বিশ্বকাপ শেষ হলে মন ভরে হতাশ হওয়ার কথা বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। তত দিন অপেক্ষার বোধ হয় আর প্রয়োজন নেই। মন ভরেছে পরশু রাতেই। উপচেও পড়তে পারে। আহা, কী নিদারুণ হতাশামাখা পারফরম্যান্স!
সাকিব নিজেও জানতেন না, এমন বিস্ময় উপহার দেবেন কিংবা দিতে হবে। নইলে (প্রথমটা জয়) টানা ৩ হারের পরও সমর্থকদের বোঝাতেন না, হতাশা প্রকাশে তোমাদের তর না সইলেও সেসব বিশ্বকাপ শেষে করাই উত্তম। কে জানত, কথাটা বলার দুই ম্যাচ পরই সবার মন এভাবে ভরে যাবে! এটাও তো আরেক বিস্ময়। অথচ এখনো বাকি ৩ ম্যাচ। তাহলে এখন কি লক্ষ্য? চূড়ান্ত তো হয়েই গেল! সম্মান? সে প্রসঙ্গ থাক। সেমিফাইনাল নিয়ে কিছু না বলাই ভালো। সাকিব বলেছেন, প্রতিপক্ষ নয়, ভাবনাটা নিজেদের নিয়ে। এই যে প্রত্যাশা নামতে নামতে শেষ পর্যন্ত নিজেদের নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যাওয়া, মন ভরিয়ে দেওয়া হতাশাগুলোর মধ্যে এটাও আরেকটা। আর উপচে পড়ছে যে কয় ফোঁটা, তার রূপ-মাধুর্য বর্ণনা না করলেই নয়! এটাই কী বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ, সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়েছিল অধিনায়কের কাছে। রায় দিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন এবং আমি দ্বিমত করব না।’
বাকি ম্যাচগুলো জিততে পারলে অন্তত জয়সংখ্যা বিচারে এটাই হবে বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ। চরম আশাবাদী কেউ কেউ সে আশায় এখনই ‘সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ’ বলতে হয়তো দ্বিধায় ভুগছেন। সেই দ্বিধাটুকুও আগেভাগে উপড়ে নৈরাশ্যবাদীতে রূপান্তর করতে পারেন কজন অধিনায়ক! নাকি বাস্তববাদী? সাকিব দলের ভেতরটা জানেন। তাই বাকি ৩ ম্যাচের ফল নিয়ে আগেভাগে ইঙ্গিত দিতে বাধেনি! তাহলে যে বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত যে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন? তখন সম্ভবত ভাবেননি, এত আগেভাগেই মন ভরবে!
আসলে সবই ভাগ্য। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুসারী কিন্তু নিজেকে ভাগ্যবিড়ম্বিত মনে করেন না, এমন সমর্থক নেই। যুক্তির পর যুক্তি, হিসাবের পর হিসাব না মিললে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যকেই কানে ধরে কাঠগড়ায় তোলা হয়। খেলোয়াড়েরাও ‘যদি-কিন্তু’ বলেন। সেই ভাগ্য পরশু জয়ে পাশে না থাকলেও অভিজ্ঞতা ও সফরে সফরে খেলোয়াড়দের শেখার যে প্রয়াস, তাতে নতুন ‘অর্জন’ যোগ করেছে। এমনিতে কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ থেকে খালি হাতে ফেরা কঠিন। নামের পাশে কোনো না কোনো স্কোর থাকেই।
মুশফিকের যেমন ২২। বিশ্বকাপে এখন সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হারের রেকর্ড। আসলে অর্জনের স্বাদ যেমনই হোক, যেহেতু তা ব্যক্তিগত, ভালো লাগাই বোধ হয় স্বাভাবিক। নইলে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে দলের নিশ্চিত হারেও শতক তুলে মাহমুদউল্লাহ অমন উদ্যাপন করবেন কেন? আর ড্রেসিংরুমেও হাসিমুখ ছিল, করতালি ছিল। দল, দুঃখিত ১১জন খেলোয়াড় বিশ্বকাপে কী লক্ষ্যে খেলছে, সেটা তখনই পরিষ্কার। সাকিবের ২১। দ্বিতীয়।
যুক্তি দিতে পারেন, মাঠে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে হার-জিত ঠিক হয়। ভাগ্য স্রেফ অজুহাত। বটে! বিশ্বকাপের আগে যত বিতর্কই হোক, সে জন্য প্রস্তুতি যদি একদম নাও হয়ে থাকে, তবু এ ম্যাচে হার কারও কল্পনায় আসেননি। এর বাইরে আর যা কিছুই হোক, সব মেনে নেওয়ার মতো শক্তিশালী হৃদয় বাংলাদেশের প্রায় সব সমর্থকের এত দিনে হয়ে গেছে। আর টানা হার থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এটাই ছিল ‘শিউর শট’। কপালে না থাকলেই শুধু এমন শট মিস হয়!
খেলোয়াড়দের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন করা ভুল। সে জন্য চরম প্রস্তুতিও ছিল। অধিনায়ক নিজে দল রেখে ফিরেছিলেন দেশে। নিজেকে ঠিকঠাক করার দরকার পড়েছিল নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে। এখন, যে স্কয়ার কাট মুড়িমুড়কির মতো খেলেন, সেটা শরীরে যত কাছেই হোক, ব্যাটের ‘কানচি’ নিয়ে গেলে দোষ কার! অবশ্যই ভাগ্যের। ক্রিকেট গোল বলের খেলা। আর সেই গোল বলটা আবারও মুশফিকের ব্যাট ও প্যাডের ফাঁক গলে ঢুকেছে। এক কাঠি সরেস লিটন তত দূর যেতে দেননি। তার আগেই রিভার্স সুইপে লেগ বিফোর। এই যে আউটগুলো, বিশ্বকাপে কিংবা তার আগে অন্য দশটা ম্যাচে যেভাবে খেলেছেন, তার চেয়ে একদমই নতুন কিছু না। এভাবেই আউট হচ্ছেন, হবেনও হয়তো। সেজন্যেই ভাগ্যের কথাটা আসছে।
টানা হার থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ‘শিউর শট’ একটা ম্যাচে যখন পুরোনো ব্যাপারগুলো উঠে আসে, তখন প্রশ্নটা সামর্থ্যের নয়, অদৃষ্টের। খেলোয়াড়েরা যেভাবে খেলেন, সেভাবেই তো খেলার চেষ্টা করেছেন। অদৃষ্ট চায়নি বলেই হয়তো ‘যদি-কিন্তু’গুলো মেলেনি! ব্যাট-বলের খেলায় কথাটা শুনতে যেমনই লাগুক, বাংলাদেশ দল সম্ভবত তা বিশ্বাস করে। হারের পর দেশের একটি টিভি চ্যানেল এক খেলোয়াড়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, সমস্যাটা কোথায়? উত্তর এসেছে, ‘আসলে বলার কিছু নাই। যেটা হচ্ছে, সবাই মিলে আমাদের জন্য দোয়া করতে পারেন। যে সময় যাচ্ছে, দোয়া করা ছাড়া আর কিছু অপশন (সুযোগ) নাই।’
অর্থাৎ, ব্যাটে-বলে চেষ্টা করে আর লাভ নেই। যদি কিছু হয় প্রার্থনায়! এসব অতীন্দ্রিয় ব্যাপারস্যাপারে কিন্তু কর্মফল ও সিনিয়র-জুনিয়র প্রসঙ্গও উঠে যেতে পারে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে ডাচদের বিপক্ষে যে জয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের টিকে থাকা নিশ্চিত হয়েছিল, সে ম্যাচে বৃষ্টির অপেক্ষায় ইচ্ছা করেই সময় নষ্ট করেছিল বাংলাদেশ। ধারাবাহিক বাজে খেলার সিরিয়ালে এই ম্যাচে তার প্রায়শ্চিত্ত লেখা ছিল হয়তো! আর ক্রিকেটে ডাচরা বেশ সিনিয়রও। তাদের ক্রিকেট বোর্ড প্রতিষ্ঠিত বিসিবির জন্মের ৮২ বছর আগে। আলটপকা বেড়ে তো লাভ নেই। প্রকৃতির একটা মার থাকেই। এসব যুক্তি দিতে হচ্ছে। কারণ, বলে দেওয়া হয়েছে, সময় এখন দোয়ার, দুহাত তুলে প্রার্থনার।
সমর্থকদের তাতে কার্পণ্যের প্রশ্নই ওঠে না। এমনিতেই এক ম্যাচ জিতলে সব ভুলে যাই! আর এখন পরিস্থিতি কত সঙিন সেটাও সবাই বোঝে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে গুগল করলেই বেরিয়ে আসছে বিচিত্র সব তথ্য—গত ৯ জুলাই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে শেষ ম্যাচ খেলার পর বিশ্বকাপে আসার আগ পর্যন্ত কোনো ওয়ানডে খেলেনি আইসিসির একটি সহযোগী সদস্য দেশ। এর মধ্যে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে ৯টি ওয়ানডে খেলেছে প্রায় দুই যুগের একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ। তারপর বিশ্বকাপে দল দুটি যখন মুখোমুখি হলো, যা হওয়ার কথা ছিল, হলো না!
বরং উল্টোটাই ঘটল।
আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশটি আগে ব্যাট করে ৬৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে পুরো ৫০ ওভারই খেলল। ৫৮ শতাংশ বল (১৭৪) ‘ডট’ দিয়েও তুলল ২২৯। তাদের ইনিংসে স্কোরিং শট ১২৬টি। বাউন্ডারি ২২টি ও ওভার বাউন্ডারি ২টি। অর্থাৎ চার-ছক্কা থেকে এসেছে পাক্কা ১০০ রান। এক্সট্রা বাদ দিলে সিঙ্গেলস-ডাবলস (৩ রানও আছে) থেকে বাকি ১১৭ রান। দৌড়ে ৯১টি সিঙ্গেল, ১০টি ডাবল ও দুটি ৩ রান।
টেস্ট খেলুড়ে দলটি ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে এই রান তাড়া করতে নেমেছিল। একপর্যায়ে তাঁদেরও ছিল ৬৩ রানে ৪ উইকেট। সাধারণ হিসাবে এখান থেকে পুরো ৫০ ওভার খেললেও রানটা হয়ে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত ইনিংসটি থেমেছে যেখানে গিয়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে বলা যায় পুরো ৫০ ওভার খেললেও হয়তো হতো না!
৪২.২ ওভারে ১৪২ রানে অলআউট। অর্থাৎ বাকি ৭.৪ ওভারে (৪৬ বলে) দরকার ছিল ৮৭। অবশিষ্ট এই সমীকরণটুকুই হয়তো কী লক্ষ্যে ব্যাট করেছিল—সেই জবানবন্দির সাক্ষী। কিংবা আদৌ কোনো লক্ষ্য ছিল কি না! নইলে যে ২৫৪ বলের ইনিংসে ৭১.৩ শতাংশ ‘ডট’ (১৮১বল)? উইকেট হারানোয় চাপ?
সেই চাপ থেকে বের হতে ১৬টি চার ও ২টি ছক্কা, যেখান থেকে এসেছে ৭৬ রান (৫৩.৫ শতাংশ)। ‘এক্সট্রা’ মাত্র ৬ (সবগুলো ওয়াইড)। বাকি ৬০ রানের হিসাবও মজার। সিঙ্গেলস মাত্র ৫০টি, ডাবলস ৫টি, তৃতীয়বার দৌড়ানোর ইচ্ছা কারও হয়নি।
আসলে টেস্ট খেলুড়ে দলটি এমন আহামরি খারাপ খেলেনি। সবাই জানে, খেলে তো আসছে এভাবেই! দ্রুত পতনের চাপে ভেঙে পড়ে। মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম হয় বটে। কিন্তু ব্যতিক্রম যেমন উদাহরণ নয়, তেমনি ফলটা দেখে নিরপেক্ষ কোনো সমর্থকের মনে হতে পারে, ক্রিকেট খুবই মজার খেলা। আসলে কি তাই? সবার জন্য না। ইশপের গল্পে পুকুড়পাড় থেকে বাচ্চাদের ঢিল ছোড়া দেখে ব্যাঙেরা বলেছিল, ‘তোমাদের কাছে যা কিছু খেলা, আমাদের কাছে সেটাই মৃত্যুপ্রতীম।’
আসুন দোয়া করি। প্রার্থনায় দুই হাত তুলি। শেখা, উন্নতির জায়গা, চেষ্টা আর অর্জন নিয়ে কথা বলি। শুধু কথা!