অ্যালেন স্টানফোর্ড
অ্যালেন স্টানফোর্ড

উৎপল শুভ্রর লেখা

ক্রিকেটকে টাকায় ভাসানো এক আমেরিকানের উত্থান ও পতনের গল্প

‘ওহ্, স্যার অ্যালেন’—অ্যালেন স্টানফোর্ড নামটা শুনেই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ট্যাক্সি ড্রাইভার।

কুলিজ ক্রিকেট মাঠে যাচ্ছি, অ্যালেন স্টানফোর্ডকে তাই মনে পড়ারই কথা। অ্যান্টিগায় নেমেই আসলে মনে পড়েছে। ভি. সি. বার্ড বিমানবন্দরের ঠিক পাশেই যে এই মাঠ। এক সময় যেটির নাম ছিল এয়ারপোর্ট ক্রিকেট গ্রাউন্ড। ২০০৪ সালে অ্যালেন স্টানফোর্ড যেটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছবির মতো সুন্দর এক মাঠ বানিয়ে নাম দেন স্টানফোর্ড ক্রিকেট স্টেডিয়াম।

ট্যাক্সি ড্রাইভারের মতো অ্যান্টিগার অনেকেই দেখছি, অ্যালেন স্টানফোর্ডকে এখনো ‘স্যার অ্যালেন’ বলেন। তা ‘স্যার’ তিনি হয়েছিলেন বটে, ২০০৬ সালে অ্যান্টিগার স্বাধীনতা দিবসে স্টানফোর্ডকে নাইটহুড উপাধি দিয়েছিল অ্যান্টিগা ও বারবুডার সরকার। ২০০৯ সালে আর্থিক জালিয়াতির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর যা ফিরিয়ে নেওয়া হয়।  

অ্যালেন স্টানফোর্ডের উত্থান ও পতনের মাঝের ওই তিন বছরে অ্যান্টিগায় এমনই ছাপ ফেলে গেছে যে, এখানকার মানুষ তাঁকে ভুলতে পারেনি। একটা আফসোসও দেখলাম সবার মধ্যেই-আহা, লোকটা যদি এমন প্রতারক না হতো!

অ্যান্টিগার অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছিলেন স্টানফোর্ড

অ্যান্টিগায় নানা কিছু করে ছোট্ট এই দেশের অর্থনীতিতেই বড় প্রভাব ফেলেছিলেন স্টানফোর্ড। এতটাই যে, তাঁর পতনের পর সেটির বিরূপ প্রভাবও পড়েছে অর্থনীতিতে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। অ্যান্টিগার সঙ্গে ছোট্ট আরেক দ্বীপ বারবুডা মিলে অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা নামের এই দেশে অ্যালেন স্টানফোর্ডকে ‘ঈশ্বরপ্রেরিত দূত’ মনে করত এখানকার মানুষ। আসলে যে অন্য কিছু-এটা তাই বড় ধাক্কা তাদের কাছে।

অ্যালেন স্টানফোর্ড এখন টেক্সাসের জেলে। হাজার হাজার কোটি টাকার (৭ বিলিয়ন ডলারের পঞ্জি স্কিম) জালিয়াতির দায়ে ২০১২ সালে তাঁর ১১০ বছরের জেল হয়েছে। টেক্সাসেরই মানুষ। পরে না অ্যান্টিগারও নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

অ্যান্টিগায় ‘দ্য সান’ নামে একটা পত্রিকা বের করেছিলেন। একই নামে সেন্ট কিটস থেকেও আরেকটি। এর বাইরেও আরও অনেক কিছুই। আমরা শুধু ক্রিকেটেই থাকি। ক্রিকেট ইতিহাসের নাটকীয় এক অধ্যায়ের নায়ক এই অ্যালেন স্টানফোর্ড। নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে যাওয়ায় পরে যেটি হয়ে গেছে কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। যে কলঙ্ক শুধু অ্যান্টিগার গায়েই লাগেনি, লেগেছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের গায়েও।

এতটাই যে, ২০০৮ সালের ওই দিনটিকে পারলে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলত ইসিবি। যেদিন ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে হেলিকপ্টার নিয়ে নেমেছেন অ্যালেন স্টানফোর্ড। ইসিবির কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে জামাই আদরে বরণ করে নিয়েছেন। বিশাল এক ট্রাংক ভর্তি ডলার আর ডলার সামনে নিয়ে ছবি তুলেছেন স্টানফোর্ডের সঙ্গে। ইংল্যান্ড আর অ্যান্টিগার দুই কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইয়ান বোথাম ও ভিভ রিচার্ডসও আছেন সেই ছবিতে।

উপলক্ষ কী? উপলক্ষ ইংল্যান্ড দলের সঙ্গে স্টানফোর্ড সুপারস্টারসের বাৎসরিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ঘোষণা দেওয়া। ইসিবির সঙ্গে স্টানফোর্ডের পাঁচ বছরের চুক্তি। পাঁচ বছরে পাঁচটি ম্যাচের জন্য মোট প্রাইজমানি ১০ মিলিয়ন ডলার। ‘উইনার্স টেক ইট অল’ নীতিতে প্রতি ম্যাচে বিজয়ী দল পাবে ২ মিলিয়ন ডলার। তখন এটা অকল্পনীয় একটা অঙ্ক।

অ্যান্টিগার কুলিজ ক্রিকেট গ্রাউন্ড বিমানবন্দরের ঠিক পাশেই

২০০৮ সালের ১ নভেম্বর প্রথম ম্যাচটিও হয়ে গেল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্টানফোর্ড সুপারস্টারস নামে মাঠে নামা দলটি আসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজই। ইংল্যান্ডকে ৯৯ রানে অলআউট করে ১০ উইকেটে জিতে যারা পেয়ে গেল ২০ লাখ ডলার। মাঠের বাইরের বিতর্কই অবশ্য বড় হয়ে উঠেছিল ম্যাচশেষে। টেলিভিশন ক্যামেরা ম্যাচ চলার সময় বারবারই ধরেছে অ্যালেন স্টানফোর্ডকে। ধরেছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের স্ত্রী ও বান্ধবীদের সঙ্গে তাঁর মাত্রা ছাড়ানো আহ্লাদের সময়ও। বলতে গেলে তাঁদের জড়িয়ে ধরে খেলা দেখেছেন।

উইকেটকিপার ম্যাট প্রায়রের অন্ত:স্বত্ত্বা স্ত্রী তো স্টানফোর্ডের কোলেই বসে ছিলেন। পরে স্টানফোর্ড ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের কাছে ক্ষমা চান। তিনি নাকি ওদের পরিচয় জানতেন না। ইসিবি তো নয়ই, ইংল্যান্ডের কোনো ক্রিকেটারও টুঁ শব্দটি করেননি। টাকার বড় মহিমা।

এর কিছুদিন পরই স্টানফোর্ডের আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতি নিয়ে খবর বেরোতে শুরু করে। এরপর তো গ্রেপ্তার, বিচার ও প্রকারান্তরে আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তি। ২০ লাখ ডলার প্রাইজমানির ম্যাচ তাই ওই একটিই। তা ইংল্যান্ডের মতো একটা দেশের ক্রিকেট বোর্ড একজন ব্যক্তির সঙ্গে এত বড় একটা চুক্তি কীভাবে করে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে সময়টা মনে রাখতে হবে। মাত্রই আইপিএলের সাড়ম্বর আবির্ভাব ঘটেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্ম দিয়েছে ইংল্যান্ড আর তা দিয়ে টাকা কামাচ্ছে ভারত। ইসিবি তখন উদভ্রান্ত। সেই সময়ে অ্যালেন স্টানফোর্ডের ওই প্রস্তাব যেন মেঘ না চাইতেই জল।

পরে বোঝা গেছে, ক্রিকেটটাকে তাঁর প্রোফাইল বাড়ানোর একটা বাহন হিসেবেই নিয়েছিলেন স্টানফোর্ড। ২০০৪ সালে স্টেডিয়াম বানানোর দুই বছর পর এই মাঠেই শুরু করেন স্টানফোর্ড টোয়েন্টি-টোয়েন্টি।

স্টানফোর্ডকে ১১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে

মনে রাখতে হবে, তখনো আইপিএল শুরু হয়নি। ২০০৮ সালে স্টানফোর্ড টোয়েন্টি-টোয়েন্টির দ্বিতীয় আসর ৩০ কোটি টেলিভিশন দর্শক পেয়েছে। বিজয়ী ত্রিনিদাদ দল পেয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সেটি ফাইনালে কাদের হারিয়ে, জানা না থাকলে অনুমান করতে পারবেন না। ইংল্যান্ডের মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট দল। ইংলিশ ক্রিকেটের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পরিকল্পনাটা মাথায় নিয়েই এগিয়েছিলেন অ্যালেন স্টানফোর্ড।

কুলিজ ক্রিকেট মাঠ নাম নেওয়া এক সময়ের স্টানফোর্ড ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সদর দপ্তর। অ্যালেন স্টানফোর্ডের নামগন্ধও এখন নেই। মাঠটা অবশ্য খুব একটা বদলায়নি। ২০০৭ সালে যেমন দেখেছিলাম, এখনো ঠিক তেমনই আছে। মাঠের পাশেই নিজের জন্য একটা ভিলা বানিয়েছিলেন স্টানফোর্ড। এখনো তা আছে, শুধু সামনের সুইমিংপুলটা স্টানফোর্ডের জীবনের মতোই শুকিয়ে গেছে।

স্টানফোর্ডের নামগন্ধও নেই কথাটায় অবশ্য একটু ভুল থেকে যাচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে নামটা এক জায়গায় পাওয়া গেল। প্যাভিলিয়নে একটা শোকেসে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের বিভিন্ন দলের ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর করা ব্যাট, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের পুরোনো একটা ব্লেজার, এর পাশেই স্টানফোর্ড টোয়েন্টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ম্যাচসেরার একটা ট্রফি। সেখানেই খোদাই করা ওই নাম। সাধারণ ট্রফির চেয়ে তিন/চার গুণ বড়। সবকিছু বৃহদাকারে দেখার স্টানফোর্ডীয় দৃষ্টিভঙ্গি এখানেও প্রতিফলিত।

অ্যালেন স্টানফোর্ড এখন টেক্সাসের জেলে

প্রথমবার এই মাঠে এসে রেস্টুরেন্টের নামটাও খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। স্টিকি উইকেট। স্টিকি উইকেট কাকে বলে জানেন হয়তো। ক্রিকেটে যখন উইকেট ঢেকে রাখার চল ছিল না, বৃষ্টিতে ভেজা উইকেট রোদ ওঠার পর ভয়ংকর হয়ে উঠত। ব্যাটসম্যানশিপের চরম পরীক্ষা নেওয়া সেই উইকেটকেই বলা হতো স্টিকি উইকেট। রূপক অর্থে যা অন্য ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। অ্যালেন স্টানফোর্ডের বেলায় যা অনায়াসে ব্যবহার করা যাচ্ছে।

কী করছেন, নিজে তো ঠিকই জানতেন। জানতেন, স্টিকি উইকেটে খেলছেন। আউট হয়ে যাবেন, এটাই হয়তো ভাবেননি কখনো।