ক্রিকেটে সফল অধিনায়কদের এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে, যা তাঁদের নেতা হিসেবে সাফল্য এনে দেয়। মাইক বেয়ারলি যেমন দারুণ চিন্তক ছিলেন। ক্লাইভ লয়েড ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী। ইমরান খান দারুণভাবে প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারতেন। দৃঢ়চেতা স্টিভ ওয়াহ অস্ট্রেলিয়াকে অজেয় দলে রূপান্তরিত করেছিলেন। শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপ জেতানো অর্জুনা রানাতুঙ্গা ছিলেন লড়াকু অধিনায়ক। আবার মাহেলা জয়াবর্ধনে ছিলেন দারুণ কৌশলী। সব সফল খেলোয়াড় আবার ভালো অধিনায়ক হন না। উদাহরণ হিসেবে ব্রায়ান লারা ও শচীন টেন্ডুলকারের কথা বলাই যায়।
অধিনায়কদের এই ফিরিস্তি দেওয়ার একটা কারণ আছে, সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার সাদা বলের অধিনায়ক দাসুন শানাকার কীর্তি তুলে ধরা। লয়েড–ইমরানদের পথ অনেক দূরের বাতিঘর। তবে অনভিজ্ঞ, তরুণ ও বাজে পারফরম্যান্সের কারণে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে যেভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে তুলে এনেছেন শানাকা, তা প্রশংসনীয়।
এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু করা শ্রীলঙ্কা এখন পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার অপেক্ষায়। শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না, তা কয়েক ঘণ্টা পরেই জানা যাবে। তবে যে নৈপুণ্যে দলটি ফাইনাল খেলছে, সে কৃতিত্ব তাদের দিতেই হবে। যার অনেকটাই পাবেন অধিনায়ক শানাকা।
দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকেরা যখন নেতৃত্ব নির্বাচনে বসেন, তখন শানাকা পছন্দের তালিকাতেও ছিলেন না। এমনকি তিনি সহ–অধিনায়কও ছিলেন না। কুশল পেরেরা অধিনায়ক ও তাঁর সহ–অধিনায়ক করা হয়েছিল কুশল মেন্ডিসকে।
সে সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, দলে শুধু কুশল পেরেরাই একমাত্র খেলোয়াড়, যাঁর জায়গা নিশ্চিত। তবে কেউ কেউ মনে করেছিলেন, যে নির্বাচক প্যানেল অনেক সিনিয়রকে বাদ দিতে দ্বিধা করেনি, তাদের নেতা নির্বাচনে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল। যখন আপনি একটি দলকে পুনর্গঠন করবেন, আপনার নতুন দিকনির্দেশনারও প্রয়োজন হবে।
চোটের সঙ্গে ‘সখ্য’ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে কুশল পেরেরার নেতৃত্ব নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল অনেকের। পরে চুক্তি নিয়ে তৈরি হওয়া সংকটের সময় বেশ চাপে পড়েন কুশল পেরেরা। নেতা হিসেবে তিনিও আর স্থায়ী হতে পারেননি।
দল যখন বিশৃঙ্খল অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখনই অধিনায়কত্ব পান শানাকা। ইংল্যান্ডে বড় হার ও কোভিড প্রটোকল ভাঙায় তিন খেলোয়াড়কে দেশে ফিরে আসতে হলে বেশ চাপে পড়ে লঙ্কান দল। এরপর কুশল পেরেরাকে সরিয়ে শানাকাকে নেতৃত্ব দেওয়া হয়। যখন অধিনায়কত্ব নেওয়ার ব্যাপারে রাজি হন, শানাকাকে চুক্তি স্বাক্ষর করতেও বলা হয়। তিনি তাতেও সায় দেন।
এতে বোর্ডের সঙ্গে বিরোধে থাকা অনেক খেলোয়াড় ক্ষুব্ধও হন। শুরুর সময়টা শানাকার জন্য বেশ কঠিন ছিল। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ঠিকই নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন শানাকা।
শানাকা ও মিকি আর্থার জুটি লঙ্কান ক্রিকেটের ভাগ্য পরিবর্তনে দারুণভাবে ভূমিকা রেখেছে। মাঝে নিজেদের মতের অমিল নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধেও জড়িয়েছিলেন দুজন, পরে অবশ্য সেই সমস্যা দ্রুত মিটিয়েও ফেলেন তিনি। তাঁরা এরপর তরুণ খেলোয়াড়দের বাছাই করে তাঁদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেন। বলা যায়, ডুবতে থাকা একটি দলকে নিয়ে রীতিমতো ঘুরে দাঁড়ান শানাকা।
অধিনায়ক শানাকাকে নিয়ে আর্থার বলেছেন, ‘দাসুনের বিশেষত্ব হচ্ছে, নিজের ওপর বিশ্বাস আছে ও সে দলকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। সে পারফরম্যান্স করে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেয়। দলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার আছে।’
অধিনায়ক হিসেবে কৌশলের দিক থেকে শানাকা হয়তো খুব একটা চতুর নন। তবে তাঁর শক্তি হচ্ছে মনোযোগী থাকতে পারা এবং সতীর্থদেরও মনোযোগী রাখতে পারা। খেলোয়াড় হিসেবেও তিনি দারুণ। ব্যাটসম্যান শানাকা তাঁর শক্তি সম্পর্কে জানেন ও ফলও নিয়ে আসতে পারেন। তাঁকে হয়তো কাট শট খেলতে দেখা যাবে না। তবে জোরে শট খেলে কিংবা মিড উইকেটের ওপর দিয়ে পুল করে ঠিকই বল সীমানা ছাড়া করতে পারেন। এই শটগুলো খেলায় তাঁর দারুণ পারদর্শিতা আছে। এভাবে প্রচুর রানও তিনি আদায় করতে পারেন।
শুধু ব্যাটিংয়েই নন, বোলিংয়েও দারুণ কার্যকর শানাকা।এশিয়া কাপেও দারুণ ছন্দে আছেন শানাকা। দলের প্রয়োজনে দায়িত্ব নিয়েই দলকে পথ দেখাচ্ছেন। ভারতের বিপক্ষে ১৭৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৮ বলে অপরাজিত ৩৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন লঙ্কান অধিনায়ক। সেদিন বল হাতেও নিয়েছিলেন ২ উইকেট।
এর আগে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে বাঁচামরার ম্যাচে ৩৩ বলে ৪৫ রানের গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস খেলেছিলেন শানাকা। আর অধিনায়ক হিসেবেও দলকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছেন তিনি। আজ রাতে দুবাইয়ে আরেকবার শানাকা–জাদুর দেখা মিললে কে জানে হয়তো এশিয়া কাপে ষষ্ঠ শিরোপার দেখাও হয়তো পেয়ে যেতে পারে শ্রীলঙ্কা।