এজবাস্টন টেস্টে ম্যাচসেরা হওয়া উসমান খাজা লর্ডসেও রান পেয়েছেন
এজবাস্টন টেস্টে ম্যাচসেরা হওয়া উসমান খাজা লর্ডসেও রান পেয়েছেন

খাজায় ‘বন্দী’ বাজবল

উসমান খাজা যদি অস্ট্রেলিয়ার না হয়ে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় হতেন, এবারের অ্যাশেজে কি ডাক পেতেন?

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা যেতে পারে সিরিজপূর্ব বেন স্টোকসের কথায়। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেইন স্টোকসের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তরুণ বয়সের অ্যালিস্টার কুক, জোনাথন ট্রট বা মাইকেল আথারটনরা ইংল্যান্ডের এই দলে জায়গা পেতেন কি না? এই দল বলতে ‘বাজবল’ ক্রিকেট খেলা দল, যাঁদের মূল মন্ত্র ম্যাচ আনন্দদায়ক করে তুলতে ফলকেন্দ্রিক আক্রমণাত্মক ও অতি ইতিবাচক ক্রিকেট খেলা।

জবাবে স্টোকস কূটনৈতিক ভাষার আশ্রয় নেননি। সোজাসাপটাই বলেছেন, ‘এই যুগে এসে এই সময়ে, যখন আমি অধিনায়ক বাজ (ম্যাককালাম) কোচ, তখন এমন কিছু আমরা ভাবতাম না। এটাই সত্যি। আমরা চাই এমন খেলোয়াড়, যারা মাঠে নেমে বোলারকে শাসন করবে।’

কুক, ট্রট বা আথারটনের বেলায় যা হওয়ার কথা, প্রায় একই ধারার ব্যাটিং করা খাজার বেলায়ও অন্যথা হওয়ার কথা নয়। যার মানে, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার হলে এবারের অ্যাশেজে খাজার জায়গা হতো না। বাজবল ক্রিকেটে খাজা অনাহূত।

পরিহাস হচ্ছে, এই মুহূর্তে অ্যাশেজে ইংল্যান্ড যখন প্রথম টেস্ট হেরে আরেকটিতে হারের চোখরাঙানির সামনে, সমালোচনা হচ্ছে স্টোকসদের ক্রিকেট অ্যাপ্রোচের, তখন উড়ন্ত ‘বাজবল’কে আপাত সময়ের জন্য হলেও মাটিতে নামিয়ে আনার পেছনে মূল কারিগর যিনি, সে নামটিই খাজা। উসমান খাজা!

লর্ডস টেস্টের তৃতীয় দিন পর্যন্ত সিরিজে দুই দলের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান উসমান খাজার

২০২৩ অ্যাশেজে এখন পর্যন্ত হওয়া ৮ দিনের খেলায় ইংল্যান্ডকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী এই বাঁহাতি ওপেনার। ইংল্যান্ড যে নিজেদের বাজবল ক্রিকেট দিয়ে ডানা মেলতে পারছে না, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার প্রথাগত ক্রিকেট স্টোকসদের পরিকল্পনাকে ইচ্ছামতো বাস্তবায়নের সুযোগ দিচ্ছে না, তাতে সবচেয়ে বড় বাধা এই খাজাই।

কী করেছেন খাজা?

এখন পর্যন্ত খেলা হওয়া আট দিনের মধ্যে চার দিনই অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন। এর মধ্যে তুলে নিয়েছেন একটি সেঞ্চুরি ও দুটি ফিফটি। দুই ফিফটির একটি আবার এখনো অসমাপ্ত। ৫৮ রান নিয়ে ব্যাট শুরু করবেন আজ লর্ডস টেস্টের চতুর্থ দিনে।

এজবাস্টন ও লর্ডস টেস্টের তৃতীয় দিন মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৭১১ বল খেলেছেন খাজা, যা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড দুই দলের সব খেলোয়াড়ের মধ্যে সর্বোচ্চ তো বটেই, দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্টিভেন স্মিথের (২৮১) দ্বিগুণেরও বেশি!

এজবাস্টন টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি ও ফিফটি করেন উসমান খাজা

বাজবল ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং-দর্শন হলো যত দ্রুত সম্ভব রান তুলে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা, আর বোলিংয়ে যত দ্রুত সম্ভব ২০ উইকেট তোলা। এ জন্য বোলার ব্যবহার, আক্রমণে বদল কিংবা অদ্ভুতুড়ে ফিল্ডিং সাজানোও স্বাভাবিক। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকা খাজার জন্য স্টোকসরা সেটি করতে পারছেন কোথায়?

সিরিজে কমপক্ষে ১০ বল খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে কম ৩৯.৫২ স্ট্রাইক রেট খাজারই। ইংল্যান্ড যে তিন পেসারকে কেন্দ্র করে অ্যাশেজের বোলিং আক্রমণ সাজিয়েছে, সেই জিমি অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড ও ওলি রবিনসনের মোট ৪৮৬টি বলের মুখোমুখি হয়েছেন খাজা।

এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ বলই ডিফেন্স করেছেন, আরও ২৪ শতাংশ স্রেফ ছেড়ে দিয়েছেন। বাকি ৩৭ শতাংশ বলে ১৭৩ রান তুলেছেন মাত্র ৩৫ স্ট্রাইক রেটে। ‘বাজবল’ ক্রিকেটের বোলিংটা বড় ধাক্কা খেয়েছে খাজার এই ‘চীনের প্রাচীর’সম ব্যাটিংয়ে।

দীর্ঘ সময় ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে খাজা প্রভাবিত করে তুলছেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংও। তা সময়ের দিক থেকে যেমন, তেমনি বাজবল দেখতে অভ্যস্ত দর্শকের সামনে প্রথাগত ক্রিকেটের সাফল্য তুলে ধরার মাধ্যমেও। জিওফ বয়কট তো বলেই দিয়েছেন, অ্যাশেজ আনন্দদায়ক খেলার মঞ্চ নয়, মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে জেতার মঞ্চ।

মর্যাদার এই লড়াই শেষ পর্যন্ত কে জেতে, তা দেখতে এখনো বাকি চারটি টেস্ট। তবে দেড় টেস্টের মধ্যে যে অস্ট্রেলিয়া অনেকখানি এগিয়ে গেল, বাজবল ক্রিকেট এটুকু সময়ের জন্য হলেও ‘বোতলবন্দী’ হয়ে পড়ল, তাতে খাজার অবদানই বেশি।

অস্ট্রেলিয়াকে ভালো শুরু এনে দিচ্ছেন খাজা

এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে শুরুর ছন্দটা খাজা ধরিয়ে দিয়েছেন। চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের মাটিতে যে সিরিজটি ড্র করে গিয়েছিল, সেটিতে ‘ফ্লপ’ ছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার, ক্যামেরন ব্যানক্রফট ও মার্কাস হ্যারিসরা। তিন ওপেনারের ২০ ইনিংস থেকে অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল ১৯৭ রান। এবার এক খাজার চার ইনিংস থেকেই এসেছে ২৮১ রান।

এমন দারুণ শুরুর পর এই অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার হার একটু বেশিই নির্মম দেখাবে। যেমনটা বাজবলের বিপরীতে রূঢ় দেখাচ্ছে খাজার ব্যাটিং।