বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে একসঙ্গে রিশাদ হোসেন (বাঁয়ে) ও জাকের আলী
বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে একসঙ্গে রিশাদ হোসেন (বাঁয়ে) ও জাকের আলী

জাকের–রিশাদ কি হতে পারবেন নাজমুলের বড় ‘অস্ত্র’

লিকলিকে শরীর। চেহারায় কৈশোরের ছাপ। নাকের নিচে গোঁফ ঠিকমতো ওঠেনি। ২০১৮ সাল, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠে রিশাদ হোসেনকে সেই প্রথম দেখা।

২০১৭ সালের রবি স্পিনার হান্ট থেকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নেওয়া নীলফামারীর রিশাদ লেগ স্পিনার। বল খুব একটা টার্ন করান না, একটু জোরের ওপর করেন। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই তাই লেগ স্পিনার রিশাদকে বোঝাতে অনেকে ভারতীয় কিংবদন্তি অনিল কুম্বলের নাম নিতেন।

কিন্তু প্রথম দেখায় বেশি চোখে পড়েছে তাঁর ফিল্ডিং। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে স্লিপ ক্যাচিং অনুশীলন করছিলেন। প্রথম, দ্বিতীয় স্লিপ, এরপর গালি…সবখানেই তিনি বাজপাখি! বাউন্ডারি সীমানার ফিল্ডিং অনুশীলনেও সমান ক্ষিপ্র। শোনা গেল রিশাদ নাকি বেশ বড় ছক্কাও মারেন। তার মানে সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য দারুণ এক ‘প্যাকেজ’। 

লেগ স্পিন হান্টের সেরা ‘অ্যাকুরেট’ স্পিনারের পুরস্কার জেতা রিশাদের জায়গা হয় বিসিবির বয়সভিত্তিক দলে। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রাথমিক দলে ছিলেন। পরে মূল দলে জায়গা না হলেও বিসিবি রিশাদকে হাইপারফরম্যান্স প্রোগ্রামে রেখে অনুশীলন ও ম্যাচের মধ্যে থাকার সুযোগ করে দেয়।

২০১৭ সালের রবি স্পিনার হান্ট থেকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন রিশাদ

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০১৮ সালে অভিষেক রিশাদের, ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ২০১৯ সালে। লিস্ট ‘এ’ অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২০২২ সাল পর্যন্ত। তবে রিশাদকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব যতটা না ঘরোয়া ক্রিকেটের, তার চেয়ে বেশি বিসিবির। ঘরোয়া ক্রিকেটের দলগুলোর লেগ স্পিনবিমুখ মানসিকতা তাঁর একাদশে জায়গা পাওয়ায় বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত হওয়ার আগেই তাঁকে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। 

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতে রিশাদ বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ হিসেবে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে পেয়েছেন, যিনি বরাবরই লেগ স্পিনারদের বড় পৃষ্ঠপোষক। গত বছরের মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক, বছরের শেষে ডিসেম্বরের নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডেতে। সেই থেকেই তিনি সাদা বলের ক্রিকেটে নিয়মিত মুখ, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে।

মাঝের ওভারে জুটি ভাঙতে রিশাদের লেগ স্পিন হয়ে উঠেছে অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের অন্যতম অস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই রিশাদের বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়াটাই ছিল প্রত্যাশিত। জিম্বাবুয়ে সিরিজ জেতার পর অধিনায়ক নাজমুলও সিরিজের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির তালিকায় রিশাদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কথা বলেছেন। এবার বড় মঞ্চে দ্যুতি ছড়ানোর পালা। 

ব্যাটিং হাতে ঝড় তুলতে পারেন রিশাদ

রিশাদের মতো ভাগ্যবান নন জাকের আলী। জাতীয় দলের কোচরা হন্যে হয়ে তাঁর মতো ক্রিকেটারকে খোঁজেননি। ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে থাকা সিলেটের এই উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান লম্বা সময় ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের নীরব পারফরমার। জাতীয় ক্রিকেট লিগে কয়েক বছর ধরেই সিলেট বিভাগের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। টপ অর্ডার ভাঙে, তিনি মাঝে এসে সে ভাঙন জোড়া লাগান। বোলারদের সঙ্গে ছোট ছোট জুটি গড়ে দলকে লড়াই করার রান এনে দেন।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেন আদর্শ ওয়ানডে-ফ্লোটারের ভূমিকায়। দরকার হলে ওপেনিং, না হলে মিডল অর্ডার। বিপিএলে তাঁর ছোট ছোট ক্যামিও ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিত ঠিকই, কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় জাকেরের নাম খুঁজে পাওয়া যেত না। ২০ ওভারের খেলায় তিনি কতটা কার্যকর, সেটা তাই নির্বাচকদের নজরেও আসেনি।

জাকের মিডল অর্ডার ফিনিশার হিসেবে পরিচিত। তাঁর পছন্দের খেলোয়াড়ের তালিকায় তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফিনিশারদের নামই বেশি।

ফিনিশারের ভূমিকায় ভালো করে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিয়েছেন জাকের

সর্বশেষ বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে ১৪ ম্যাচে ১০ ইনিংস ব্যাট করে ১৯৯ রান করেন ১৪১ স্ট্রাইক রেটে। সেই সুবাদে জাকেরের সুযোগ আসে বিপিএল–পরবর্তী শ্রীলঙ্কা সিরিজের টি-টোয়েন্টি দলে। নিজের ঘরের মাঠ সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ম্যাচেই ৬ ছক্কায় ৩৪ বলে খেলেছেন ৬৮ রানের দারুণ ইনিংস।

বাংলাদেশ সেদিন হারলেও পেয়েছে জাকেরকে, যিনি মিডল অর্ডারে ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারেন নিয়মিত মুখ। এরপর জিম্বাবুয়ে সিরিজেও সামর্থের প্রমাণ দিয়ে জাকের এলেন বিশ্বকাপ দলে।

তবে এশিয়ান গেমসের ৩টি ম্যাচ বাদ দিলে এখন পর্যন্ত মাত্র ৮টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন জাকের, সেটিও শ্রীলঙ্কা আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে বড় দলের গতিময় পেসারদের বিপক্ষে তাঁর পাওয়ার হিটিং কাজে দেবে তো?

জাকেরের উইকেটকিপিং–সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে

তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ উইকেটকিপিং–সামর্থ্যের কারণেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—জাকের দলের প্রথম পছন্দের উইকেটকিপার হতে পারবেন তো? আশা, একের পর এক বাধা পেরিয়ে আসা জাকের পার হয়ে যাবেন এই বাধাও।