বেন স্টোকস
বেন স্টোকস

বিশ্বকাপের যত ‘পরিযায়ী’ ক্রিকেটার

জন্ম এক দেশে, কিন্তু ব্যাটিং বা বোলিংয়ে ঝলক দেখিয়েছেন অন্য দেশের হয়ে। আবার জন্মভিটা ছেড়ে মা–বাবা নিয়েছেন নতুন দেশের নাগরিকত্ব। সেই দেশে সন্তানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটে হাতেখড়ি, একসময় সেই দেশেরই জাতীয় দলে খেলা, তাদের পতাকাতলে নিজেকে সমর্পণ।

তারপরও বাপ-দাদার জন্মভিটার ঘ্রাণ শরীর থেকে যায় না। মন পড়ে থাকে দূর দেশে। পরিচয় দিতে গিয়ে গর্ব হয়। এদের অভিবাসী ক্রিকেটার না বলে ‘পরিযায়ী ক্রিকেটার’ও বলা যায়। যদিও পরিযায়ী পাখির মতো তারা আর কুলায় ফেরে না।

বিশ্ব ক্রিকেটে কিংবদন্তির আসন নেওয়া এ রকম ক্রিকেটারদের মধ্যে রয়েছেন নাসের হুসেইন, মন্টি পানেসর, শিবনারায়ণ চন্দরপল, রামনরেশ সারওয়ান, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, কেভিন পিটারসেন, হাশিম আমলা, ইমরান তাহির, এউইন মরগান, ওসমান খাজা, সুনীল নারাইন, সিকান্দার রাজা। এঁরা কে কোন দেশের হয়ে খেলেছেন, আর আদতে কোন দেশের মানুষ, আমাদের জানা আছে। এ রকম নাম করলে আরও করা যায়। তবে দাদা ভারতের তামিলনাড়ুর মানুষ হলেও এ তালিকায় শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরনের নামটি যেন আসে না!

প্রয়াত অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের জন্ম ইংল্যান্ডে

আজ থেকে ভারতে শুরু হতে যাওয়া ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১০ দলের যে খেলোয়াড় তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, এর মধ্যেও রয়েছেন বেশ কয়েকজন পরিযায়ী ক্রিকেটার। এবার তাঁদের একটু চিনে নেওয়া যাক।

ইংল্যান্ড দলের অন্যতম ভরসার নাম বেন স্টোকস। তাঁর জন্ম নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। টেস্ট দলের নেতৃত্ব সামলানো স্টোকস ২০০৩ সালের পর বাচ্চা বয়সেই ইংল্যান্ডে চলে আসেন। বাবা জেরার্ড স্টোকস নিউজিল্যান্ডের নামী রাগবি খেলোয়াড় ও কোচ ছিলেন। এবং তিনি সে দেশেই থেকেছেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করতে স্টোকসের জাদুকরি ভূমিকা আমরা ভুলে যাইনি। এবারও হয়তো বিশেষ কিছু করে দেখাবেন খ্যাপাটে স্টোকস।

ইংল্যান্ড দলের অতি পরিচিত মুখ মঈন আলীর দাদা কাশ্মীরের মিরপুর (বর্তমানে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণাধীন) থেকে অভিবাসী হয়েছিলেন। মঈনের দাদি বেটি কক্স একজন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ, যিনি উর্দু ও পাঞ্জাবি জানতেন। বার্মিংহামে বেড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশের জামাতা’ মঈনের ভাই-ব্রাদাররাও ক্রিকেট খেলেন। তাঁদের মধ্যে কাদির আলী ও কবির আলীর নাম উল্লেখ করা যায়।

ইংল্যান্ড দলের আদিল রশীদের গল্পটা মঈনের গল্প থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তিনিও একজন মিরপুরি। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে চলে যায় আদিল রশীদের পরিবার। ব্র্যাডফোর্ডের বাসিন্দা আদিলের ভাই হারুন ও আমর দুজনই ক্রিকেটার।

মঈন আলী ও আদিল রশিদ

এবার চোখ রাখা যাক নিউজিল্যান্ড দলের দিকে। ইন্দেরবির সিং সোধি, সংক্ষেপে ইশ সোধি। জাতিগতভাবে পাঞ্জাবি সোধির জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানার এক শিখ পরিবারে। সোধির দাদা আদতে পাকিস্তানের লাহোরের মানুষ। চার বছর বয়সেই পরিবারের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের পাপাটোটোয় চলে যান। নিউজিল্যান্ড দলের স্পিন আক্রমণের প্রধান সেনানী এখন সোধি, যিনি বিশেষ করে বাংলাদেশের বিপক্ষে বেশ জ্বলে ওঠেন।

এই দলের অলরাউন্ডার রাচিন রবীন্দ্র। তাঁর বাবা রবি কৃষ্ণমূর্তি একজন সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট, যিনি ভারতের বেঙ্গালুরুর মানুষ। সেখানে ক্লাব ক্রিকেটও খেলেছেন। তিনি যে ছেলের নাম রাচিন রেখেছেন, এর একটা ইতিহাস আছে। রাহুল দ্রাবিড়ের ‘রা’ আর শচীন টেন্ডুলকারের ‘চিন’ মিলে রাচিন।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাবরেইজ শামসি, যার গুগলি ডেলিভারি এই মুহূর্তে খুবই আলোচিত, তিনিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। জোহানেসবার্গে জন্ম ও বেড়ে ওঠা শামসি উইকেট পাওয়ার পর উদ্‌যাপন করেন বেশ ‘ভদ্রভাবে’, এটার কারণে তাঁর সুনাম রয়েছে। স্ত্রীর নাম খাদিজা শরীফ, একটি সন্তান রয়েছে এই দম্পতির।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য কেশব মহারাজ। ভারতের উত্তর প্রদেশের সুলতানপুর থেকে তাঁর পূর্বপুরুষেরা জাহাজে চড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে পাড়ি জমিয়েছিলেন কাজের আশায়। সেটা সেই ১৮৭৪ সালে। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন বোলার কেশব ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এক দিনের ম্যাচে দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। নিচের দিকে বেশ ভালো ব্যাটও করেন তিনি।

প্রোটিয়া স্পিনার কেশব মহারাজের পূর্বপুরুষের ভিটা ভারতে

নেদারল্যান্ডস দলে আছেন সাকিব জুলফিকার, যাঁর বাবা জুলফিকার আহমেদ পাকিস্তানের শিয়ালকোটের মানুষ। জুলফিকার আহমেদ নিজেও নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট দলে খেলেছেন। ১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি দেশ ছেড়ে নেদারল্যান্ডস চলে যান। মজার ব্যাপার হলো, সাকিব ও তাঁর দুই ভাই সিকান্দার ও আসাদ একই সঙ্গে নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলে খেলেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে। একটি দেশের জাতীয় দলে তিন ভাইয়ের একসঙ্গে খেলা ক্রিকেট ইতিহাসে আছে কি!
নেদারল্যান্ডস দলে শারিজ আহমেদ নামের আরেকজন স্পিনার আছেন, যাঁর নাড়িও পাকিস্তানে পোঁতা। ২০ বছর বয়সী শারিজের বড় ভাই মুসা ডাচ জাতীয় দলে খেলেছেন। তাঁদের বাবা নাদিম আহমেদ লাহোর থেকে অভিবাসী হয়ে এসে নেদারল্যান্ডসের ক্লাব ক্রিকেটে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলে থাকা জশ ইংলিসের জন্ম ইংল্যান্ডে, মারনাস লাবুশেনের দক্ষিণ আফ্রিকায়।

উপমহাদেশের চারটি দল বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জাতীয় দলে কোনো ‘পরিযায়ী পাখি’ ক্রিকেটার নেই। একই কথা আফগানিস্তান দলের বেলাতেও।

ইমরান তাহির একবার বলেছিলেন, পাকিস্তানে ক্রিকেট খেললে হয়তো তাঁর নাম কেউ জানত না। জাতীয় দলে সুযোগই পেতেন না। স্ত্রীর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁকে অর্থ, সম্মান সবই দিয়েছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকাই তাঁর আপন দেশ।

কথাটা সব পরিযায়ী ক্রিকেটারের বেলায়ই খাটে। মনের গহিনে যতই নাড়ির টান থাকুক, বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁরা সাফল্য চাইবেন নিজের দলের। এটাই যে এখন তাঁদের আপন ঠিকানা।