বাঁ থেকে এমকেএস স্পোর্টসের চার মালিক ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ, ইমরুল কায়েস, মেহেদী হাসান মিরাজ ও এইচ এম আফতাব শাহীন
বাঁ থেকে এমকেএস স্পোর্টসের চার মালিক ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ, ইমরুল কায়েস, মেহেদী হাসান মিরাজ ও এইচ এম আফতাব শাহীন

‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্যাটে বড় ছক্কার যন্তর–মন্তর

টাকা দিয়ে নাকি বাঘের চোখও কেনা যায়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও টাকা দিয়ে কম কিছু কিনছেন না। দামি গাড়ি, বড় বাড়ি তাঁদের অনেকের সামর্থ্যের তুলনায় বাড়াবাড়ি কিছু নয়। কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের দুঃখ হলো যখন জানা গেল, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টাকা খরচ করেও ভালো একটা ব্যাটই কিনতে পারেন না!

ক্রিকেটাররা ব্যাট পান স্পনসরদের মাধ্যমে অথবা বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাটই নাকি গুনে-মানে সেরা হয় না। বিদেশ থেকে চাহিদামাফিক ব্যাট বানিয়ে আনতে গেলেও প্রত্যাশাপ্রাপ্তির মধ্যে হাহাকার থেকে যায়। তেজস্বী ব্যাটিংয়ে বিশাল ছক্কায় বল মাঠছাড়া করার ব্যাট হয় না সেগুলো। এসব ব্যাট দিয়ে মারা ছক্কা কোনোরকমে বাউন্ডারি রশি পার করা ছক্কা। ইংরেজ, অজি বা ভারতীয় ছক্কার চেয়ে বাংলাদেশের ছক্কা তাই ছোট। রোহিত-কোহলিরা যে শট খেলেই নিশ্চিন্ত হয়ে যান, বল আর মাঠের ধারেকাছে থাকছে না, সে রকম শট খেলে তামিম-মুশফিকরা টেনশনে চেয়ে থাকেন—বল মাঠ পার হবে তো! আমরা বলি গায়ে জোর কম, টেকনিকে সমস্যা। কিন্তু আসলে নাকি ব্যাটের পার্থক্যও অপুষ্টিতে ভোগা ছক্কার একটা কারণ!

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাট নিয়ে এ দুঃখের কথা জানা গেল কাল রাতে, ব্যাট নিয়েই হওয়া এযাবৎকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়োজনে। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, যাদের বানানো ব্যাট এরই মধ্যে আইসিসির স্বীকৃতিও পেয়েছে বলে খবর, ঢাকার শেরাটন হোটেলে সেই ‘এমকেএস স্পোর্টসে’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে কাল। পত্রপত্রিকায় আগে থেকেই লেখালেখি হওয়ায় ‘এমকেএস স্পোর্টস’ এরই মধ্যে অনেকের কাছে পরিচিতি পেয়ে গেছে। জাতীয় দলের দুই ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস ও মেহেদী হাসান মিরাজ সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায়। সঙ্গে আছেন দেশি-বিদেশি ক্রিকেটারদের কাছে ‘ব্যাট-ডক্টর’ নামে পরিচিত এইচ এম আফতাব শাহীন ও ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ।

যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ছাড়াও সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো তারকা ক্রিকেটারদের উপস্থিতি ‘এমকেএস স্পোর্টসে’র শুরুটাকে করে দিল আলোঝলমলে। একই অনুষ্ঠানে হয়েছে www.mkscricket.com ওয়েবসাইটের উদ্বোধনও, যেখানে ঢুকে অনলাইনে কেনা যাবে এমকেএসের ব্যাট।

অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানকে স্মারক উপহার প্রদান করে এমকেএস

কিন্তু এমন তারাঝলমলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠে ইমরুল বললেন তাঁর এক দুঃখের কথা। বছর কয়েক আগে একবার ভারত থেকে ব্যাট আনিয়েছিলেন তিনি। আনার পর সেই ব্যাট দিয়ে খেলে বুঝলেন, যে মানের ব্যাট চেয়েছিলেন, সে মানের ব্যাট দেওয়া হয়নি। টাকা দিয়েও মনের মতো ব্যাট না পেয়ে ব্যাট প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে মনোমালিন্যই হয়ে যায় ইমরুলের। তখন থেকেই তাঁর প্রতিজ্ঞা একদিন বাংলাদেশেও ভালো ব্যাটের কারখানা খুলবেন। ‘এমকেএস স্পোর্টস’ নামে ইমরুলের স্বপ্নের সেই কারখানাই এখন রাজশাহীতে। এসএস, গ্রেনিকলস যে কাঠ দিয়ে বানায়, রাজশাহীতে এমকেএসও নাকি সেই কাঠ দিয়েই ব্যাট বানাচ্ছে।

‘এমকেএস স্পোর্টস’কে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবাল। বক্তা হিসেবে তামিম বরাবরই সাবলীল। তার ওপর প্রসঙ্গ যখন ব্যাট, যেটা নিয়েই তাঁর কীর্তি-কারবার, বলা ভালো যেটা হাতে নিয়ে একটা গোটা জীবন পার করে দিচ্ছেন, সেই ব্যাট নিয়ে বক্তৃতায় তামিমের চেয়ে বাগ্মী আর কে হবেন!

ব্যাট এমন একটা জিনিস, যেটা নিয়ে বড় বড় ক্রিকেটার, বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক সংগ্রাম করে।
তামিম ইকবাল

তামিম শুরু করলেন প্রায় আদিকাল থেকে, যখন বিদেশি দলের সঙ্গে খেলা শেষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা প্রতিপক্ষের ড্রেসিংরুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন একটা ভালো ব্যাট পাওয়ার আশায়! কখনো পেতেন, কখনো পেতেন না। অনেক সময় মুখের ওপরই ‘না’ শুনে আসতে হতো। আসলে পুরোটাই নির্ভর করত যাঁর কাছে ব্যাট চাওয়া হতো, তাঁর দয়ার ওপর।

ব্যাট নিয়ে কথা বলছেন তামিম ইকবাল

অন্য দেশের ক্রিকেটারদের কাছে এ রকম ব্যাট চাওয়াটাকে তামিম প্রায় ‘ভিক্ষা’র সঙ্গেই তুলনা করলেও পরে বুঝিয়ে বলেছেন, তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ভালো ব্যাট কেনার সামর্থ্য ছিল না বা তারা লোভে পড়ে ব্যাট চাইতেন। বিষয়টা ছিল টাকা খরচ করেও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ওই মানের ভালো ব্যাট কিনতে পারতেন না। তাঁরা জানতেন, বিদেশিরা যে ব্যাট দিয়ে খেলেন, তাঁরা চাইলেও সে রকম ব্যাট কিনতে পারবেন না। তামিমের কণ্ঠে কষ্ট ঝরল, ‘ব্যাট এমন একটা জিনিস, যেটা নিয়ে বড় বড় ক্রিকেটার, বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক সংগ্রাম করে।’

তাঁর অবশ্য সৌভাগ্য, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট খেলার সময় বড় ভাই নাফিস ইকবালের কাছ থেকে পাওয়া সৌরভ গাঙ্গুলির একটা ব্যাট দিয়ে অনেক দিন খেলেছেন। পরে তো তামিম নিজেই বিদেশে গিয়ে চেয়ে–বেছে ব্যাট কেনা শুরু করেন। এখন বিদেশ থেকে ভালো ব্যাট কেনায় অন্য ব্যাটসম্যানদেরও ভালো গাইড তিনি। কিন্তু সেখানেও আছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। কথাটা তামিমের মুখ থেকেই শুনুন, ‘অনেক ক্রিকেটার ইন্ডিয়ায় যায়। দিল্লিতে নেমে মিরাটে ড্রাইভ করে যায় ব্যাট আনতে। কিন্তু যাদের কাছে যায়, তাদের ব্যবহার খুব একটা ভালো থাকে না।’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, টাকা দিয়েও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন ভালো ব্যাট পান না? ‘ব্যাট-ডক্টর’ শাহীনের কথায় যার উত্তর কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়া গেল। সেরা ব্যাট হয় ইংলিশ উইলো দিয়ে। তবে বিশ্বে ইংলিশ উইলো আছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির। তার মাত্র একটি দিয়েই নাকি বানানো হয় ক্রিকেট ব্যাট, যেটার নাম স্যালেক্স অ্যালভিন ইংলিশ উইলো। এই ব্যাটের আবার পাঁচটি গ্রেড। গ্রেড-১ বা সেরা মানের ব্যাটটা বাংলাদেশে আসে খুবই কম। শাহীনের তথ্যানুযায়ী, মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি ইংলিশ উইলোর ব্যাটগুলো এত ভালো নয়।

অনুষ্ঠানে ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও

বাংলাদেশে প্রতিবছর কমবেশি দুই লাখ ক্রিকেট ব্যাট বিক্রি হয় বলে জানানো হলো ‘এমকেএস স্পোর্টসে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, যার সবই আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু বিদেশ থেকে এলেও আসে আসলে দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির ব্যাট। ‘ব্যাট-ডক্টর’ হিসেবে শাহীনের অভিজ্ঞতা হয়েছে টেন্ডুলকার-বিরাট কোহলিদের ব্যাট নিয়েও কাজ করার। বাংলাদেশে এসে ব্যাটের সমস্যায় পড়ে তাঁর কাছেই ব্যাট ঠিক করতে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। এ সুযোগে শাহীনও মুখস্থ করে নিয়েছেন বড় বড় তারকা ব্যাটসম্যানের ব্যাটের যন্তর-মন্তর। দেখেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের সঙ্গে তাঁদের ব্যাটের কত পার্থক্য। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সে রকম ব্যাট পান না বললেই চলে।

ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা মারলে গ্যালারিতে উড়ে যাওয়া বড় বড় ছক্কা হয়, আর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সে রকম ছক্কা মারতে গেলে কেন ‘অক্কা’ পান, সে ধারণাও হয়ে গেল শাহীনের। মূল কারণ ভারতীয় খেলোয়াড়দের ব্যাট প্রস্তুতকারক বা স্পনসররা সেরা মানের ব্যাট দেয়, যেটা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দেয় না। চাকরির পাশাপাশি ২৪ বছর ব্যাট মডিফিকেশন ও কাস্টমাইজেশনের কাজ করা শাহীনও এরপর বুঝে যান কী মন্ত্র পড়ে বানাতে হবে বড় ছক্কার ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্যাট।

অন্য দেশে সিরিজ খেলতে গেলে ভারত তাদের ব্যাটসম্যানদের সে দেশের পিচ কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাট বানিয়ে দেওয়া হয়। এ সুবিধা পান না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। শাহীন, ইমরুল, মিরাজরা অবশ্য এমকেএস স্পোর্টসের হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁরাও পারবেন ব্যাটসম্যানদের চাহিদা ও কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাট বানিয়ে দিতে।

এ ক্ষেত্রে পিচ কন্ডিশনের সঙ্গে ব্যাটের ‘শেপ’ বা আকৃতিরও একটা সম্পর্ক দেখেন শাহীন। যেমন ধরুন, আপনি অস্ট্রেলিয়ার উইকেটে ব্যাটিং করছেন। সেখানে বল ওপরে আসবে। সেই উইকেটে যে আকৃতির ব্যাট দিয়ে খেলে স্বচ্ছন্দবোধ করবেন, সেটা করবেন না বাংলাদেশের উইকেটেও ওই ব্যাট দিয়ে খেললে। কারণ, বল এখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো ওপরে উঠবে না। কাজেই বাংলাদেশের উইকেটের জন্য চাই ভিন্ন আকৃতি বা ‘শেপে’র ব্যাট। শাহীনের বক্তব্য, ভারত নাকি এ কাজই করে আসছে। অন্য দেশে সিরিজ খেলতে গেলে তাদের ব্যাটসম্যানদের সে দেশের পিচ কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাট বানিয়ে দেওয়া হয়। এ সুবিধা পান না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। শাহীন, ইমরুল, মিরাজরা অবশ্য এমকেএস স্পোর্টসের হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁরাও পারবেন ব্যাটসম্যানদের চাহিদা ও কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাট বানিয়ে দিতে।

আর যদি ব্যাটসম্যানরা বিদেশি স্পনসরদের কাছ থেকেই ব্যাট আনেন, তাঁদের জন্য আছে তামিমের পরামর্শ, ‘এমন ব্যাট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকতে হবে, যে তোমাকে গুরুত্ব দেবে। গুরুত্ব না দিলে ভালো জিনিসও দেবে না।’

বড় ছক্কার ব্যাটের ফর্মুলা তো জানা গেল। এখন থেকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্যাটেও থাকবে সেই যন্তর-মন্তর। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ছক্কাগুলো এবার তাহলে মাঠ ছাড়িয়ে গ্যালারিও পার করুক।