এই বিশ্বকাপে হলে তো ভালো, নয়তো পরের বিশ্বকাপে হবে। হবে মানে ভালো কিছু হবে। বিশ্ব দেখবে বাংলাদেশও পারে। কাজেই আশা ছাড়া যাবে না।
শেষ লাইনটার কি অন্য একটা অর্থও দাঁড়িয়ে গেল? ‘আশা ছাড়া যাবে না’ বললে তো মনে হয়, এবার বোধ হয় আশা করতে বারণ করা হচ্ছে। সে রকম কিছু নয় কিন্তু। ওই কথা বলে এটা বোঝাতে চাইছি না যে এই বিশ্বকাপে ভালো কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সত্যি বলতে কি, ভারতেও বাংলাদেশ কোনো একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে।
পেছনে বিতর্কের স্তূপ, অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বিশ্বকাপে ধাওয়া করবে কোটি কোটি দুরবিন। হতে পারে তাঁদের জন্য এটাই প্রেরণা হয়ে যাবে। দুজনেরই যে রকম কঠিন মন, ইটের জবাব পাথর ছুড়ে মারলেও মারতে পারেন। সেই ‘পাথর’ বাংলাদেশকে পুষ্পবৃষ্টিতে ভেজাবে, সন্দেহ নেই। কিংবা হতে পারে, দলে থাকা তারুণ্যের মিছিলটাই ধরল বিজয়ের স্লোগান।
তবে এই আশার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মাথায় আসছে এশিয়া কাপ শেষে কলম্বোর সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে বসে দেওয়া বাংলাদেশ কোচের সাক্ষাৎকারটা। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তখনই বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ বিশ্বকাপের জন্য আদর্শ অবস্থায় নেই। অনেক পরিকল্পনা, যেগুলো বিশ্বকাপের দুই বছর আগে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেগুলো নাকি ছয় মাস আগে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়েও দেখতে পাননি কোচ। হাথুরুসিংহে হয়তো সে কারণেই চাইলেন আশার বেলুনটাকে যতটা সম্ভব চুপসে রাখতে। ভারত বিশ্বকাপ নিয়ে আশার কথা না শুনিয়ে তিনি উল্টো বোঝাতে চাইলেন, আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। ভবিষ্যতের ক্রিকেটার খুঁজতে হবে।
বাঙালিও বরাবর তা–ই করে অবশ্য। মধ্যবিত্ত বাবা নিজে না খেয়ে, রিকশা–সিএনজিতে না চড়ে পায়ে হেঁটে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমান। সন্তান বড় হয়ে সেই টাকায় বিদেশ গিয়ে বাবাকে ভুলে যায়। অথবা নিজেও বাবার মতোই ভাবতে থাকে—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে। বিরোধী দল আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে এই ঈদ ফেলে পরের ঈদের পরের জন্য। গত কয়েকটা উপলক্ষে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ নিয়েও আমরা শুনতে পেয়েছি, ‘আমরা তো পরের বিশ্বকাপের কথা ভাবছি…।’
আমাদের এই ভবিষ্যৎ কদাচিৎই বর্তমান হয়ে ধরা দেয়। সে জন্যই আগে থেকে বলে রাখা—এই বিশ্বকাপে না হলে পরের বিশ্বকাপে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে পরের বিশ্বকাপটা খেলবেন কারা? অনেক তর্ক–বিতর্কের পর তামিম ইকবাল তো এবারই নেই। সাকিব আল হাসান সর্বোচ্চ ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত খেলবেন। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ নিজেরাও হয়তো ২০২৭ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেন না। তার মানে, মাশরাফি বিন মুর্তজার নীরব অবসরে যে ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠেছিল, সেটি প্রকট হতে হতে এখন শেষ বাঁশি বাজাচ্ছে। দেশের ক্রিকেটের সক্রিয় কিংবদন্তিদের এখানেই শেষ। এরপর কারা? বাংলাদেশের হয়ে কারা খেলবেন ২০২৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট?
চোখ বুজে ভবিষ্যতের কল্পনা করলে যে মুখগুলো ভেসে ওঠে, তাঁরা কি আদৌ এই বিশ্বাস জাগাতে পারছেন যে এবার না হলেও পরের বিশ্বকাপে ভালো কিছু হবে? সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের বাদ দিয়ে পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের দিকে চোখ রাখুন। তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ… এভাবেই তো আসতে থাকবে নামগুলো। প্রত্যেকে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েই আজকের এই জায়গায়। তাঁদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জ্যেষ্ঠতম তাসকিনের জাতীয় দলে ৯ বছর হয়ে গেছে। মোস্তাফিজ, লিটনের ৮ বছর করে। মিরাজ খেলে ফেলেছেন ৭ বছর। অন্যদের কথা নাই–বা বললাম। এবার যদি একটু পেছন ফিরে তাকান; বাংলাদেশের ক্রিকেটে ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে আলো ছড়িয়ে রাখা সাকিব–তামিম–মুশফিকরা তাঁদের ক্যারিয়ারের এ রকম সময়ে যে জায়গায় ছিলেন, তাঁদের ঘিরে যে আস্থার বুদ্বুদ আমরা তখনই টের পেতাম; সেটা কি এর পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ঘিরে টের পাচ্ছি?
আবারও বলি, পরের প্রজন্মের প্রত্যেকেরই সামর্থ্য আছে বাংলাদেশকে জেতানোর। অনেক উপলক্ষে জিতিয়েছেনও। মিরাজ তো ব্যাট–বলে সবভাবেই বাংলাদেশ দলে নতুন এক প্রাণ। কিন্তু প্রশ্নটা ভালো–খারাপ খেলার নয়, প্রশ্নটা তারকাসুলভ ব্যক্তিত্বের, ক্রিকেট মস্তিষ্কের, প্রশ্নটা অধিনায়ক হয়ে বা না হয়েও সামনের সারিতে থাকার, প্রশ্নটা আভা ছড়ানোর। সেই জায়গায় কেন জানি এখনো একটা শূন্যতাই বিরাজ করছে।
বিষয়টা আরও পরিষ্কার করতে বরং একটা প্রশ্ন করি। বাংলাদেশ দলে মাহমুদউল্লাহর সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল অবস্থা মাথায় রেখেও যদি বলি, এই ভারত বিশ্বকাপে সাকিব, মুশফিক বা মাহমুদউল্লাহরও বাংলাদেশ দলে যে অবস্থানটা আছে; পরের বিশ্বকাপে তাঁদের জায়গায় আপনি কাকে কল্পনা করছেন?
নামগুলো অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সেই ক্রিকেটাররা এই মুহূর্তে তাঁদের ক্যারিয়ারের যে সময়টা পার করছেন, যতটা অভিজ্ঞ তাঁরা হয়েছেন; সাকিব–মুশফিকরা যখন এটুকু অভিজ্ঞতায় ছিলেন; বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁদের অবস্থানটা তখন কোথায় ছিল? সে অবস্থায় কি এখনো আসতে পেরেছেন, আজ যাঁদের মুখগুলোকে আমরা আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশের তারকা বলে কল্পনা করছি?
জানি এখনই অত দূরের কল্পনা করা ঠিক নয়। হতে পারে, সব অনুমান ভুল প্রমাণ করে আগামী চার বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমনও তারকার আবির্ভাব ঘটে যাবে, যাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আমাদের পরের বিশ্বকাপের স্বপ্ন। আসলে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমরা ভবিষ্যৎ কেবল কল্পনাই করতে পারি। সে কল্পনার ভিত আবার হয় বর্তমান। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান তো ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের খুব বেশি আশাবাদী করে না বলেই মনে হয়। ভালো খেলোয়াড় পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যেও অনেকেই আছেন, কিন্তু সেই আভাটাই যেন নেই।
তবু ভবিষ্যৎ নিরপেক্ষকাল বলে তার কাছে সবারই সমান দাবি। আশা এবং স্বপ্ন থাকে, ভবিষ্যৎ আমার হবে। সে জন্যই বলি, এই বিশ্বকাপে যদি ভালো কিছু না–ও হয়, আসুন পরের বিশ্বকাপে চোখ রাখি।