শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে নিরাপত্তা মহড়া দেখছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা প্রতিনিধিদলের প্রধান রোরি স্টেইন (ডানে) ও তাঁর এক সঙ্গী।
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে নিরাপত্তা মহড়া দেখছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা প্রতিনিধিদলের প্রধান রোরি স্টেইন (ডানে) ও তাঁর এক সঙ্গী।

ম্যান্ডেলার প্রধান বডিগার্ড বললে বাংলাদেশে আসবে দক্ষিণ আফ্রিকা দল

‘হ্যালো’র জবাবে ছোট্ট করে ‘হ্যালো’। তারপর আর একটি শব্দ বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে উঠে বসলেন কালো মাইক্রোবাসে। গন্তব্য সেনানিবাস।

রোরি জন স্টেইন, বেশি পরিচিত রোরি স্টেইন নামে। ঢাকা থেকে আজ রাতেই ফিরে যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ঢাকা, চট্টগ্রামে সব দেখেটেখে গেছেন। মাঠ, অনুশীলন সুবিধা, হোটেল, নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে রোরি স্টেইন সবচেয়ে সূক্ষ দৃষ্টিতে দেখলেন বোধ হয় আজ দুপুরে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হওয়া নিরাপত্তা মহড়াটা। ১৮ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা পুলিশে চাকরি করা এই ভদ্রলোকের জীবনটাই যে নিরাপত্তায় ‘ঘেরা’!

শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ডসম্যানরা ক্রিকেটার সেজে বল–ব্যাট নিয়ে খেলছিলেন। হঠাৎ মাঠের বড় লোহার গেট দিয়ে হইহই করে ঢুকে পড়ল একদল ‘সন্ত্রাসী’। ‘ক্রিকেটারদে’র ধাওয়া দিল, তারা দৌড়ে পালালেন অ্যাওয়ে দলের ড্রেসিংরুমে।
একটু পর আক্রান্ত ক্রিকেটারদের উদ্ধার করতে লোহার গেট দিয়েই ঢুকল একদল সত্যিকারের প্যারা কমান্ডো। বন্দুক তাক করে রীতিমতো যুদ্ধসাজ তাঁদের। একদল দৌড়ে গেল ডান দিকের বাউন্ডারি রশি ধরে, আরেক দল ড্রেসিংরুমের দিকে বাঁ দিকের রশি ধরে। এর মধ্যেই কানে তালা লাগিয়ে চলছে ঠা ঠা গুলির শব্দ (ফাঁকা আওয়াজ)। রীতিমতো আতঙ্কজনক এক পরিস্থিতি। মাঠে ঢুকে কমান্ডোরা গ্যালারির দিকে বন্দুক তাক করে বসে পড়লেন হাঁটু গেড়ে।

১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ম্যান্ডেলার প্রধান ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব নেন ররি স্টেইন। তাঁর দায়িত্ব ছিল দেশ ও দেশের বাইরে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সামান্য পর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের আকাশে উড়ে এল একটা হেলিকপ্টার। বাতাসের আন্দোলন তুলে নামল সবুজ মাঠে। অ্যাওয়ে ড্রেসিংরুম থেকে কমান্ডোদের সহায়তায় মাথা ঝুঁকিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ক্রিকেটাররা এসে উঠলেন হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টার তাঁদের নিয়ে উড়ে চলে গেল নিরাপদ গন্তব্যে। আসলে তা নয়, শুধু হেলিকপ্টারটাই উড়ে গেল। এতক্ষণ ক্রিকেটার চরিত্রে অভিনয় করা গ্রাউন্ডসম্যানরা থেকে গেলেন মাঠেই। মহড়া শেষ।

রোমাঞ্চকর মহড়াই দেখা গেল শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে

২২–২৩ মিনিটের থ্রিলিং মহড়ায় রোরি স্টেইন মূলত দেখলেন, আগামী মাসে মিরপুরে টেস্ট খেলতে এসে যদি না কোনোভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী কীভাবে তাদের উদ্ধার করবে। মহড়ায় ক্রিকেটারদের ড্রেসিংরুম হিসেবে সে কারণেই দেখানো হলো মিরপুরের অ্যাওয়ে ড্রেসিংরুমটাকে।

ভালো কথা, কে এই রোরি স্টেইন, সেটাই তো বলা হয়নি এখনো! বাংলাদেশে আজ রাতে শেষ হতে চলা তিন দিনের সফরে স্টেইন ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা প্রতিনিধিদলের প্রধান। জোহানেসবার্গের দীর্ঘদেহী এই শ্বেতাঙ্গ আপাতত ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করলেও নিরাপত্তার জগতে তাঁর পরিচয়টা আরও বড় ও বিস্তৃত।

১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ম্যান্ডেলার প্রধান ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব নেন স্টেইন। তাঁর দায়িত্ব ছিল দেশ ও দেশের বাইরে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ম্যান্ডেলার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে ‘ওয়ান স্টেপ বিহাইন্ড ম্যান্ডেলা: দ্য স্টোরি অব রোরি স্টেইন, নেলসন ম্যান্ডেলা’স চিফ বডিগার্ড’ নামে একটা স্মৃতিকথাও লেখেন স্টেইন, যার সহ–লেখক ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও টেলিভিশন প্রযোজক দেবোরা পাট্টা।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ স্টেইনের আরও পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন ১৯৯৫ রাগবি ওয়ার্ল্ড কাপে নিউজিল্যান্ড অল ব্ল্যাকসের নিরাপত্তা লিয়াঁজো। ম্যান্ডেলাকে নিয়ে লেখা স্মৃতিকথায় স্টেইন দাবি করেছেন, সেবার স্প্রিংবকদের বিপক্ষে ফাইনালের আগে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ দেওয়া হয়েছিল নিউজিল্যান্ড দলকে। তাঁর বিশ্বাস, ষড়যন্ত্রটা করেছিল বেটিং সিন্ডিকেটের লোকজন।

গ্যালারিতে সহকর্মীকে নিয়ে নিরাপত্তা মহড়া মনোযোগ দিয়েই দেখলেন স্টেইন। পেছনে পুলিশ ও সংবাদকর্মীর দল

উপমহাদেশ সফরের আগে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলগুলো বরাবরই নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখতে সংশ্লিষ্ট দেশে অগ্রিম নিরাপত্তা প্রতিনিধিদল পাঠায়। বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং তার আগের ঘটনাবলির কারণে এবার দক্ষিণ আফ্রিকাও প্রথমবারের মতো পাঠাল সে রকমই একটা প্রতিনিধিদল, যাতে রোরি স্টেইনের সঙ্গী হয়েছেন ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার অপারেশনস ম্যানেজার সিভুইলি এমকিংওয়ানা, স্বাধীন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান খন্তো ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের সংগঠনের প্রতিনিধি প্রোটিয়াদের হয়ে ৫৯টি ওয়ানডে ও ৩৮টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা সাবেক অলরাউন্ডার ফারহান বেহারডিয়েন।

বিদেশি দলের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকেরা ঢাকায় এসে আগেও নিরাপত্তা মহড়া দেখেছেন। নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে আসাটাও নিয়মিত বিষয় হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদল নিয়ে বাড়তি আগ্রহের বড় কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটাই বাংলাদেশে কোনো বিদেশি ক্রিকেট দলের প্রথম সফর হবে। আরেকটা কারণ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে দলটির প্রধান স্টেইনের বর্ণাঢ্য জীবন। সে জন্যই তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হয়, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি স্টেইন বা তাঁর সঙ্গীদের কেউ।

এখন পর্যন্ত আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে কোনো সংশয় দেখছে না বিসিবি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদলের ইতিবাচক মনোভাব দেখে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তাঁরা।

নব্বই দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভিআইপি নিরাপত্তা দল থেকে বের হয়ে ম্যান্ডেলার সাবেক প্রধান বডিগার্ড রোরি স্টেইন ও তাঁর প্রয়াত পার্টনার বব নিকলস মিলে গড়ে তোলেন এনএসএ (নিকোলস স্টেইন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস) গ্লোবাল সিকিউরিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, বিশ্বকাপ রাগবি, অলিম্পিকের মতো বড় বড় ক্রীড়া ইভেন্টে নিরাপত্তা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করে প্রতিষ্ঠানটি।

ক্রীড়া ইভেন্টের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘সিকিউরিটি গুরু’ হিসেবে খ্যাত স্টেইন এ বছর প্যারিস অলিম্পিক শুরুর আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ ইসরায়েলি অ্যাথলেটকে হত্যার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া ইভেন্ট ও খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া শুরু হয়।

খেলাধুলার সঙ্গে স্টেইনের আরেকটা সম্পর্ক, তাঁর ছেলে কাইল স্টেইন খেলেন স্কটল্যান্ড রাগবি দলে। মা স্কটিশ, সেই সুবাদেই তাঁর স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলা।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে সফরে পাঠানোর আগে বাংলাদেশের নিরাপত্তা দেখতে স্টেইনের মতো একজনের নেতৃত্বে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোতে পরিষ্কার—এই সফরে ক্রিকেটারদের নিরাপত্তায় কোনো খুঁত রাখতে চায় না ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা। অবশ্য এখন পর্যন্ত আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে কোনো সংশয় দেখছে না বিসিবি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদলের ইতিবাচক মনোভাব দেখে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তাঁরা। আজ সন্ধ্যায় বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স ইনচার্জ শাহরিয়ার নাফীসও সংবাদমাধ্যমকে সেটাই জানিয়েছেন।

শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে নিরাপত্তা মহড়া দেখছেন ররি স্টেইন

এর আগে দুপুরে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিরাপত্তা মহড়া দেখার পর প্রতিনিধিদল কথা বলেছে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের সঙ্গে। পরে তারা আরও দুটি সভা করেছে সেনানিবাসে ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে। সেখানে নাকি নির্দিষ্ট একটা ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে চেয়েছেন তাঁরা—আগস্টে বাংলাদেশে যে রকম সহিংস পরিস্থিতি হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সফরের সময় আবার সে রকম কিছু হবে না তো!

প্রতিনিধিদল অবশ্য যাওয়ার আগে বিসিবিকেও তাদের কোনো মতামত জানায়নি। দেশে ফিরে তারা সেটা জানাবে ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকাকে, আর বিসিবিকে জানাবে ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা। নেলসন ম্যান্ডেলার প্রধান বডিগার্ডের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ সফর দক্ষিণ আফ্রিকা দলের জন্য কতটা নিরাপদ, সেটা জানা যাবে তখনই।