এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের আশপাশে প্রচুর খেলার সরঞ্জামের দোকান। মাঠে ঢোকার পথেই চোখে পড়বে ‘ধোনি স্পোর্টস’ নামের বিশাল এক দোকান, পাশের ‘শচীন স্পোর্টস’ও। রাস্তা ধরে এগোতে থাকলে পেয়ে যাবেন ‘দ্য প্যাভিলিয়ন’।
‘দ্য প্যাভিলিয়ন’ এই স্টেডিয়াম পাড়ার পুরোনো স্পোর্টসের দোকানগুলোর একটি। চন্দ্র কুমার চোপড়া নামের এক ভদ্রলোক ১৯৮৮ সালে দোকানটি খুলে ব্যবসা শুরু করেন। সাবেক ও বর্তমান অনেক তারকা ক্রিকেটার নাকি এ দোকান থেকেই ক্রিকেটের ব্যাট-প্যাড কিনতেন, এখনো কেনেন। এই দোকান থেকে কেনা ব্যাট দিয়েই পাকিস্তানের সাবেক ব্যাটসম্যান সাঈদ আনোয়ার ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৯৪ রানের সেই বিখ্যাত ইনিংস। ‘দ্য প্যাভিলিয়নে’ একবার ঢুঁ মারার কারণ সে কারণেই।
দোকানে গিয়ে পরিচয় দেওয়ার পর ওপর থেকে নেমে এলেন মালিক চন্দ্র কুমার চোপড়া। বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খুব খাতির করে বসালেন। এরপর গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন। শুরুটা করলেন সাঈদ আনোয়ারের বিশ্ব রেকর্ড গড়া সেই ম্যাচের দিন থেকে। দিন-তারিখ সবই মুখস্থ। চন্দ্র কুমার শুরুই করলেন ‘ঘটনাটা ২১ মে, ১৯৯৭ সালের’ বলে। অবাক হয়ে তাঁকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার দিন-তারিখ সব মনে আছে!’ স্মিত হাসি দিয়ে চন্দ্র কুমার চলে গেলেন চেন্নাইয়ে পেপসি ইনডিপেনডেন্স কাপে ভারত-পাকিস্তানের সেই ম্যাচে, ‘ভারত-পাকিস্তান সিরিজ চলছিল তখন। লম্বা বিরতির পর দুই দেশের মধ্যে খেলা হচ্ছিল।’
পাকিস্তান দলকে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়েছিল। না হলে দোকানটা ভেঙেও যেতে পারত। ওরা এখান থেকে কেনাকাটা করে গেল মাঠে, ম্যাচ খেলতে। সেদিনই সাঈদ আনোয়ার ১৯৪ রানের সেই বিখ্যাত ইনিংস খেললেন।চন্দ্র কুমার, দ্য প্যাভিলিয়নের মালিক
চন্দ্র কুমার বলে যেতে থাকেন, ‘খেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল আড়াইটায়। পাকিস্তান দলের কিছু ব্যাট-প্যাড দরকার ছিল। ওরা ম্যাচ শুরুর আগে দোকানে এসেছিল, দুপুর সাড়ে ১২টা হবে তখন। রমিজ রাজা ছিলেন অধিনায়ক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শহীদ আফ্রিদি, মোহাম্মদ ওয়াসিম ও আজহার মাহমুদ। তাঁরা কিছু গ্লাভস ও প্যাড কিনেছিলেন। সঙ্গে ক্রিকেট ব্যাটও।’
ওদিকে কিছুক্ষণ পরই ম্যাচ শুরু হবে। স্টেডিয়ামমুখী দর্শকও আসতে শুরু করেছেন। কীভাবে যেন পাকিস্তান দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের এই দোকানে আসার খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। বাকিটা কি আর বলার প্রয়োজন আছে!
ভাগ্য ভালো যে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন। নইলে কী হতে পারত, হাসিমুখেই তা বললেন চন্দ্র কুমার, ‘পাকিস্তান দলকে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়েছিল। না হলে দোকানটা ভেঙেও যেতে পারত (হাসি)।’ পরে যোগ করেন, ‘ওরা এখান থেকে কেনাকাটা করে গেল মাঠে, ম্যাচ খেলতে। সেদিনই সাঈদ আনোয়ার ১৯৪ রানের সেই বিখ্যাত ইনিংস খেললেন।’
স্মরণীয় ওই ইনিংস খেলার পর সংবাদ সম্মেলনে ‘দ্য প্যাভিলিয়ন’ থেকে কেনা ব্যাট দিয়ে খেলার কথাটা জানান সাঈদ আনোয়ারই। চন্দ্র কুমারের জন্য যা ছিল একদমই অপ্রত্যাশিত, ‘ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমার দোকান থেকে কেনা ব্যাট দিয়েই নাকি তিনি ১৯৪ রান করেছেন! আমরা কিন্তু বুঝতে পারিনি। উনি না বললে জানতামও না।”’
চন্দ্র কুমারের স্মৃতিতে সেদিনের সব যেন এখনো তরতাজা, ‘ব্যাটটা ছিল আরএনএসের। সাঈদ আনোয়ার আরএনএসের স্টিকার সরিয়ে তাঁর স্পনসরের স্টিকার লাগিয়ে খেলতে নেমেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে থেকেই বলেছেন, ব্যাটটা এখান থেকে কেনা, তখন আমরা বিষয়টা জানতে পারলাম। কারণ, তখন ১৯৪ রান বিরাট ঘটনা, বিশ্ব রেকর্ড। আমরাও সাঈদের সৌজন্যে ওই রকম একটা কীর্তির অংশ হতে পেরেছি।’
ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে অধিনায়ক রমিজ রাজা চার হাজার রুপিতে কেনা ব্যাটটা সাঈদ আনোয়ারকে দিয়েছিলেন। সেই ব্যাটে বিশ্ব রেকর্ড করার পর সাঈদ আনোয়ার ‘দ্য প্যাভিলিয়ন’কে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন। অর্ডার দেন আরও ১০টি ব্যাটের।
সেদিনের পর চেন্নাইয়ের মানুষের কাছে ‘দ্য প্যাভিলিয়নে’র নামটাই বদলে যায়। ‘দ্য প্যাভিলিয়ন’ হয়ে যায় ‘সাঈদ আনোয়ার শপ’। চন্দ্র কুমারের অবশ্য এতে খারাপ লাগেনি। লাগবেই–বা কেন! সেদিনের পর থেকে যে তাঁর দোকানে বিক্রিটাও বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে ক্রিকেটারদের আনাগোনা, এমনকি আন্তর্জাতিক তারকাদেরও চন্দ্র কুমারের দোকানের দেয়ালে দেয়ালে ক্রেতা হয়ে আসা ক্রিকেটারদের নতুন-পুরোনো ছবি দেখলেই তা বোঝা যায়।
গ্যারি সোবার্স থেকে শুরু করে মহেন্দ্র সিং ধোনি, রবীন্দ্র জাদেজা—কে আসেননি ‘দ্য প্যাভিলিয়নে’! চন্দ্র কুমার বলছিলেন, ‘অনেক তারকা ক্রিকেটার এখানে এসেছেন, ঘুরে গেছেন। গ্যারি সোবার্স, ডেনিস লিলি, রিচার্ড হ্যাডলি...ভারতের গাঙ্গুলী, শচীন, দ্রাবিড়রাও নিয়মিত আসতেন। সবাই জানেন, ক্রিকেটারদের যা যা দরকার, সব এখানে পাওয়া যায়। এখানে শত শত খেলোয়াড় এসেছেন, ঘুরে গেছেন, কেনাকাটা করেছেন।’
ব্যবসায়ী নন, কথাটা বলার সময় চন্দ্র কুমারকে শুধুই একজন ক্রিকেট–ভক্ত মনে হলো।