ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, ভিভিএস লক্ষ্মণ বা বর্তমান ভারতীয় দলের পেসার মোহাম্মদ সিরাজের শহর হিসেবেই হায়দরাবাদের পরিচিতি। তবে এই শহরে আরও একজন আছেন, ভারতের ক্রিকেটের সঙ্গে যাঁর নামটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে—মান সিং। ভারতের ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের ম্যানেজার। হায়দরাবাদের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে লেখা বিখ্যাত বই ‘ক্রিকেট বিরিয়ানি’র লেখক।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে হায়দরাবাদে মান সিংয়ের পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘রাম সিং আগারওয়াল ওয়াইনস’–এ তাঁর সঙ্গে দেখা। ব্যবসাটা এখন দেখাশোনা করেন ছেলে বিক্রম মান সিং। হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত বিক্রম।
’৮৩ নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সিনেমার সৌজন্যে মান সিংকেও বিশ্বকাপ জয়ের সম্মুখ শ্রেণির নায়ক মনে করা হয়। তিনিও ইতিহাসের অংশ হতে পেরে গর্বিত
প্রায় ৮৬ ছুঁই ছুঁই মান সিং এখনো কেতাদুরস্ত হয়ে অফিসে আসেন। তাঁর অফিসে ঢুকলেই দেয়ালে কপিল দেবের সেই মঙ্গুজ ব্যাটের রেপ্লিকায় চোখ পড়বে। ’৮৩ বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ দেওয়া তাতে। ব্যাটের স্টিকারের জায়গায় বড় করে লেখা ‘১৭৫’, সেই বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা কপিলের তখনকার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড। পাশে ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা কপিল, ইমরান খান ও রিচার্ড হ্যাডলির সাদা–কালো তিনটি ছবি। ঝুলছে বছর কয়েক আগে ’৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের পুনর্মিলনীর একটি রঙিন ছবিও। কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কার, মহিন্দর অমরনাথ, রবি শাস্ত্রী, সৈয়দ কিরমানিসহ পুরো দলের সঙ্গে তাতে আছেন হাস্যোজ্জ্বল মান সিংও।
মান সিং এই বার্ধক্যেও হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে এত সুন্দর করে কথা বলেন যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কথা যত এগোয়, বিস্ময় তত বাড়ে। মনে হয়, ১৯৮৩-এর বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক লেখা পড়ে আর ভারতের সেই বিশ্বকাপ জয় নিয়ে বানানো ‘৮৩’ সিনেমা দেখেও কত কিছুই তো অজানা!
বিশ্বকাপ দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে মান সিংয়ের সম্পর্কটা ছিল তাঁর ভাষায় ‘বড় ভাই-ছোট ভাই’য়ের মতো। সেটারও শুরু এই হায়দরাবাদ থেকে, ‘দলের অনেককেই আমি অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকে চিনতাম। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এখানকার আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট মঈন-উদ-দৌল্লাহ গোল্ডকাপ খেলতে সারা ভারত থেকে ক্রিকেটার আসত। সেই সুযোগে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ। ওরা আমাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখত।’
মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের সব সমস্যার সমাধান ছিলেন ‘মান ভাই’। খেলোয়াড়দের প্রয়োজনে তিনি নাকি বিসিসিআইয়ের নিয়মও ভাঙতেন! তখন ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা টিম হোটেলে থাকতে পারতেন না। কিন্তু মান সিং খেলোয়াড়দের স্ত্রীদেরও দলের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করেন, ‘বিসিসিআইয়ের চুক্তিতে ছিল খেলোয়াড়ের স্ত্রীরা টিম হোটেলে থাকতে পারবে না। টিমের বাসে যেতে পারবে না। কিন্তু আমার এসব খুব একটা যৌক্তিক মনে হতো না।’
ভারতের ’৮৩–এর বিশ্বকাপ জয়কে বিশ্ব ক্রিকেটেরই বদলে যাওয়ার ইতিহাস মনে করেন মান সিং। যে ইতিহাসের অনেক অজানা গল্প জমা হয়ে আছে তাঁর হাঁড়িতে।
’৮৩ বিশ্বকাপে ভারতকে কেউ ফেবারিটের তালিকাতেও রাখেনি। আগের দুই বিশ্বকাপে জয় ছিল মাত্র একটি, সেটাও পূর্ব আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে। স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে কপিল দেবের দল ছিল ‘লো প্রোফাইল’। মান সিং মনে করেন, ভারতীয় দলের জন্য তাতে সুবিধাই হয়েছিল, ‘বিশ্বকাপের আগে আমাদেরকে কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। তবে আমাদের ওপর তখন কোনো চাপও ছিল না। ১৯৮৭ সালে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপেও আমি দলের ম্যানেজার ছিলাম। সেবার দলের প্রতি সবার প্রত্যাশা ছিল, চাপ ছিল। কপিলও ’৮৩–তে পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, মাঠে ১১০ ভাগ দিতে হবে, মাঠের বাইরে যা ইচ্ছা করুক, সমস্যা নেই।’
লর্ডসের ফাইনাল নিয়ে মান সিং বলেছেন, ‘লর্ডসেও আমরা সেদিন হাসতে হাসতে গিয়েছি। আগের রাতে গেট টুগেদার করেছি, দলের সঙ্গে যারা ছিল, প্রেস, সাবেক ক্রিকেটার, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। আমাদের গেট টুগেদার দেখে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক টনি লুইস মজা করে তাঁর এক কলামে লিখেছিলেন, “ইন্ডিয়ান টিম সেলিব্রেটেড ভিক্টরি ইন অ্যাডভান্স।”’
টনি লুইসের কথার সূত্র ধরে বিক্রম মনে করিয়ে দেন ডেভিড ফ্রিথের বিখ্যাত কলামের কথা, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারত ফাইনাল খেললে আমি নিজের কথা নিজে গিলব।’ বাবাকে থামিয়ে বিক্রম হাসতে হাসতে বলেন, ‘বিশ্বকাপের পর উইজডেন আমার বাবার চিঠিসহ ছবি ছেপেছিল। ফ্রিথ লিখেছিলেন, “আমি আমার নিজের কথা নিজে গিলে ফেলেছি।” ’৮৭–এর বিশ্বকাপে বাবা ছিলেন ম্যানেজার, সেমিফাইনাল ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ডেভিড ফ্রিথও এসেছিলেন। ম্যাচের এক দিন আগে একটা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বাবাকে ফ্রিথ বলেছিলেন, “আমি আপনাকে কীভাবে ভুলতে পারি! আপনি আমাকে নিজের কথা গিলতে বাধ্য করেছিলেন।”’
কপিল ও গাভাস্কারের দা-কুমড়া সম্পর্কের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা এখনো মনে আছে মান সিংয়ের।
মান সিংয়ের আরেক গল্পের দুই চরিত্র ভারতীয় ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি কপিল দেব ও সুনীল গাভাস্কার। এখন দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও তখন যা ছিল, সেটাকে ‘দো লেজেন্ড ক্যা টক্কর’ ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারলেন না মান সিং। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, বিশ্বকাপে রান–খরায় ভোগা গাভাস্কারকে টিম মিটিংয়ে কপিলের বলা সেই কথা, ‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগের দিন সন্ধ্যায় টিম মিটিংয়ে কপিল গাভাস্কারকে বলে, “সানি ইটস হাই টাইম ইউ গট রানস।” সমস্যা হলো, কপিল ওই অর্থে বলতে চায়নি। কিন্তু তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথাটা এমনই শুনিয়েছিল। যা শুনে কয়েকজন জুনিয়র খেলোয়াড়ও হেসে ফেলে।’
পরদিন গাভাস্কার ওই ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, মান সিং জানালেন সেটাও, ‘ম্যাচের আগে টয়লেটে দেখা হলে সুনীল আমাকে বলে, “কপিল কী বোঝাতে চায়? আমি রান করছি না যেহেতু, আমাকে বাদ দিয়ে দিক! আজকেও খেলানোর দরকার নেই। আজ কেন খেলাচ্ছে?” আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি। সুনীল রেগে বলে, “না না, আমি এখনই এটার সমাধান চাই। কপিলকে ডাকো।” এরপর কপিল এল। চিন্তা করুন, টয়লেটে আমি, কপিল ও সুনীল (হাসি)! সুনীল রাগান্বিত হয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আমার এখনই রান করা উচিত, এ কথা দিয়ে কী বুঝিয়েছিস?” কপিল বলল, “আমি ওইভাবে বলিনি।” তখনই বব উইলিস এসে কপিলকে টস করার জন্য তাড়া দিলে সে চলে যায়। সানিকে বলেছিলাম, “কপিলের ইংরেজিই এমন। তুই মন খারাপ করিস না।’
কপিল ও গাভাস্কারের দা-কুমড়া সম্পর্কের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা এখনো মনে আছে মান সিংয়ের, ‘আমি তাদের মধ্যে থেকে স্যান্ডউইচ হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন কপিল আমাকে ডিনারে ডাকল। পরদিন সকালে সুনীল আমাকে বলে, “বড়লোকের সঙ্গে খেতে যাচ্ছ। আমাদের কী হবে?” আমি তাঁকে বলি, “আজ সন্ধ্যায় তোর সঙ্গে যাব।” এমন অনেক ঘটনাই আছে, যা বাইরে আসে না।’
’৮৩ নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সিনেমার সৌজন্যে মান সিংকেও বিশ্বকাপ জয়ের সম্মুখ শ্রেণির নায়ক মনে করা হয়। তিনিও ইতিহাসের অংশ হতে পেরে গর্বিত, ‘গত কয়েক বছরে অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে, যেখানে পুরো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হিন্দু (দ্য হিন্দুর ইনভাইটেশনের ছবি দেখিয়ে) আর স্পোর্টসস্টার সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যখন আমরা সবাই একসঙ্গে হই, খুব ভালো লাগে। মনে হয়, আসলেই আমরা এমন কিছুর অংশ ছিলাম, যা এখন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।’
ভারতের ’৮৩–এর বিশ্বকাপ জয়কে বিশ্ব ক্রিকেটেরই বদলে যাওয়ার ইতিহাস মনে করেন মান সিং। যে ইতিহাসের অনেক অজানা গল্প জমা হয়ে আছে তাঁর হাঁড়িতে।