আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যে রাতে বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতল অস্ট্রেলিয়া, তার আগে দলটির ড্রেসিংরুমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। একটি মিটিংয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের টিম অ্যানালিস্ট। কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড এবং অধিনায়ক প্যাট কামিন্স মিলে অ্যানালিস্টকে একটি কাজ করতে বলেছিলেন।
টস জিতলে কেন আগে বোলিং করা উচিত হবে না—এর পক্ষে পরিসংখ্যান এবং অন্যান্য তথ্য–উপাত্ত দিয়ে অ্যানালিস্টকে যুক্তি দাঁড় করাতে বলেছিলেন কোচ ও অধিনায়ক। অন্য একটি মিটিংয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফোক ব্যান্ড সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেলের একটি গান।
অস্ট্রেলিয়ান ধারাভাষ্যকার মার্ক হাওয়ার্ড একটি পডকাস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। গত রোববার বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ৬ উইকেটে জয়ের পর হাওয়ার্ডকে ট্রাভিস হেডদের ড্রেসিংরুমে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। নিজের ‘হাউয়ি গেমস ওয়ার্ল্ডকাপ ট্যুর ডায়েরিজ’ পডকাস্টের জন্য অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার নিতে ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন হাওয়ার্ড। তখন উৎসবের মধ্যে এসব কথা জানতে পারেন তিনি।
টসে জিতলে আগে ফিল্ডিং করার বিষয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) এক মুখপাত্র অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে বলেছেন, ‘ওই মাঠে আগে বোলিংয়ের সব পরিসংখ্যান আমাদের পরিসংখ্যানবিদ টম বডির কাছে চেয়েছিল অ্যান্ড্রু ও প্যাট।’ দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার জানিয়েছেন, দলের পরিসংখ্যানবিদের উপস্থাপন করা তথ্য-উপাত্ত আগে ব্যাট করার পক্ষে ছিল। কিন্তু সিনিয়র খেলোয়াড়েরা আগে বোলিংয়ের পক্ষে ছিলেন। কামিন্সসহ বাকি দুই পেসার মিচেল স্টার্ক ও জস হ্যাজলউডও আগে বোলিং করতে চেয়েছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, ফাইনালের আগে টিম মিটিংয়ে সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেলের বিখ্যাত ‘দ্য সাউন্ড অব সাইলেন্স’ গানটা শুনেছেন কামিন্স–হেডরা। ঠান্ডা মেজাজের এই গান ফাইনালের আগে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল শুনেছে মনকে শান্ত করতে। ফাইনালে কী অপেক্ষা করছে, কামিন্সরা তা জানতেন। মাঠের ভেতর টানা ১০ ম্যাচে অপরাজিত থাকা প্রতিপক্ষ ভারত এবং মাঠের বাইরে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রায় লাখো দর্শক—এসবের পাশাপাশি ফাইনাল ম্যাচের আলাদা চাপ তো ছিলই। মাঠে নেমে সব চাপকে জয় করার প্রস্তুতি হিসেবে ম্যাচের আগে এ গান শুনেছে অস্ট্রেলিয়া দল। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এ নিয়ে আজ দলের এক মুখপাত্রের উদ্ধৃতিও প্রকাশ করেছে, ‘টিম মিটিংয়ে সাউন্ড অব সাইলেন্স ছিল ছোট্ট এক উপস্থাপনা।’
সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেলের এই গানের আসল অ্যাকুইস্টিক সংস্করণ রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। পরের বছর এর রিমিক্স সংস্করণ তৈরি করা হয়, যা বিভিন্ন দেশে দ্রুত জনপ্রিয় গানের শীর্ষ দশে উঠে আসে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ক্ল্যাসিক মর্যাদা পাওয়া এই ফোক রক গানকে জাতীয় রেকর্ডিংয়ে নিবন্ধিত করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, জাপান ও নেদারল্যান্ডসে দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তায় শীর্ষ দশে ছিল এই গান।
গানটির কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন—‘এবং নগ্ন আলোয় আমি দেখেছি ১০ হাজার মানুষ, হয়তো আরও বেশি/ লোকেরা মুখ না নেড়েই কথা বলছিল, সব শুনছিল কিছু না শুনেই/ লোকেরা গান লিখছিল, যা কণ্ঠে আসে না/ নৈঃশব্দ্যের আওয়াজকে বিরক্ত করার সাহস দেখায়নি কেউ।’
ফাইনালে স্টেডিয়ামের পরিবেশের সঙ্গে এসব পঙ্ক্তির কিছু জায়গা মিলে যায়। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক সম্ভবত সে জন্য ফাইনালের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বিপুলসংখ্যক (ভারতীয়) সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেয়ে সন্তুষ্টির আর কিছু হতে পারে না। আমাদের আগামীকালের লক্ষ্য এটাই।’
কামিন্সদের লক্ষ্য কিন্তু পূরণ হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচে টইটম্বুর গ্যালারিতে সবচেয়ে বড় নীরবতা হয়তো নেমেছিল বিরাট কোহলিকে কামিন্স আউট করার পরই। এরপর ভারত ২৪০ রানে অলআউট হওয়ার পথে ম্যাচের বিভিন্ন সময়ে সেই নীরবতা ফিরে এসেছে। ট্রাভিস হেডদের ব্যাটিংয়ের একপর্যায়ে স্টেডিয়াম ছাড়তে শুরু করেন দর্শক।
খেলাধুলায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলগুলোর মধ্যে শুধু ছেলেদের ক্রিকেট দলই বিশ্বকাপে একটি গানকে অবলম্বন করে লড়াইয়ের প্রেরণা নেয়নি; এর আগে গত আগস্টে মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া দলের প্রেরণা ছিল নিকি ওয়েবস্টারের ‘স্ট্রবেরি কিসেস’। সেবার প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে উঠেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা।