‘অস্ট্রেলিয়া যদি আজ হারে, তাহলে এই রাগ টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোয় অন্যান্য দলের ওপর ঝাড়বে। ভেবে দেখুন আপনি কি চান।’ দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ চলার সময় এমনই একটা টুইট করেছিলেন পাকিস্তানের গতিতারকা শোয়েব আখতার।
সেই ম্যাচের আগে ঠিক একই ধরনের কথা বলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্সও। আইসিসির ওয়েবসাইটে লেখা এক কলামে উত্তরসূরিদের সতর্ক করে দিয়ে ডি ভিলিয়ার্স লিখেছিলেন, ‘আহত অস্ট্রেলিয়া অনেক বিপজ্জনক একটা দল।’
প্রশ্ন হচ্ছে, আহত অস্ট্রেলিয়া কেন এত ভয়ংকর? এই প্রশ্নের সুলুক সন্ধানের আগে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান অবস্থার একটু খোঁজ নেওয়া যাক। ফেবারিট হিসেবে খেলতে এসে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ম্যাচে ধরাশায়ী হয়েছে স্বাগতিক ভারতের কাছে। ১৯৯ রানে অলআউট হওয়া অস্ট্রেলিয়া সেদিন ম্যাচ হেরেছিল ৬ উইকেটে। পরের ম্যাচের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্যাট কামিন্সদের হারের ধরন ছিল আরও বাজে। ৩১২ রানের জবাবে ১৭৭ রানে অলআউট হয়ে হারতে হয়েছে ১৩৪ রানে। তবে হারের চেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু ছিল হারের ধরনটা।
একের পর এক ক্যাচ মিস এবং কোনো ধরনের লড়াই করতে না পারা। এমন হতশ্রী অস্ট্রেলিয়া দলকে শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, তা জানতে হলে রীতিমতো ইতিহাসের বই নিয়েই বসতে হবে। সব মিলিয়ে টানা দুই হারে অস্ট্রেলিয়া এখন রীতিমতো কোণঠাসা। আত্মবিশ্বাসও নিশ্চিতভাবে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিশ্বকাপের শুরুতে এমন অস্ট্রেলিয়া দলকে শেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। সেবার বারবার খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন এক রাজত্বের সূচনা করেছিল স্টিভ ওয়াহর দল।
সে বিশ্বকাপে ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছিল। প্রথম ম্যাচটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হওয়ায় প্রত্যাশিত জয় দিয়েই বিশ্বকাপ শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারতে হলো ৫ উইকেটে। তিন নম্বর ম্যাচেও হার দেখল ওয়াহবাহিনী। ১০ রানের সেই হার ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে।
তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সুপার সিক্সে যেতে হলে শেষ দুই ম্যাচে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার জন্য অবশ্য ভাগ্যও কিছুটা সুপ্রসন্ন ছিল বলা যায়। শেষ দুই ম্যাচের একটি ছিল নবাগত বাংলাদেশের বিপক্ষে। সে ম্যাচে ৭ উইকেটের সহজ জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
সেই জয়ের পরও স্বস্তিতে ছিল না তাসমান দেশটি। কারণ, গ্রুপ পর্বে আগেই তিন ম্যাচ জিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ম্যাচে তাই জেতাটাই যথেষ্ট ছিল না, রান রেটে এগিয়ে থাকার চ্যালেঞ্জ ছিল। আর এমন বাঁচা-মরার ম্যাচে গ্লেন ম্যাকগ্রা ও শেন ওয়ার্নের যুগলবন্দী মাত্র ১১০ রানে অলআউট করে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। পরে ৪ উইকেট হারিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া।
গ্রুপ পর্ব শেষে ‘বি’ গ্রুপের পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে ছিল পাকিস্তান। ৪ জয়ে তাদের পয়েন্ট ছিল ৮। আর ৬ পয়েন্ট নিয়ে সমতায় ছিল নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেবল রান রেটে এগিয়ে থেকে সুপার সিক্সে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এমন দৈন্যদশা ছাড়েনি পরের পর্বেও।
সুপার সিক্সে অবশ্য শুরুটা ভালোই হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। প্রথম দুই ম্যাচেই জিতেছিল তারা। কিন্তু পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবার হারের স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া। ফলে সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচটি ছিল কার্যত ‘ডু অর ডাই’। সেমিফাইনাল খেলতে হলে জিততেই হতো সেদিন। সে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৭২ রানের জবাবে ৪৮ রানে ৩ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে ১২০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে দারুণ এক জয় এনে দেন অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ।
তবে সেই ম্যাচে অবদান আছে দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা ক্রিকেটার হার্শেল গিবসেরও। ৫৬ রানের ক্যাচ মুঠোয় নেওয়ার আগেই উদ্যাপন করতে গিয়ে বলটাই হাত থেকে ফেলে দেন গিবস। পরে তাঁকে ওয়াহ বলেছিলেন, ‘তুমি বিশ্বকাপটাই হাত থেকে ফেলে দিলে।’ এমনই আত্মবিশ্বাস ছিল অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের। এমনকি ম্যাচের আগে সাংবাদিকদেরও ওয়াহ বলেছিলেন, ‘আমরা সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছি।’
এরপর সেমির নাটকীয়তা তো কারও অজানা নয়। সেমিফাইনালে ২১৪ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। শেষ দিকে ঝড় তুলে প্রোটিয়াদের জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যান ল্যান্স ক্লুজনার। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য গিয়ে দাঁড়ায় ৪ বলে ১ রান। আর অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ১ উইকেট। কিন্তু এরপর সব এলোমেলো করে বসেন সেই ক্লুজনারই।
ভুতুড়ে এক দৌড় দিয়ে দেখে নন স্ট্রাইকে থাকা অ্যালান ডোনাল্ড জায়গাতেই দাঁড়ানো। দক্ষিণ আফ্রিকা যখন অলআউট হয়, তখনো বাকি দুই বল। প্রোটিয়াদের বিমূঢ় করে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টজুড়ে নাটকের পর নাটকের জন্ম দেওয়া অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ফাইনালে স্নায়ুচাপ আর বাড়ায়নি। পাকিস্তানকে ১৩২ রানে অলআউট করে ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়ে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপাও। সে সঙ্গে ক্রিকেট ইতিহাসের অনবদ্য এক রাজত্বের সেদিন শুরু করে তারা।
এবারও প্রথম দুই ম্যাচের হার শোয়েব-ডি ভিলিয়ার্সকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই অস্ট্রেলিয়াকে, যারা হারার আগে কখনো হারে না। যারা জানে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। বিশ্বকাপ ছাড়া অসংখ্যবার এমন হার না মানা লড়াইয়ের দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিল তারা। প্যাট কামিন্সরা তাই জানেন, কোন ঐতিহ্যের ধারা তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই ঐতিহ্যই হয়তো দুই ম্যাচে হারার পর জাগিয়ে দিতে পারে দলটিকে। কে জানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই হয়তো হতে পারে শুরুটা। কামিন্স এর মধ্যে বলে দিয়েছেন, ‘আস্তিন গুটিয়ে আমরা প্রস্তুত।...আমাদের প্রত্যেক ম্যাচ ফাইনালের মতো।’ এখন ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন উপাখ্যান রচিত হয় কি না সেটাই দেখার অপেক্ষা।