‘অনেক কিছু শেখার আছে’—দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১৪৯ রানে হারার পর বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান পুরস্কার বিতরণীতে আরও অনেক কথার সঙ্গে এটাও বলেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা বড় দল, এবারের বিশ্বকাপে শিরোপাপ্রত্যাশী। তাদের কাছে হারার পর সাকিবের এমন ‘শিক্ষামূলক’ কথা হয়তো কাউকে সেভাবে ধাক্কা দেয়নি! নেদারল্যান্ডসের মতো ‘পুঁচকে’ দলের কাছে গতকাল হেরে যাওয়ার পর অমন কোনো ‘বাণী’ সাকিব দেননি।
তবে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন ঠিকই শেখার বিষয়ে কথা বললেন। প্রথম আলোতে লেখা কলামটা তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘বিশ্বকাপ এখন বাংলাদেশের জন্য শুধু অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা। যাঁরা ভবিষ্যতের খেলোয়াড়, তাঁদেরও অনুপ্রেরণা জোগাতে পারছে না। নেদারল্যান্ডস লড়াই করেছে, তাদের অভিনন্দন। বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসা দলটির ইচ্ছাশক্তি ছিল। তাদের কাছ থেকেও আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে।’
‘শেখার আছে অনেক কিছু’—হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসরণ করেন, এমন ব্যক্তিমাত্রই এ বাক্য শুনে স্মৃতিকাতর হবেন। ১৯৮৬ সালে ওয়ানডে খেলা শুরু করা থেকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বয়স এখন ৩৭ বছর।
প্রায় চার দশকের এ সময়কালে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অধিনায়ক পেয়েছে ১৬ জনকে, টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১২ জন আর টি-টোয়েন্টিতে ৯ জন। প্রায় সব অধিনায়ককেই একাধিকবার বলতে শোনা গেছে ‘আমরা এখনো শিখছি’, ‘আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই’ বা ‘শেখার আছে অনেক কিছু’ টাইপের কথা! যার মানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শৈশব আর কৈশোরোত্তীর্ণ বাংলাদেশের ‘শিক্ষা সফর’ এখনো চলছে!
এটা ঠিক যে শেখার কোনো শেষ নেই। কিন্তু শিখতে শিখতেই তো মানুষ বড় বড় সাফল্যের পালক অর্জন করে। শিক্ষার্থীরা একটার পর একটা ডিগ্রি পান শিখতে শিখতেই। বিজ্ঞানীরা নানা কিছু আবিষ্কার করেন শিখতে শিখতেই, একটা আবিষ্কারের পর তারা নতুন কিছু আবিষ্কার করার নেশায় আমার খাতা-কলম নিয়ে বসে যান শিখতে। এমনও তো বলা হয়, আইনজীবী আর চিকিৎসককে সারা জীবনই শেখার মধ্যে থাকতে হয়। তাই বলে কি তারা ‘শিক্ষা সফর’ময় এ জীবনে কোনো অর্জনে ভাসেন না!
শেখার মধ্যেই তো ইচ্ছেরা ডানা মেলে। স্বপ্নেরা ডালপালা ছড়ায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরও তো ইচ্ছা আছে ভালো কিছু করার। তাই তো পরাশক্তি দলের বিপক্ষে ম্যাচের আগেও সাকিব, মুশফিক বা লিটনদের বলতে শোনা যায়—আমরা ভালো করতে চাই, আমরা জয়ের ইচ্ছা নিয়েই খেলতে নামব অথবা আমরা এই টুর্নামেন্ট বা এই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলতে চাই। তাঁদের এ ইচ্ছাশক্তি দেখে বা শুনে সমর্থকেরাও আশায় বুক বাঁধে। ক্রিকেটপ্রেমীদের সেই স্বপ্ন ডালপালা ছড়িয়ে কখনো কখনো সুপার সিক্স বা সেমিফাইনালের সীমানা ছাড়ায়!
কিন্তু একেকটা ম্যাচ শুরু হয়, আর সাকিব-লিটন-মুশফিকদের ইচ্ছাশক্তি কেমন যেন ম্রিয়মাণ দেখায়। ১৪৯ রান বা ৭ উইকেটের একেকটা হারে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়। নেদারল্যান্ডসের মতো একটি দলের কাছে হেরে যাওয়ার পর কারও কারও মনে হয়তো করুণ সুরে বেজে ওঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’র সেই লাইন—কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ (পড়ুন ৩৭) বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
স্বপ্নেরা কি ছোট বা অন্য রকম হয়ে যায়! হয় বৈকি। পূর্ণেন্দু পত্রী যেমন তাঁর ‘স্বপ্নের অসুখ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সে-রকম নির্বিরোধী অমল ধবল পালতোলা স্বপ্ন আর বেড়াতে আসে না/রাত্রিকালে।’ স্বপ্ন বদলে যাওয়া নিয়ে এখানেই থামেননি কবি। তিনি লিখেছেন, ‘স্বপ্নের দেয়ালগুলি আগে সাদা ছিল,/ এখন সেখানে, ধুমশো সাপের মতো ভয়ংকর ধ্বংসের অক্ষর।’
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২৩০ রান তাড়া করতে নেমে যখন লিটন দাস ইনিংসের শুরুতে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন, সাকিব কিছু না বোঝার আগেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে, মুশফিক মুখোমুখি হওয়া পঞ্চম বলে বোল্ড হয়ে কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ভেঙে যাওয়া স্টাম্পের দিকে; তখন আবার মনে পড়ে যায় পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার আরেকটি লাইন—‘এখন স্বপ্নেরও মধ্যে কারো কারো মর্মান্তিক বিসর্জন অথবা বিদায়।’
লিটন, সাকিব বা মুশফিকদের এমন বিসর্জনে আমাদের স্বপ্নেরা কি বিদায় নেয়! সত্যি বলতে কী, আমরা বাংলাদেশিরা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা বড্ড বেশি আশাবাদী! এত সহজে আমরা স্বপ্নকে বিদায় দিতে পারি না। সাকিব-তাসকিনরাও তো বাংলাদেশি।
এ কারণেই হয়তো তিনি এই বিশ্বকাপে সামনে পড়া প্রায় সব পরাশক্তি দলকেই ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে দেওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘ওই (সেমিফাইনাল খেলার) সম্ভাবনা তো এখনো আছে। আমরা না পারলেও অন্যরা আমাদের সহায়তা করছে। ওই রকম যদি হতেই থাকে, আর আমরা যদি নিজেদের একটু সহায়তা করতে পারি, স্বপ্ন সত্যিও হয়ে যেতে পারে। আপনি যদি দেখেন, এখনো খুব ভালো সুযোগ আছে আমাদের। এত তাড়াতাড়ি হতাশ হবেন না। শেষ হলে হতাশ হোন। মন ভরে হতাশ হোন। কোনো সমস্যা নেই।’
সাকিবের কথার রেশ ধরেই হয়তো বাংলাদেশের পেসার তাসকিন আহমেদ নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘আশা এখনো শেষ হয়নি। এখনো ৪ ম্যাচ আছে এবং আমরা যদি এই ৪ ম্যাচ জিততে পারি, তাহলে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। কারণ, (নেট) রানরেটের হিসাব আছে।’
কিন্তু গতকাল যেটা ঘটেছে, সেটাতে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার আশারই শুধু বিসর্জন হয়নি, ক্রিকেটে আমাদের পারঙ্গমতা আর সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেছে। ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে যেমন টুইট করেছেন, ‘বাংলাদেশকে কিছু কঠিন প্রশ্ন নিজেদের করতে হবে। বাংলাদেশি সমর্থকেরা, আপনাদের মতে সাকিব-মুশফিক-তামিমদের ব্যাচের পর আর সত্যিকার অর্থে কোনো বিশ্বমানের খেলোয়াড় কি এসেছে?’
তা বাংলাদেশ যাঁর কাছেই হারুক, যে যেই প্রশ্নই তুলুক আর এই বিশ্বকাপে হোক বা না হোক; আমরা স্বপ্ন দেখেই যাব। ওই যে আগেই তো বললাম, আমরা বাংলাদেশিরা বড্ড বেশি আশাবাদী। হতে পারে বড় স্বপ্নটাকে ছেঁটেছুটে একটু ছোটই শুধু করব।
২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ৩টি ম্যাচ জিতেছিল, কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারেনি। সেবারও বলা হয়েছিল, এই বিশ্বকাপের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বিশ্বকাপে ভালো খেলবে বাংলাদেশ, আরেকটু বেশি অর্জন হবে তাতে।
২০১৫ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ ৩টি ম্যাচ জিতেছে, খেলেছে কোয়ার্টার ফাইনালেও। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের কাছে হেরে যাওয়া ম্যাচ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বিশ্বকাপে আরও ভালো কিছু উপহার দেওয়ারর প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছিল সেবারও।
২০১৯ বিশ্বকাপের ফরম্যাটে কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল না। লিগ পদ্ধতির প্রথম রাউন্ডের পর সরাসরি সেমিফাইনালে খেলেছে চারটি দল। বাংলাদেশ তাই সেবার ৩টি ম্যাচ জিতেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারেনি। সেবারও সেই একই কথা শোনা গেছে—শিখতে হবে ভুল থেকে।
সাকিব-মুশফিক, আমরা বলছি, আপনারা শিখতে থাকুন। কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখা ছাড়ছি না। বড় স্বপ্ন যেহেতু পূরণই হচ্ছে না, তাই নিজেদের স্বপ্নভঙ্গের হতাশা থেকে বাঁচাতে স্বপ্নগুলো ছোট করে রাখছি। সম্ভব হলে এবারও ৩টি ম্যাচ জিতে দেশে ফিরুন।
এবার সেটা না পারলেও ক্ষতি নেই, আসছে বিশ্বকাপে হবে। তখন পর্যন্ত নাহয় আমাদের স্বপ্নগুলোকে ডালপালা মেলতে না দিয়ে ছেঁটেছুটে বনসাই বানিয়ে রাখছি! একই সঙ্গে সুনীলের কবিতার সেই বাবার মতো বলছি, ‘দেখিস, একদিন আমরাও...।’ একটাই শুধু আবেদন—কবিতার ওই বাবার মতো ‘অন্ধ’ হয়ে যাবেন না। কে জানে, তাহলে হয়তো আমাদেরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো ‘চৌধুরীদের’ গেটের বাইরে দাঁড়িয়েই দেখতে হবে ভেতরের বিশ্বকাপ-উৎসব!