তাঁকে থামানোর সাধ্য কার?
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটিং দেখে প্রশ্নটা উঠতে পারে। ব্যাট হাতে যখন যেটা করতে চাইছেন, সেটাই তো করছেন! বিশ্বসেরা স্পিনার রশিদ খান থেকে অক্ষর প্যাটেল কিংবা প্রসিধ কৃষ্ণার কথাই ধরুন—কেউই তো তাঁকে থামাতে পারছেন না।
ছন্দে থাকা ব্যাটসম্যানরা বোলারদের ওপর দাপট দেখাবেন, মাঝেমধ্যে দু-একটা অবিশ্বাস্য ইনিংসও খেলে ফেলবেন, এমনটা হতেই পারে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল যেটা করছেন, সেটা কী? অবিশ্বাস্যর চেয়েও বেশি কিছু?
২৫ অক্টোবর থেকে টাইমলাইন ধরুন। বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪০ বলে করলেন শতক,যেটা বিশ্বকাপের ইতিহাসেই দ্রুততম। এরপর বিশ্বকাপেই ৭ নভেম্বর আফগানিস্তানের বিপক্ষে যা করেছেন, সেটাকে তো অনেকেই ওয়ানডেতে সর্বকালের সেরা ইনিংসেরও স্বীকৃতি দিয়েছেন।
সে ম্যাচে রীতিমতো (ক্র্যাম্প) এক পায়ে দাঁড়িয়ে ১২৮ বলে ২১ চার, ১০ ছক্কায় করেছিলেন ২০১! সুইপ, রিভার্স সুইপ, ফ্লিক, স্ম্যাশ—তাঁর মন যখন যা চেয়েছে, সেভাবেই করেছেন। মাংসপেশির টান নিয়ে যতই ব্যথায় কাতর হয়েছেন, আফগান বোলারদের ব্যথা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন।
সেদিন ম্যাক্সওয়েল-প্যাট কামিন্স অষ্টম উইকেটে ১৭০ বলে অবিচ্ছিন্ন ২০২ রানের জুটি গড়েছিল, যে জুটিতে ম্যাক্সওয়েলের একার অবদানই ১০২ বলে ১৭৯! আর কামিন্সের ৬৮ বলে ১২। এসবই ম্যাক্সওয়েল করেছিলেন ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে অনেকটাই এক পায়ে দাঁড়িয়ে। আফগানদের সঙ্গে সেদিন হেরে বসলে অস্ট্রেলিয়ার অহমে নিশ্চিতভাবেই আঘাত লাগত। তাতে শক্ত মানসিকতার অস্ট্রেলিয়াকে আর পরে দেখা যেত কি না, সেটাই প্রশ্ন!
গতকালের ইনিংসে আসা যাক। ভারতের ২২৩ রান তাড়া করতে নেমে ষষ্ঠ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার ২ উইকেট পড়ার পর ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে নামেন, অস্ট্রেলিয়ার দরকার ৮৬ বলে ১৫৭ রান। সেখান থেকে ১০ ওভার শেষে হিসাবটা দাঁড়ায় ৬০ বলে ১১৮ রানে, ১৫ ওভার শেষে সমীকরণ ছিল ৩০ বলে ৭৮ রানের। ম্যাক্সওয়েল ততক্ষণে ২৮ বলে অর্ধশতক পেয়ে গেছেন। কিন্তু তখনো অস্ট্রেলিয়ার জয় অনেক দূরের পথ।
দলীয় ১২৮ রানে মার্কাস স্টয়নিস আউট হন, ১৩৪ রানে ফেরেন টিম ডেভিড। আর শেষ দুই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪৩ রান, শেষ ওভারে ২১। শেষ দুই বলে ৬, ব্যক্তিগত শতকের জন্য চার। এমন অনেক কঠিন সমীকরণ ৪৮ বলে ১০৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে কী অবলীলায় মিলিয়ে ফেললেন ম্যাক্সওয়েল!
গতকালের শতকটি আরও একটি কারণে বিশেষ। ক্যারিয়ারের শততম টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শতক করেছেন ম্যাক্সওয়েল। এর আগে সর্বোচ্চ ছিল রোহিত শর্মার, ৮৫ রান। এই তিন ইনিংসে পাশাপাশি রেখে একবার ভেবে দেখুন, প্রশ্নটা জাগে কি না! এই ম্যাক্সওয়েলকে থামাবেন কে?
ম্যাক্সওয়েল নিজেই অবশ্য থামতে জানেন। এই তো গত বছরের নভেম্বরে বন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপন করতে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। জন্মদিন অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বন্ধুর সঙ্গে দৌড়ানোর সময় বাড়ির উঠোনে পা পিছলে পড়ে যান। একটি ধাতব প্লেট তাঁর বাঁ পায়ে ঢুকে যায়। সেই চোট থেকে সেরে উঠতে পায়ে অস্ত্রোপচারও করাতে হয়েছে। এরপর ভারত বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে সতীর্থের সঙ্গে গলফ খেলতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে অসাবধানতাবশত চলন্ত গলফ কার্ট (একধরনের ছোট গাড়ি) থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। কনকাশন (মাথায় আঘাতজনিত) প্রটোকল মেনে তাঁকে ছয় দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওই ইনিংস খেলেছিলেন চোট থেকে ফিরেই।
আর মানসিক অবসাদের কারণে ক্রিকেট থেকে সাময়িক বিরতিতে গিয়েছিলেন ২০১৯ সালের অক্টোবরে। সে বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া দল ছেড়ে চলে যান ম্যাক্সওয়েল। পরে জানা যায়, মানসিক অবসাদে ভুগছেন, যে কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্রিকেট থেকে দূরে থাকবেন। সেই বিরতি নিয়েও তখন কম আলোচনা হয়নি!
ম্যাক্সওয়েল যখন যেভাবেই থামুন না কেন, এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। গতকালই ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড টি-টোয়েন্টিতে ম্যাক্সওয়েলকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাক্সওয়েল শততম টি-টোয়েন্টিতে শতক পেয়েছেন। এটা তাঁর জন্য বিশেষ কিছু।’
অস্ট্রেলিয়ান এই তারকা এরই মধ্যে ভারত ছেড়েছেন। সিরিজে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে তিনি খেলছেন না।
গতকাল ম্যাক্সওয়েল নিজেও খরুচে ছিলেন। এক ওভারে দিয়েছিলেন ৩০ রান। ওয়েড বলছেন, ওই ৩০ রান না দিলে শতক পাওয়া হতো না ম্যাক্সওয়েলের, ‘ ৩০ রান ম্যাক্সওয়েল এক ওভারে খরচ না করলে তাঁর শতক পাওয়া হতো না। আমাদের এই জয়টা খুবই প্রয়োজন ছিল। অনেক ক্রিকেটারই অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গেছেন, তরুণদের জন্য ভারতে খেলার কৌশল জানার সুযোগ ছিল। আশা করি পরের ম্যাচে জিতে সিরিজটিকে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ পর্যন্ত নিতে যেতে পারব।’