গোয়ালিয়রের ছেলে গোবিন্দকে ‘উইকিপিডিয়া’ বলাই যায়। শহরের কোথায় কোন দর্শনীয় জায়গা আছে, তা একেবারে মুখস্থ। ট্যাক্সি চালানোর পাশাপাশি একটু বাড়তি আয়ের জন্য তিনি আধার কার্ড ও জন্মনিবন্ধন সংশোধনের কাজ করে দেন। কাজের কারণেই নাকি শহরের খুঁটিনাটি সব তথ্য তাঁর জানা।
ভারতের অন্যান্য শহরের সঙ্গে গোয়ালিয়রের পার্থক্যটাও তাঁর সৌজন্যেই পাওয়া। এই শহরের ছেলেমেয়েরা নাকি সবাই সরকারি চাকরিজীবী হতে চান। অন্যরা অভিনেতা কিংবা পরিচালক। গাড়ি চালানোর সময়ই তিনি এই শহরের নায়িকা রাভিনা টেন্ডনের বাড়ি দেখাচ্ছিলেন। গোয়ালিয়রে কয়জন পরিচালক আছেন, তা–ও জানালেন।
সরকারি চাকরি আর বলিউড–স্বপ্নের কারণেই নাকি গোয়ালিয়রে ক্রিকেটের উচ্চাশা এখনো ঢোকেনি। তাই এই শহর থেকে কোনো ভারতীয় দলে খেলা ক্রিকেটার তো দূরের কথা, আইপিএল খেলা ক্রিকেটারও বের হয়নি।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়ামে গেলেও তা বুঝতে পারবেন। ১৮ হাজার আসনের এই মাঠ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। খেলার মাঠের অংশটুকু ছাড়া ১৯৭৮ সালে তৈরি এ স্টেডিয়ামের কিছুই ঠিক নেই।
স্টেডিয়ামে ঢুকতেই অন্ধকার একটা আবহে ধাক্কা খাবেন। দেখবেন, দেয়ালে রংচটা কিছু ছবি লাগানো, পাশেই সোনালি অক্ষরে বিশাল করে ‘গোয়ালিয়র ডিভিশন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ লেখা। গোয়ালিয়রের স্থানীয় ক্রিকেট দলের ছবিও দেখা গেল।
স্যাঁতসেঁতে সেই দেয়ালেই দেখলাম শচীন টেন্ডুলকারের স্মরণীয় এক ইনিংসের স্কোরকার্ড। এই শহরে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে শচীন স্মরণীয় এক কীর্তিই গড়েছিলেন। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে দুই শ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যও এ মাঠ তাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কিন্তু এই মাঠেই এখন গ্যালারি বলতে কিছু নেই, ড্রেসিংরুমেও ময়লার স্তুপ। ফ্লাডলাইট জ্বলে না। আর অ্যানালগ স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালে আপনার খারাপই লাগবে।
টেন্ডুলকারের ওই কীর্তির পর ভারতের কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড় রূপ সিংয়ের নামে গড়া এ মাঠে আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি। অযত্ন আর অবহেলায় টেন্ডুলকারের দুই শর মাঠ এখন ধ্বংসস্তূপ। কোনো নিরাপত্তাও নেই। যে কেউ চাইলেই স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকে উইকেটের ওপর হাঁটাহাঁটি করে আসতে পারেন। বাকি আছে শুধু খেলার মাঠ। এখন পর্যন্ত মাঠটা ঠিক থাকায় স্থানীয় ক্রিকেটাররা অনুশীলন করতে আসেন। মাঝেমধ্যে হয় স্থানীয় লিগের ম্যাচও।
আজ সকালে মাঠে গিয়ে দুজন ক্রিকেটারের দেখা পেলাম। তাঁদের একজন সৌরভ জাট। মাঠের এই দুর্দশার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তাঁর কথায়, ‘এই মাঠটা এখন আর মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অংশ নয়। গোয়ালিয়র ডিভিশন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অধীন আছে মাঠটা। এখানে অন্য কিছু বানানোর পরিকল্পনা আছে।’
এই মাঠ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সিকান্দার সিং যাদব অবশ্য আশার কথা শোনালেন। এই মুহূর্তে গোয়ালিয়রের ক্রীড়া সংগঠকদের সব মনোযোগ শহরের নতুন স্টেডিয়াম শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া ক্রিকেট স্টেডিয়াম নিয়ে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ দিয়ে নতুন স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক অভিষেক হবে।
শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ শেষ হলে গোয়ালিয়রের ক্রীড়া সংগঠকেরা নাকি আবার রূপ সিং স্টেডিয়ামের দিকে নজর দেবেন। শুরু হবে দুটি ফ্লাডলাইটের কাজ।
তা হতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর এ মাঠে ফিরবে বলে মনে হয় না। পুরোনোকে ভুলে ঝকঝকে নতুন শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মনোযোগ মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের। ৩০ হাজার ধারণক্ষমতার এ স্টেডিয়ামে এক বছরের মধ্যে ৫০ হাজার দর্শক খেলা দেখতে পারবে। ইনডোর, জিম—সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকায় কেউ পুরোনো ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়ামের দিকে হয়তো ফিরেও তাকাবে না!