পাকিস্তানে এশিয়া কাপ খেলতে রাজি নয় ভারত
পাকিস্তানে এশিয়া কাপ খেলতে রাজি নয় ভারত

ভারতে ফুটবল-হকি খেলতে রাজি পাকিস্তান, ক্রিকেটে ‘না’ কেন

আগামী মাসে ভারতের বেঙ্গালুরুতে শুরু হবে ফুটবলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। আগস্টে চেন্নাইয়ে শুরু হবে হকির এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। দুটি টুর্নামেন্টেই অংশ নেওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান।

কিন্তু ভারতের মাটিতে ফুটবল ও হকি খেলতে রাজি হলেও ক্রিকেটে ‘না’ বলার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে পাকিস্তান। অক্টোবর–নভেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে ভারতে। এরই মধ্যে ক্রিকেটের বৈশ্বিক আসরটিতে না খেলার হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)।

সামনের ছয় মাসের মধ্যে ভারতে হতে যাওয়া তিনটি টুর্নামেন্টের কোনোটিই দ্বিপাক্ষিক নয়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ), হকিতে আয়োজক এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) আর ক্রিকেটে আয়োজক ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।

দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কে অবনতির কারণে গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট, ফুটবল বা হকিতে দ্বিপক্ষীয় সফর করে না। মুখোমুখি যা হয়েছে, সবই আইসিসি, অলিম্পিক, কমনওয়েলথ গেমস, সাফ বা ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল হকির (এফআইএইচ) টুর্নামেন্টে।

যেমন ফুটবলে ভারত–পাকিস্তান সর্বশেষ আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলেছে ২০০৫ সালে, লাহোরে। এর পরে চারবার মুখোমুখি হলেও সব কটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। যার সর্বশেষটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে।

আগামী ২১ জুন সাফের ১৪তম আসর শুরু হতে যাচ্ছে ভারতে। বুধবার এই টুর্নামেন্টের ড্র হয়েছে, যেখানে ‘এ’ গ্রুপে পড়েছে ভারত ও পাকিস্তান। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) সভাপতি কল্যাণ চৌবে ড্র অনুষ্ঠানের পর পিটিআইকে বলেন, ‘পাকিস্তান অংশ নেবে নিশ্চিত করার পরই ড্রতে নাম রাখা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেরই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার অধিকার আছে।’

পাকিস্তান ফুটবল দল সাফে খেলার জন্য ভিসা–সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় পড়বে না বলে জানান এআইএফএফের সেক্রেটারি শাজি প্রভাকরন, ‘ভিসা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তারা (পাকিস্তান) এরই মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন করেছে। প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।’

এশিয়ান হকি ফেডারেশনের টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হবে ৩–১২ আগস্ট চেন্নাইয়ে। ৬ দলের এই টুর্নামেন্ট খেলার আগ্রহ দেখিয়েছে পাকিস্তান হকি ফেডারেশন। গত ২৪ এপ্রিল হকি ইউনিট অব তামিলনাড়ুর প্রেসিডেন্ট জে. সেকার মনোহরন দ্য হিন্দুকে জানান, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান।

আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাওয়া পাকিস্তান হকি ফেডারেশন যদি শেষ পর্যন্ত দল পাঠায়, তবে এটি হবে ২০১৮ সালের পর ভারতে পাকিস্তান হকি দলের প্রথম সফর। পাঁচ বছর আগে ভুবনেশ্বরে হকি বিশ্বকাপ খেলতে গেলেও ভারত–পাকিস্তানের মুখোমুখি দেখা হয়নি। ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছে ২০১১ সালে, আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে।

এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পাকিস্তান হকি দলের ভারতের ভিসা পেতে সমস্যা হবে না বলে মনে করেন হকি ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক ভোলানাথ সিং। এপ্রিলে ইএসপিএনকে তিনি বলেন, ‘এটা আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট নয়। এখানে এশিয়ার সেরা দলগুলো অংশ নিচ্ছে। পাকিস্তান দলের খেলার অনুমতি পেতে সমস্যা হবে না।’

ফুটবল, হকির মতো ক্রিকেটেও পাকিস্তান দলের ভিসা পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পিসিবি চেয়ারম্যান নাজাম শেঠি নিজেরাই দল পাঠানোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, পাকিস্তান আইসিসি আয়োজিত ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে তখনই ভারতে যাবে, যদি এশিয়া কাপ খেলতে ভারত পাকিস্তানে যায়। সূচি অনুযায়ী এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) আয়োজিত ২০২৩ এশিয়া কাপ হওয়ার কথা পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই সরকারের অনুমতি না থাকার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তানে যেতে রাজি নয়। তারা চায় নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলতে।

এ দিকে ২০২৩ এশিয়া কাপের পর ২০২৫ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও হওয়ার কথা পাকিস্তানে। এখন আপস করলে পরেও ভুগতে হবে ভাবনায় নিজেদের মাটিতে এশিয়া কাপ আয়োজনে অনড় পাকিস্তান। ভারত–পাকিস্তান দুই দেশের টানাটানিতে এখনো এশিয়া কাপের ভেন্যু চূড়ান্ত করা যায়নি। পিসিবি চেয়ারম্যান নাজাম শেঠি গত দুই সপ্তাহের মধ্যে এ নিয়ে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোতে।

ভেন্যু নিয়ে জটিলতা কাটছেই না

যেখানে মূল সুর একটাই—ভারত সরকার পাকিস্তানে দল পাঠাতে রাজি না হলে পাকিস্তান সরকারও ভারতে দল পাঠাতে দেবে না। বিশ্বকাপের বছর বলে এশিয়া কাপ আয়োজিত হোক, এটি আন্তরিকভাবে চান জানিয়ে ভেন্যুর বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও বলেছেন শেঠি। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মাটিতে টুর্নামেন্ট হলেও ভারতের ম্যাচ হবে ভিন্ন কোনো দেশে। তবে ভারত যেহেতু পাকিস্তানে যাবেই না, পাকিস্তানও ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে খেলতে চায়।

মূলত এ জায়গাতেই সাফ ফুটবল ও হকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সঙ্গে ক্রিকেট বিশ্বকাপের মূল পার্থক্য। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও হকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্তানের দর–কষাকষির কিছু নেই। কিন্তু ক্রিকেটে আছে এশিয়া কাপ ও ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সমীকরণ। যে কারণে আগেভাগে হিসাব চুকিয়ে ফেলতে চায় পাকিস্তান।

পাকিস্তানের আয়োজক–সমীকরণের পাশাপাশি আছে মূল কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বশীলতাও। ফুটবলের বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ ফিফা আর হকির কর্তৃপক্ষ এফআইএইচ। দুটি খেলাই আবার ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটিতে (আইওসি) নিবন্ধিত। এ খেলাগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা হয়।

২০১৯ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত শুটিং ওয়ার্ল্ড কাপে পাকিস্তানের দুজন শুটারকে ভিসা দেয়নি ভারত সরকার। এ ঘটনায় ভারতের আয়োজক স্বত্বে নিষেধাজ্ঞা দেয় আইওসি। পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ‘সব ক্রীড়াবিদকে ভিসা প্রদানের নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হবে না’ উল্লেখ করে লিখিত দেওয়ার পর ওই বছরের জুনে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

রাজনৈতিক বিষয় সামাল দেওয়ার বিষয়টিতে আইসিসির অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। যার ছাপ পাওয়া যায় গত সপ্তাহে ভারতের স্পোর্টস তাককে দেওয়া নাজাম শেঠির সাক্ষাৎকারে।

পিসিবি চেয়ারম্যান নাজাম শেঠি ভারতে দল পাঠানোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রেখেছেন

পাকিস্তান বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে না গেলে আইসিসি নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, এমন প্রশ্ন করলে পিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘কিসের নিষেধাজ্ঞা? আইসিসিতে নিরাপত্তাবিষয়ক ধারা আছে। লেখা আছে নিরাপত্তা সমস্যা থাকলে খেলতে হবে না। (এ ক্ষেত্রে) নিরাপত্তা সমস্যার কথা তো আমরাও বলতে পারি।’ শেঠির কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, ভারতের মতো নিরাপত্তা–কার্ড খেলার সম্ভাবনা আছে তাঁর দেশেরও।

আয়োজক–সমীকরণ আর কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার সমান্তরালে আছে আরেকটি বড় কারণ—অহম।

ভারত–পাকিস্তান দুই দেশের গৌরবের অন্যতম প্রতীক ক্রিকেট। অহম দেখানোর জায়গাও এটিই। যে কারণে ফুটবল, হকিতে যেমনই হোক, ক্রিকেটের হিসাব–নিকাশ ভিন্ন রকম।