টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে আবির্ভাবের আগেই টি–টোয়েন্টির ঢংয়ে ব্যাটিং করতেন তিনি। ওয়ানডেতে উইকেট ধরে রাখতে শুরুতে দেখেশুনে খেলার যে ধারা ছিল নব্বইয়ের দশকে, সেটি ভেঙে দেওয়ার পেছনে অন্যতম কারিগরও। মাতারা নামের শ্রীলঙ্কার প্রান্তিক এক অঞ্চল থেকে উঠে এসে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বলে তাঁকে বলা হতো ‘মাতারা হারিকেন’।
তবে ক্রিকেটার হিসেবে নন্দিত সনাৎ জয়াসুরিয়ার পরবর্তী কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই ছিল নিন্দিত। নির্বাচক থাকা অবস্থায় মন্ত্রীর ছেলেকে দলে ডাকা, দল নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব, দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা না করায় ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞায় বেশ সমালোচনার মধ্যেই ছিলেন। সেই জয়াসুরিয়া এবার শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে আবির্ভূত ত্রাতা হিসেবে। মিলছে আরেকটি নন্দিত অধ্যায়ের আভাস।
আভাস বুঝতে কিছু একটা অবয়ব লাগে, চিহ্ন লাগে। গত ৩ মাসে ৫৫ বছর বয়সী জয়াসুরিয়া সেটা ভালো মতোই তৈরি করতে পেরেছেন। জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা দলের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনটি সিরিজে তাঁর অধীনে খেলেছে দল। প্রথমটি ছিল ভারতের বিপক্ষে। দেশের মাটিতে সদ্য বিশ্বকাপজয়ী ভারতের কাছে টি–টোয়েন্টি সিরিজে হারলেও ওয়ানডে সিরিজ ২–০ ব্যবধানে জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। রোহিত শর্মা–বিরাট কোহলিদের বিপক্ষে আসা জয়টি ছিল ভারতের বিপক্ষে ২৭ বছর পর শ্রীলঙ্কার প্রথম সিরিজ জয়।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের মতে সনাৎ জয়াসুরিয়ার কোচ হওয়া শ্রীলঙ্কা দলের সাফল্যের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
পরের চ্যালেঞ্জ ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজ, তা–ও ইংল্যান্ডেই। এই সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে হারলেও ওভালে শেষ টেস্টে ৮ উইকেটের বড় জয় তোলে ধনঞ্জয়া ডি সিলভার দল। এটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ বছর পর শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্ট জয়। ওভালের সেই সাফল্যের রেশই বজায় থেকেছে গলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজে। প্রথমটিতে জয় ৬৩ রানে, পরেরটিতে ইনিংস ও ১৫৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। পেছনের ইতিহাস বলছে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজ জিতল ১৫ বছর পর!
এই যে ভারত, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দীর্ঘ সময় পর জয়ের দেখা পাওয়া, তাতে জয়াসুরিয়ার অধীনে থাকা বর্তমান দলের সাফল্য যেমন ফুটিয়ে তুলছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে মাঝে লম্বা এক খরায় ছিল দ্বীপ দেশটির ক্রিকেট। বেশি দূর নয়, করোনা মহামারি–পরবর্তী তিন বছরে তাকালেই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের দুর্গতিটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। গত তিন মাসে ৫ টেস্টের মধ্যে তিনটিতে জেতা শ্রীলঙ্কা ২০২৩ সালে ৬টি খেলে জিতেছিল ২টি (চারটিতে হার), ২০২২ সালে ৮টিতে ২টি (হার ৪, ২ ড্র) আর ২০২১ সালে ৯টিতে ৩টি (৩ হার ৩ ড্র)।
টেস্টের সাফল্য আর ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সিরিজ জয় দৃশ্যমান উন্নতি। কিন্তু দলের ভেতরেও জয়াসুরিয়ার বড় প্রভাব পড়েছে, সেটি বেরিয়ে এসেছে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের কথায়। শ্রীলঙ্কার বর্তমানের দলটির সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ৩৭ বছর বয়সী ম্যাথুস। ২০০৯ সাল থেকে দলের সঙ্গে থাকা এই অলরাউন্ডার জয়াসুরিয়ার কোচ হওয়াকে অভিহিত করেছেন শ্রীলঙ্কা দলের সাফল্যের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে, ‘তিনি ক্রিকেট ডিরেক্টর হিসেবে দুর্দান্ত ছিলেন, এখন কোচ হিসেবেও। সবার সঙ্গে যোগাযোগটা খুব ভালো, স্বাধীনতাও দেন। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের আগামীর জন্য গড়ে তোলায়ও দারুণ কাজ করছেন।’
ম্যাথুসের মতো অভিজ্ঞ একজনের মতো এসএলসিও (শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট) জয়াসুরিয়ার ওপর যারপরনাই সন্তুষ্ট। জুনে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ক্রিস সিলভারউড দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর জয়াসুরিয়াকে যখন অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখনই বোর্ডের প্রধান নির্বাহী অ্যাশলি ডি সিলভা জানিয়ে দিয়েছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই কোচের আবেদন চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। সেই ডি সিলভাই ১২ সপ্তাহ পর গতকাল ইএসপিএনক্রিকইনফোকে বলেছেন, খোঁজাখুজি শেষ। জয়াসুরিয়াকেই স্থায়ীভাবে কোচের দায়িত্ব দিতে চলেছেন তাঁরা, ‘চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। দুই তিন দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’
২০১৩ সালে তখনকার উপমন্ত্রী কেহেলিয়া রামবুকভেলার ছেলে রামিথ রামবুকভেলাকে দলে নিয়ে প্রধান নির্বাচক হিসেবে সমালোচিত আর ২০১৯ সালে আকসুকে দুর্নীতির তদন্তে সহযোগিতা না করার দায়ে দুই বছরের নিষিদ্ধ হওয়ায় যে দাগ লেগেছিল তাঁর গায়ে, কোচ জয়াসুরিয়া এখন সে দাগ মুছে দেওয়ার অপেক্ষায়। তৃতীয় অধ্যায়ে আরও একবার মাতারা হারিকেন হয়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ইতিবাচক ঝড় এই বইয়ে দিলেন বলে!