশ্বব্যাপী দর্শকদের খেলা দেখতে যাওয়ায় যেন কোনো ঝামেলা না হয়, সেটাও ছিল আগেভাগে সূচি প্রকাশের লক্ষ্য। ম্যাচের সূচি প্রকাশ না হলে টিকিট কাটবে কীভাবে? সে জন্য প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার থাকে।

কিন্তু এবার বিশ্বকাপের আয়োজক ভারত বলেই বোধ হয় সবকিছু একটু আলাদা। সূচি প্রকাশ করা হয় বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র পাঁচ মাস আগে। একাধিকবার তা পাল্টে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সূচি ঘোষণা হয় ৯ আগস্ট, মানে বিশ্বকাপ শুরুর আগে মাঝে মাত্র দুই মাস সময় হাতে রেখে। বিসিসিআই সেক্রেটারি জয় শাহ দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে সামনে এনেছেন অংশগ্রহণকারী দেশ ও সম্প্রচারকদের বিভিন্ন লজিস্টিক সমস্যাকে।

জুনে আইসিসির প্রধান নির্বাহী জিওফ অ্যালারডিস বিবিসি টেস্ট ম্যাচ স্পেশালকে বলেছিলেন, ‘আমরা যেকোনো সময় আয়োজকদের কাছ থেকে সূচি পেতে পারি...যে কোনো ইভেন্টেই আয়োজকদের সঙ্গে হাতে হাত রেখেই কাজ করতে হয়।’ অ্যালারডিসের কথাতেই পরিষ্কার, টুর্নামেন্ট আইসিসির হলেও সূচি প্রকাশ থেকে পাল্টানো—এ সবকিছুই হয়েছে আয়োজকদের (বিসিসিআই) ইচ্ছায়।

বিসিসিআই সাধারণ দর্শকদের জন্য টিকিট ছেড়েছে গত ২৫ আগস্ট, বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র ৪১ দিন আগে। আবারও একটু পেছন ফেরা যাক। ২০১১ বিশ্বকাপে সহ–আয়োজক ছিল ভারত। সেবার প্রথম কিস্তির টিকিট ছাড়া হয়েছিল ২০১০ সালের জুনে। সর্বশেষ বিশ্বকাপেও (২০১৯) টিকিট ছাড়া হয় আগের বছরের সেপ্টেম্বর। কিন্তু এবার তা হয়নি। বিশ্বকাপের সূচি প্রকাশ ও টিকিট বিক্রিতে আইসিসি দৃশ্যত অনুপস্থিতই ছিল। গত জুনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে বিবিসি টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ নিয়ে একরকম অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছিলেন অ্যালারডিস। তবে বলেছিলেন, আশা করি সবকিছু ‘যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করা হবে।’

ভিসায় ‘না’

প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্কের জেরে ঝামেলাটা প্রথম লাগে এশিয়া কাপে। ভারতীয় বোর্ড নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তানে দল পাঠায়নি। পিসিবি তখন বলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেট দল তাদের দেশে খেলতে না গেলে বিশ্বকাপ খেলতে তারাও পাকিস্তান দলকে ভারতে পাঠাবে না। শেষ পর্যন্ত এশিয়া কাপে ভারতের ম্যাচগুলো হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। এরপর পাকিস্তানকে আসল খেলটা ভারত দেখায় বিশ্বকাপে।

আহমেদাবাদে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তানি দর্শকের দেখা পাওয়া ছিল বিরল ব্যাপার

সেটা শুধু মাঠের খেলায় পাকিস্তানকে ১৯২ রানে অলআউট করে ৭ উইকেটে তুলে নেওয়া জয়েই নয়, পাকিস্তানিদের বিশ্বকাপ দেখতে বলতে গেলে আসতেই দেওয়া হয়নি ভারতে! গত ১৪ অক্টোবর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ সামনে রেখে ভিসার আবেদন করেছিলেন প্রচুর পাকিস্তানি সমর্থক। অথচ ক্রিকইনফোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে সেদিন পাকিস্তানের দর্শক ছিলেন মেরেকেটে তিনজন। সেটাও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সমর্থক।
এ ছাড়া পাকিস্তানের তিন হাজারের বেশি সংবাদকর্মী বিশ্বকাপ কাভার করতে ভিসার আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে তালিকাটা নিয়ে আসা হয় ৬০ জনে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তানের সংবাদকর্মী নাকি প্রেসবক্সে ছিলেন মাত্র তিনজন। যদিও এই তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। তবে পাকিস্তান দলকে যে ভ্রমণের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে ভিসা দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এ জন্য ভ্রমণ পরিকল্পনাও পাল্টাতে হয়েছিল পাকিস্তান দলকে।

রানপ্রসবা ও আইপিএল

ভারতের ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে রানপ্রসবা বিশ্বকাপের আশায়ই ছিলেন সবাই। সব ম্যাচে না হলেও সাড়ে তিন শ রানের বেশি হয়েছে একাধিক ম্যাচে। ১০টি ইনিংসে দলীয় রান ন্যূনতম সাড়ে তিন শ দেখা গেছে। আর কোনো বিশ্বকাপে দলীয় রান এত বেশিবার সাড়ে তিন শ পার হতে দেখা যায়নি। একবার চার শ পেরিয়ে যাওয়া স্কোরও দেখা গেছে, সেটি আবার বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সর্বোচ্চ রানের দলীয় ইনিংস (দক্ষিণ আফ্রিকা, ৪২৮/৫)। এখন টি-টোয়েন্টির যুগ, আর এই সংস্করণের সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আইপিএল ভারতেরই টুর্নামেন্ট, যেখানে রানের ফোয়ারা ছোটে। সেটাই আরেকটু বড় ব্যাপ্তিতে দেখা যাচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে। আইপিএল সামনে রেখেও অনেক খেলোয়াড় নিজেদের নিংড়ে দিচ্ছেন বিশ্বকাপে। ভারতের মাটিতে পারফর্ম করতে পারলে আইপিএলে যে কদর বাড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ভারতীয় ঘ্রাণ

ভারতে বিশ্বকাপ, অথচ নাচ-গান থাকবে না, বলিউডি ছোঁয়া থাকবে না, তা হয় না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবার হয়নি। অথচ লিগ পর্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বকাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বিনোদনের সব উপকরণই ছিল। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ম্যাচের আগে সংগীত পরিবেশন করেন অরিজিৎ সিং, সুনীধী চৌহান, শঙ্কর মহাদেবন ও সুখবিন্দুর সিংয়ের মতো জনপ্রিয় গায়কেরা। যে টুর্নামেন্টে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানই হলো না, সেই টুর্নামেন্টের একটি বিশেষ ম্যাচের (ভারত-পাকিস্তান) দিন এমন আয়োজন প্রশ্ন তুলেছে। আইসিসির টুর্নামেন্টে দুটি দলকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া কতটা ঠিক হলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) ভারতের সমর্থকেরাই মন্তব্য করেছেন, ‘শুধু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এসব কেন? কেন অন্য দলগুলোর ম্যাচেও এটা করা হবে না? এগুলো অন্য দলগুলোর প্রতি অসম্মানজনক।’

বিশ্বকাপে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচের আগে মাঠের মঞ্চে গান গেয়েছেন অরিজিৎ সিং

আসলে ক্রিকেট যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেখানে ক্রিকেটীয় চেতনা পৌঁছানোর সুযোগ এখন খুব কমই। নব্বই দশকের শুরুতে এই বিসিসিআই-ই ভারতের টিভি চ্যানেল দূরদর্শনকে ম্যাচ সম্প্রচারের জন্য প্রতি ম্যাচে পাঁচ লাখ রুপি করে দিত। এখন সেই বিসিসিআইকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ সম্প্রচারপ্রতি ৫৫ কোটি রুপি করে দেয় স্টার স্পোর্টস। অবশ্য দল যখন মাঠে ভালো করে, তখন এটাই স্বাভাবিক। এ বছর মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেমিফাইনাল খেলেছে ভারতের মেয়েদের জাতীয় দল। আর ছেলেদের বিশ্বকাপে তো ভারত এরই মধ্যে নিরঙ্কুশ ফেবারিট। অন্য সব ম্যাচে দর্শকসংখ্যা যাহোক, ভারতের ম্যাচে কিন্তু গ্যালারিতে ‘নীল সমুদ্র’ই দেখা যায়।

এই যে লাখ লাখ দর্শক, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এবং মাঠের বাইরে বোর্ডের প্রভাব-প্রতিপত্তি—এসবের সঙ্গে যদি রোহিত শর্মাদের মাঠের পারফরম্যান্সটাও যোগ করা হয়, তাহলে একটি শব্দই মাথায় আসে—ভারতীয় বিশ্বকাপ বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নতুন ঘ্রাণ!