বাংলাদেশের লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন
বাংলাদেশের লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন

উৎপল শুভ্রর লেখা

রিশাদ যখন বিশ্বকাপের বড় পাওয়া

রিশাদ হোসেনের পারফরম্যান্সে সবচেয়ে বেশি খুশি কে? অবশ্যই রিশাদ হোসেন নিজে। এটা অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর হলো না। ভালো কিছু করতে পারলে সবচেয়ে খুশি তো সেই পারফরমারই হবেন, এটা আবার বলার কী আছে!

প্রশ্নটা মনে আসার কারণ অন্য। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের লেগ স্পিনারের ট্রাম্প কার্ড হয়ে দেখা দেওয়ায় সবচেয়ে খুশি মানুষটার নাম চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বলতে পারেন, এই বিশ্বকাপের রিশাদ হোসেন হাথুরুসিংহের দীর্ঘদিন লালিত একটা স্বপ্নপূরণও। দিনের পর দিন যিনি অন্য দলগুলোকে কবজির মোচড়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে দেখেছেন আর আক্ষেপ করেছেন, বাংলাদেশ দলেও কবে এমন একজন আসবে!

লেগ স্পিনকে বলতে পারেন ক্রিকেটের দুরূহতম শিল্প। কবজির মোচড়ে বল ঘোরানোর কাজটাই তো ঠিক স্বাভাবিক নয়। সেটিও হয়তো অনেকেই পারেন, কিন্তু লাইন-লেংথের সঙ্গে সেটিকে সমন্বিত করাটা সহজ কাজ নয়। এটি আয়ত্ত করা যেমন কঠিন, তেমনি ব্যাটসম্যানদের জন্যও কঠিন তা সামলানো। লেগ স্পিন অনেক সময়ই খরুচে হবে, কিন্তু উইকেট নিয়ে আপনাকে ম্যাচও জেতাবে। লেগ স্পিনাররা হলেন ক্রিকেটের সত্যিকার ম্যাচ উইনার।

এমনভাবে লেগ স্পিনের গুণকীর্তন করছি, যেন কেউ তা জানেন না। এসব কি আর আপনার অজানা! তাহলে এটাও হয়তো অজানা নয় যে বাংলাদেশের ক্রিকেট লেগ স্পিনের মহিমা বুঝতে কেমন অপারগ। ঘরোয়া ক্রিকেটে লেগ স্পিনারদের কেমন ছোঁয়াচে রোগীর মতো দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

অনুশীলনে রিশাদ হোসেন। পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর বোলিং পর্যবেক্ষণ করছেন বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ মুশতাক আহমেদ

অথচ কে না জানে, লেগ স্পিনারদের পরিচর্যা করতে হয়, চার-ছয় খেয়ে গেলেও তাঁদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়, পিঠে হাত রেখে তাঁদের বেড়ে উঠতে দিতে হয়। আর তা করলে যে প্রতিদান পাওয়া যায়, অন্য কোনো প্রকৃতির বোলার মনে হয় না তা দিতে পারে। একটা-দুইটা বলেই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অন্য বোলারদের নেই, এমন নয়। তবে লেগ স্পিনারের মতো এতটা হয়তো নয়।

হাথুরুসিংহে নিজে লেগ স্পিন বোলিংয়ের বড় ভক্ত। প্রথমবার বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পরই যা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এই বিশ্বকাপে রিশাদ যা করছেন, ২০১৫ বিশ্বকাপেও আরেক লেগ স্পিনারের তা করার ক্ষমতা ছিল বলে যিনি এখনো বিশ্বাস করেন। জুবায়ের হোসেনকে বিশ্বকাপের দলে নিতে নির্বাচকদের সঙ্গে শুধু মারামারি করতে বাকি রেখেছিলেন। হাথুরুর যুক্তি ছিল একটাই, ও হয়তো মার খাবে, কখনো পুরো ১০ ওভারও করতে পারবে না, কিন্তু উইকেট নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবে।

বলাই বাহুল্য, নির্বাচকেরা তাতে কান দেননি। জুবায়েরের ডাকনাম লিখন। বাংলাদেশে লেগ স্পিনার হলে অনাদরে-অবহেলায় হারিয়ে যাওয়াটাও যেন কপালের লিখন। টেস্ট অভিষেকেই দারুণ এক গুগলিতে বিরাট কোহলিকে বোল্ড করার পর সাকিব আল হাসান যাঁকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই ছেলে একদিন টেস্টে ৪০০ উইকেট নেবে; সেই জুবায়ের এখন কোথায়, কেউ জানে না।

রিশাদ এখন পর্যন্ত ভাগ্যবান। বয়সভিত্তিক দল থেকে জাতীয় দল পর্যন্ত যাত্রাপথে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের আনুকূল্য না পেলেও ক্রিকেট বোর্ডের যত্ন পেয়েছেন। প্রতিদান কী দিচ্ছেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এই বিশ্বকাপের তিন ম্যাচের যে দুটিতে জিতেছে বাংলাদেশ, দুটিতেই তাঁর ৩টি করে উইকেট।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৭ উইকেট নিয়েছেন রিশাদ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে তাঁর উইকেটই সবচেয়ে বেশি

শুধু উইকেটের সংখ্যা দিয়ে অবশ্য রিশাদ-মহিমা বোঝা যাবে না। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান বারবার একটা কথা বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন। টি-টোয়েন্টিতে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স কিছু নয়, শুধু রান আর উইকেট দিয়ে তা বিচার করাও ভুল, এখানে দেখতে হবে দলে কে কতটা অবদান রাখতে পারছেন।

রিশাদের উইকেটগুলোকেও দেখতে হবে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে। কখন উইকেট নিয়েছেন, কোন পরিস্থিতিতে নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচসেরার স্বীকৃতিই বলে দিচ্ছে সেই ম্যাচে রিশাদের অবদান। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও পুরস্কারটা রিশাদকে দিলে মনে হয় না তা অন্যায় হতো। সাকিবের অপরাজিত ৬৪ রানের অবশ্যই এই জয়ে বড় অবদান, তবে সেই জয় তো মরীচিকার মতো মিলিয়ে যেতে বসেছিল। তারপর যা হলো, তা অনেকটা শ্রীলঙ্কা ম্যাচেরই পুনরাভিনয়। ১ ওভারে রিশাদের ২ উইকেটে ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশ। ডালাসে তা ছিল ম্যাচের প্রথম ইনিংস, সেন্ট ভিনসেন্টে দ্বিতীয়—পার্থক্য বলতে এটুকুই।

লেগ স্পিন অনুরাগী কোচ অবশ্যই রিশাদের জন্য বড় পাওয়া। তবে কোচ তো আর মাঠে থাকেন না। মাঠে থাকেন অধিনায়ক, লেগ স্পিনারের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে যাঁর ওপর। তা শুধু ফিল্ডিং সাজানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। লেগ স্পিনারকে কখন আগলে রাখতে হবে, কখন আনতে হবে আক্রমণে—অধিনায়কের এই জানাবোঝাটা খুব জরুরি। সম্ভবত তার চেয়েও জরুরি বোলারকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তাঁর ওপর অধিনায়কের আস্থা আছে।

অধিনায়ক নাজমুলের আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন রিশাদ

নাজমুল হোসেনের অধিনায়কত্ব জীবনের মাত্রই শুরু। তবে এই কাজটা খুব ভালো করছেন। নেদারল্যান্ডস যখন ম্যাচ বের করে নিয়ে যাচ্ছে, রিশাদের হাতে বল তুলে দিয়েছেন। প্রথম বলে ছক্কা খেয়ে বসার পরও বলেছেন, ‘আমি জানি, তুই পারবি।’

রিশাদ পেরেছেনও। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সুপার এইটে উঠেই গেছে বলা যায়। সুপার এইট অবশ্যই বড় এক অর্জন। তবে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাওয়া এটি নয়।

সবচেয়ে বড় পাওয়ার নাম রিশাদ হোসেন।