জোসেফের রূপকথা চলছেই
জোসেফের রূপকথা চলছেই

৭/৬৮, ম্যাচ ও সিরিজসেরা—শামার জোসেফের রূপকথা চলছেই

শামার জোসেফ ছুটছেন, পেছনে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এ জোসেফকে থামানোর সাধ্য কার! স্টিভেন স্মিথ, ক্যামেরন গ্রিন, মিচেল মার্শরা কেউ পারেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে এই সিরিজে তাঁকে থামাতে পারত শুধুই চোট। যে চোটকেও তিনি দেখিয়েছেন বুড়ো আঙুল। চতুর্থ দিন মাঠেই নামতে পারবেন কি না, এ নিয়েই যেখানে অনিশ্চয়তা ছিল, সেখানে করেছেন টানা ১১.৫ ওভার।

৬৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২৭ বছর পর জয় এনে দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ম্যাচসেরা ও সিরিজ–সেরা হয়ে গ্যাবায় লিখেছেন ইতিহাস। জানিয়ে রাখা ভালো, অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বশেষ জয়ের সময় জোসেফের জন্মই হয়নি।

অথচ কে বলবে, এই জোসেফ গতকাল মাঠ ছেড়েছেন সতীর্থদের কাঁধে ভর দিয়ে। মিচেল স্টার্কের করা ঘণ্টায় ১৪১ কিলোমিটার গতির ইয়র্কার বুটে এসে পড়লে কী আর করা! আহত হয়ে অবসর নিয়েছেন ব্যাটিং থেকে। পরে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের সময় মাঠেও নামতে পারেননি। এই টেস্টে জোসেফ–অধ্যায় শেষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। রাতে স্ক্যান করার পর জানা গেল, আঙুল ভাঙেনি।

তবুও জোসেফ আর এই টেস্টে বল করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিলই। সেই সংশয় উড়িয়ে জোসেফ বোলিংয়ে এলেন ইনিংসের ২৯তম ওভারে। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর তখন ২ উইকেটে ৯৩। স্টিভেন স্মিথ আর ক্যামেরন গ্রিন এমন ব্যাটিং করছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার জয় নিয়ে বলতে গেলে কোনো প্রশ্নই নেই। শামার জোসেফ সেই প্রশ্নটাকে বড় করে তুলতে তুলতে বদলে দিলেন ম্যাচের রং–ই।

৭ উইকেট নিয়ে দলকে জেতানোর পর আনন্দে গ্যাবায় উড়ে বেড়ানো জোসেফও পরে বলেছেন সেই অনিশ্চয়তার কথা, ‘আজ মাঠেই আসার কথা ছিল না। কিন্তু চিকিৎসক আমার আঙুলে কিছু একটা করেছেন। কী করেছেন জানি না, কিন্তু এটা কাজ করেছে। এমনকি আমি ক্লান্তও ছিলাম না, আমি বোলিং চালিয়ে যেতে পারতাম।’ জস হ্যাজলউডের স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে যখন দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছেন, ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ মজা করে বলছেন, ‘ওয়াচ ইয়োর টো’ ‘ওয়াচ ইয়োর টো’।

অস্ট্রেলিয়ায় জোসেফ পা রেখেছিলেন বোধ হয় ইতিহাস লিখবেন বলেই। আর সেটা তিনি করছেন প্রথম বল থেকেই। গত সপ্তাহে অ্যাডিলেডে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই আউট করেছিলেন স্টিভেন স্মিথকে। অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দশম বোলার হিসেবে। প্রথম বলে উইকেট পাওয়া নিঃসন্দেহে দারুণ কিছু। তবে শঙ্কার জায়গাও তো ছিল। কারণ, সব মিলিয়ে টেস্টে প্রথম বলে উইকেট নিয়েছেন ২৩ জন। তাতে এর আগে প্রথম বলে উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নাথান লায়ন ছাড়া কারও ক্যারিয়ারই উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নয়।

ম্যাচ ও সিরিজসেরা হয়েছেন জোসেফ

জোসেফের আগে এই তালিকায় ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের টাইরেল জনসন। ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে প্রথম বলে উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। ওভালে তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ওভারে ওয়াল্টার কিটনকে বোল্ড করেই কীর্তিটা গড়েন জনসন। ওই ম্যাচে আরও ২ উইকেট নিলেও জনসন এরপর আর টেস্ট খেলারই সুযোগ পাননি। শুধু টেস্ট ক্রিকেট কেন, প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ওটাই হয়ে আছে জনসনের প্রথম ও শেষ ম্যাচ। তবে পরের টেস্টের পারফর‌ম্যান্সেই জোসেফ প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি ‘জনসন’ হতে আসেননি।

ব্রিসবেন টেস্টের চতুর্থ দিনের অন্য নাম তো আসলে অস্ট্রেলিয়া বনাম শামার জোসেফ। ক্যামেরন গ্রিনকে বোল্ড করে যখন প্রথম উইকেট নিলেন, অস্ট্রেলিয়ার জিততে প্রয়োজন আর ১০৩ রান। তখনো আছে ৭ উইকেট। পরের বল থেকেই বদলে দিতে শুরু করেন সব। দারুণ এক ইয়র্কারে বোল্ড করে দেন প্রথম টেস্টের ম্যাচসেরা ট্রাভিস হেডকে। এরপর একে একে ফিরিয়ে দিয়েছেন মিচেল মার্শ, ক্যারি, স্টার্ক, কামিন্স ও হ্যাজলউডকে। টেস্টটা তাঁর হাতে শেষ হওয়াটাই আদর্শ হতো। সেটিই হয়েছে।

দ্বিতীয় টেস্টেই ৭ উইকেট পেলেন জোসেফ

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই ইনিংসে ৭ উইকেট। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তিই তো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র তিনজন বোলারের, যাঁদের দুজনই রীতিমতো কিংবদন্তি। ১৯৭৫ সালে অ্যান্ডি রবার্টস ও ১৯৯৩ সালে কার্টলি অ্যামব্রোসের আগে সেই ১৯৫৬ সালে মিডিয়াম পেসার জেরি গোমেজের। জোসেফের রূপকথার মতো গল্পটা এতদিনে আপনার জেনে যাওয়ার কথা।

অ্যাডিলেডে স্মরণীয় অভিষেকের পর এ নিয়ে তো আর কম কথা হয়নি। কীভাবে বছরখানেক আগেও নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করা জোসেফ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। গায়ানার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন বলেই কি না, কে জানে, প্রথম টেস্টে দারুণ কিছু করার পর জোসেফ আশা করেছিলেন, তাঁর গ্রাম বারাকারার মানুষ তাঁর পারফরম্যান্স যেন দেখে। সেই আশা বোধহয় সত্যি হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় অভিষেকের আগে পেশাদার ক্যারিয়ারে মাত্র ৫ ম্যাচ খেলা এই ক্রিকেটারের। বারাকারার মানুষ এমন ম্যাচ মিস করেন নাকি!