ক্রিকেট যদি শুধুই শক্তির খেলা হতো, একবার ভেবে দেখুন তো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাপান বা মঙ্গোলিয়ার কাছে আর কোনো দেশ কি হালে পানি পেত! হাল্ক হোগান, জন সিনা, মিক ফোলি...বিশ্বের খ্যাতনামা সব রেসলারে সমৃদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র আর এসব রেসলারের পেশিতে যে পরিমাণ শক্তি, যশপ্রীত বুমরা-কাগিসো রাবাদা-হারিস রউফ-প্যাট কামিন্সদের একেকটা বলকে তো ৬ নয়; মারতেন ১২!
আর জাপান-মঙ্গোলিয়ার কথা! পৃথিবীর বিখ্যাত সব সুমো কুস্তিগির তো এই দুই দেশেই। জাপান আকিমিতো–রোয়ানদের মতো আর মঙ্গোলিয়া ডাবাজারগাল–ডাগভাদোরিদের মতো বিশ্বসেরা সুমো কুস্তিগির উপহার দিয়েছে। তাঁদের পেশিতে যে পরিমাণ শক্তি, সেটার ধারেকাছে কি আছেন শচীন টেন্ডুলকার–ব্রায়ান লারা–বিরাট কোহলি–বাবর আজমরা!
কিন্তু ক্রিকেট তো আর শুধু পেশিশক্তির খেলা নয়। তাই তো যুক্তরাষ্ট্র নয়, ক্রিকেট খেলাটায় ছড়ি ঘোরায় কখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনো অস্ট্রেলিয়া, কখনো আবার ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ডের মতো কোনো দল। যেসব দেশের খেলোয়াড়দের পেশিশক্তির চেয়ে মস্তিষ্কের নিউরনের ক্ষমতাটাই বেশি!
ক্রিকেট শক্তির খেলা নয় বলেই অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি–গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো বোলারদেরও ওপর দিয়ে সীমানা পার করতে পারেন লিকলিকে একটা ছেলে মোহাম্মদ আশরাফুল, যেটা পারেন না বারমুডার বিশালবপুর অধিকারী ডোয়াইন লেভরক।
তাহলে ক্রিকেটটা কেমন? অনেকটা তলোয়ার যুদ্ধের মতো। এখানে শক্তির চেয়ে মাথাটাই খাটাতে হয় বেশি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতায়ই তো আদর্শ উদাহরণ আছে। নিজের মাকে রক্ষা করতে বিপুল শক্তিধর বিশাল ডাকাত বাহিনীকে ‘ভয়ানক লড়াই’য়ে হারিয়ে দেয় ছোট্ট এক খোকা!
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় দৃশ্যটা ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘এমন সময় হারে রে রে রে রে/ ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।’ এরপর বিপুল শক্তিধর ডাকাত বাহিনীর সঙ্গে খোকার তলোয়ার লড়াই শুরু। আর সেই লড়াইয়ে ‘কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে, কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।’ শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছে বিজয়ীর বেশে ফিরল ছোট্ট খোকা।
এবার ভারতের ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ ‘খোকা’ নিউজিল্যান্ড অন্য রকম পরিকল্পনা নিয়েই যায়। ভারতের স্পিন–দুর্গগুলো তারা জয় করার প্রস্তুতি নেয় স্পিন দিয়েই। ফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানানো ভারতের ‘রণক্ষেত্র’গুলো রোহিত–কোহলিদের জন্যই হয়ে ওঠে ‘বধ্যভূমি’। নিউজিল্যান্ডের এজাজ প্যাটেল–মিচেল স্যান্টনাররা একের পর এক ছাড়তে থাকেন বিষ মেশানো স্পিনতির। আর তাতেই নীল হয়ে ভারতীয়রা তিন টেস্টের সিরিজ হেরেছে ৩–০ ব্যবধানে।
ক্রিকেটেও সম্প্রতি এমন কয়েকটি অসম শক্তির লড়াইয়ে ‘খোকা’দের জয় যেন এ খেলার বুদ্ধিদীপ্ত রূপটাকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তোলে। প্রথমে ধরা যাক বাংলাদেশের পাকিস্তান সফরের কথা। দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে যায় শক্তির বিচারে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা নাজমুল হোসেনের বাংলাদেশ দল। কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বে পাকিস্তানের তুলনায় ‘খোকা’ বাংলাদেশ দল দেশে ফেরে শান মাসুদের দলকে ধবলধোলাই করে।
বাংলাদেশকে উড়িয়ে দিতে প্রথম ম্যাচে চার পেসারের বোলিং আক্রমণ নিয়ে খেলতে নেমেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ক্রিকেটের ‘খোকা’ বাংলাদেশ সেই চোখরাঙানিতে ভয় পায়নি। পাকিস্তানের সেই গতির গোলার বিরুদ্ধে খোকারা তলোয়ার (আসলে ব্যাট) চালাল বুদ্ধি দিয়ে, বুঝেশুনে। সেই তলোয়ারে ‘মাথা পড়ল কাটা’। বাংলাদেশের পেস–গোলায়ও উড়ে গেছে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ। সব মিলিয়ে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরল ‘খোকা’!
বাংলাদেশের পর নিজেদের ময়দানে পাকিস্তান ‘যুদ্ধের’ জন্য ডাকে ইংল্যান্ডকে। বাংলাদেশ আবার যায় ভারতের ময়দানে। পাকিস্তান তো আগের অস্ত্রেই ইংল্যান্ডকে কুপোকাত করতে গিয়ে প্রথম টেস্টেই খেল ধরা, গেল হেরে! শক্তির বিবেচনায় ইংল্যান্ডের কাছে আবার ‘খোকাতুল্য’ পাকিস্তান এবার নিজেদের অস্ত্র বদল করে, পেসের জায়গায় প্রধান অস্ত্র বানায় স্পিনকে। বুদ্ধির সেই প্যাঁচ কাজে লাগে খুব। পরের দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের ৪০ উইকেটের সব কটি নেন স্পিনাররা। দুই টেস্টেই জয় পায় খোকারা।
ভারতে গিয়ে অবশ্য ‘খোকা’ বাংলাদেশ আর পারেনি। দুই টেস্ট আর তিন টি–টোয়েন্টি সিরিজের সব ম্যাচ হেরেই দেশে ফিরেছে তারা। এটা অবশ্য স্বাভাবিক ফলই। সব সময় তো আর মহাবীরদের সঙ্গে খোকারা জিততে পারবে না! প্রায় একই সময়ে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ হেরে যায় নিউজিল্যান্ড। উপমহাদেশে নিউজিল্যান্ডের এই টেস্ট সিরিজ হারও কারও কাছে অস্বাভাবিক নয়। এরপরও একটা বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে—নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এটা ছিল ১৫ বছর পর শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।
কিউইদের ভারতবর্ষ জয়ে কিন্তু বিশ্বজোড়া ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে ছড়িয়ে পড়েছে অন্য রকম রোমাঞ্চ—টেস্ট ক্রিকেট তো এমনই হওয়া চাই, কে কখন কাকে ধরে দেবে, সেটা কেউ জানবে না; এটাই তো আসল আনন্দ! শুধু ভারত–নিউজিল্যান্ড সিরিজে কেন, গত দুই–আড়াই মাসে একমাত্র বাংলাদেশ–ভারত সিরিজ ছাড়া সবখানেতেই তো এ রকমটাই হয়েছে। কী রোমাঞ্চ, কী রোমাঞ্চ—কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান!
কিন্তু অস্বাভাবিক ঘটনাটা ঘটে এরপরই। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে নিউজিল্যান্ড যায় অস্ট্রেলিয়া–ইংল্যান্ডের মতো বিপুল শক্তিধর দলগুলোর কাছেও ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’ হিসেবে বিবেচিত ভারতে। সে ‘যুদ্ধের ময়দান’ নিউজিল্যান্ডের জন্য কতটা বৈরী, এটা বোঝা যাবে একটি পরিসংখ্যানে। এবারের আগে ভারতে খেলা ১২টি টেস্ট সিরিজের একটিতেও জিততে পারেনি কিউইরা।
কিন্তু এবার ভারতের ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ ‘খোকা’ নিউজিল্যান্ড অন্য রকম পরিকল্পনা নিয়েই যায়। ভারতের স্পিন–দুর্গগুলো তারা জয় করার প্রস্তুতি নেয় স্পিন দিয়েই। ফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানানো ভারতের ‘রণক্ষেত্র’গুলো রোহিত–কোহলিদের জন্যই হয়ে ওঠে ‘বধ্যভূমি’। নিউজিল্যান্ডের এজাজ প্যাটেল–মিচেল স্যান্টনাররা একের পর এক ছাড়তে থাকেন বিষ মেশানো স্পিনতির। আর তাতেই নীল হয়ে ভারতীয়রা তিন টেস্টের সিরিজ হেরেছে ৩–০ ব্যবধানে।
ভারতের ‘রণক্ষেত্রে’ খোকা নিউজিল্যান্ডের ৬৯ বছর পর সিরিজ জয়ে ক্রিকেট–বিশ্ব হয়েছে স্তম্ভিত আর খোকাদের কাছে ঘরের মাঠে ধবলধোলাইয়ে হয়ে ভারতের ক্রিকেট–মহল উঠেছে কেঁপে। এ নিয়ে এখনো চলছে কথকতা। ভারতীয়রা যতই গুমরে মরুক, কিউইদের ভারতবর্ষ জয়ে কিন্তু বিশ্বজোড়া ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে ছড়িয়ে পড়েছে অন্য রকম রোমাঞ্চ—টেস্ট ক্রিকেট তো এমনই হওয়া চাই, কে কখন কাকে ধরে দেবে, সেটা কেউ জানবে না; এটাই তো আসল আনন্দ! শুধু ভারত–নিউজিল্যান্ড সিরিজে কেন, গত দুই–আড়াই মাসে একমাত্র বাংলাদেশ–ভারত সিরিজ ছাড়া সবখানেতেই তো এ রকমটাই হয়েছে। কী রোমাঞ্চ, কী রোমাঞ্চ—কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান!
শুধু টেস্ট–রাজ্যেই কি এমন উলটপালট হয়েছে, এই যে আজ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তান ২–১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জিতল; এটাও তো ‘খোকা’র কাছে বিপুল শক্তিশালীর মার খাওয়ার গল্প। অনেকেই বলতে পারেন, অস্ট্রেলিয়া তো সিরিজের শেষ ম্যাচে পূর্ণশক্তির দল ছিলই না। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে তো পুরো শক্তির দলই খেলেছে, সেই দুই ম্যাচের একটাতে জিততে তুমুল লড়াই করতে হয়েছে, অন্যটাতে হেরেছে খুব বাজেভাবে।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তান যে ‘খোকা’, সেটা বোঝা যায় একটি পরিসংখ্যানে। তিন সংস্করণ মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এটা মাত্র দ্বিতীয় সিরিজ জয়। প্রথমটি ২২ বছর আগে। ২০০২ সালে জেতা সেই সিরিজটিও ছিল ওয়ানডে লড়াই। তা খোকাদের হাতে শক্তিশালীরা মার খাচ্ছে, খাক না—এতে যে আদতে ক্রিকেটেরই লাভ, ক্রিকেট ঘিরে ক্রিকেটপ্রেমীদের ক্ষয়ে যেতে চলা রোমাঞ্চটা যে আবার জোড়া লাগলেও লাগতে পারে!