বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে সাফল্য পাচ্ছেন রবিউল
বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে সাফল্য পাচ্ছেন রবিউল

বিপিএল

রোনালদো–ভক্ত রবিউলের গল্প

বিকেএসপিতে তখন বিসিএলের ওয়ানডে ম্যাচ চলছিল। মধ্যাঞ্চল আর দক্ষিণাঞ্চলের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন নির্বাচক হাবিবুল বাশার। মধ্যাঞ্চলের পেসার রবিউল ইসলাম নতুন বলে চোখ ধাঁধানো স্পেল করে বাউন্ডারির পাশে ফিল্ডিং করতে এলেন। রবিউলের স্পেলটা শেষ হতেই হাবিবুল এগিয়ে গেলেন। তরুণ পেসারকে ডেকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘ওয়েল বোলড রবিউল। ভালো হচ্ছে, চালিয়ে যাও।’ কথাটা শুনতেই মুখে হাসি টেনে নির্বাচককে ধন্যবাদ দিলেন রবিউল।

নির্বাচকের প্রশংসার কারণও আছে। জাতীয় ক্রিকেট লিগেও হাবিবুলের নজর ছিল রবিউলের দিকে। সেখানে ৪ ম্যাচে ৭ ইনিংসে ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন। একটি পাঁচ উইকেটও ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটের সে ছন্দ রবিউল ধরে রেখেছেন বিপিএলেও। রংপুর রাইডার্সের হয়ে ৩ ম্যাচে শিকার ৭ উইকেট। টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ারসেরা বোলিংও করেছেন এবার। কাল খুলনা টাইগার্সের বিপক্ষে ৪ ওভারে ২২ রানে ৪ উইকেট নেন এই ডানহাতি পেসার। হয়েছেন ম্যাচসেরাও।

অথচ এবারের বিপিএলে দল পাবেন কি না, তা নিয়ে রবিউলের নিজেরই শঙ্কা ছিল। ড্রাফট থেকে যখন রংপুর রাইডার্স তাঁকে দলে নেয়, খবরটা শোনার পর রবিউলের নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না! নিশ্চিত হতে বারবার প্রশ্ন করছিলেন। হয়তো ২০১৯ সালে রংপুরের হয়ে বিপিএল অভিষেকের স্মৃতিটা ভুলতে পারেননি।

কাল খুলনার বিপক্ষে ৪ উইকেট নেন রবিউল

২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসার পর বিপিএলে রংপুরের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন রবিউল। কিন্তু অভিষেকেই বিমার, নো বল আর চার-ছক্কা খেয়ে সেদিন ৪ ওভারে ৫৪ রান দিয়েছিলেন। কাল ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে রবিউল নিজেই এক প্রশ্নের ফাঁকে প্রসঙ্গটা তুললেন, ‘প্রথম বিপিএলে তো অনেক ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে (হাসি)!

তিন বলে তিনটা ছয়, নো বল...আমার মতে শুরুতেই এসব হওয়া ভালো। তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য খুবই ভালো। তাহলে তাঁর শেখার চাহিদা, কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, এসব জিনিস খুব ভালো শিখতে পারবেন।’

শুধু মাঠের পারফরম্যান্স নয়, রবিউল আলোচনায় আসছেন উইকেটশিকারের পর প্রিয় ফুটবলার রোনালদোর মতো উদযাপন করে। রোনালদোর মতো রবিউলও ৭ নম্বর জার্সি পরে খেলেন। রংপুরের ফেসবুক, টুইটারে চোখে পড়ে রবিউলের ৭ নম্বর জার্সি পরে উদযাপনের ছবি। কাল সংবাদ সম্মেলনেও উঠল সে প্রসঙ্গ, ‘আমার উদযাপন নিয়ে সবাই অনেক উৎসুক। উদযাপনের পেছনে যে আইনকনিক মানুষটা (ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো) আছেন, সেটা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক খেলোয়াড় কাউকে না কাউকে অনুসরণ করেন, আমিও একজনকে অনুসরণ করি।

তিনি কঠোর পরিশ্রমী ও অনেক শক্ত মানসিকতার। খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও তাঁর দল যেকোনোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, বড় মঞ্চেও। এ রকম এক মহাতারকার কাছ থেকে যদি কিছুটা হলেও আমি নিজের ভেতর নিতে পারি—কঠোর পরিশ্রম কিংবা শক্ত মানসিকতা যা–ই বলুন। সেটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে।’

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে এতটা পথ উঠে এসেছেন রবিউল

রংপুরের ছেলে রবিউলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তাঁর দুই ভাই রাশেদ আনান ও রাকিব সরকারের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। ছোটবেলা থেকে রবিউলরা তিন ভাই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বাবা এনামুল হক তিন ছেলেকেই পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনজনের মধ্যে একজনকে ক্রিকেটার হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সেই ভাগ্যবান রবিউল। ছোট ভাইয়ের জন্য বড় দুই ভাই খেলা ছেড়েছেন।

তবে রবিউলের প্রতিটি পদক্ষেপ সমর্থনও করেছেন। বড় ভাইকে তো নায়ক মনে করেন রবিউল, ‘আমার দুই কোচ হচ্ছেন আমার বড় ভাই ও মেজ ভাই। দুজনই সব সময় ফোন দিতে থাকেন। ওনারা আমাকে এত জ্ঞান দেন…আমার বড় ভাই আমার হিরো। উনি জীবনে অনেক ত্যাগস্বীকার করেছেন আমার জন্য। কী বলব, আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি। বড় ভাই, মেজ ভাই… তাঁরা আমার ক্যারিয়ারের জন্য সবকিছু করেছেন।’

রবিউল তাঁর একাডেমির কোচকেও আলাদা করে ধন্যবাদ দিয়েছেন, ‘আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি আমার একাডেমির কোচ নাদিম সাজ্জাদ ভাই। যখন আমি অনূর্ধ্ব-১৮ খেলি, তখন আমার কিছুই ছিল না। উনি এত সাহায্য করেছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওনাকে কখনো কিছু দিয়ে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। তবে নাদিম ভাই, আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।’

রবিউলের দুর্ভাগ্য, পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে সাফল্য দেখে যেতে পারেননি তাঁর বাবা, ‘২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা মারা যান। উনি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করতেন। আমি ইনজুরিতে ছিলাম প্রায় দেড় বছর। আমার ক্যারিয়ারে কী হবে, সেটা নিয়ে অনেক ভাবতেন। বাবা বেঁচে থাকলে এখন অনেক কিছু দেখতে পারতেন।’