ফুটবল কোচ নাকি দুই প্রকার। কেউ চাকরিচ্যুত, কেউবা চাকরিচ্যুত হতে চলেছেন। বিগত বেশ কয়েক বছরের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচও দুই রকম—কোমল ও কঠোর। সমস্যা হলো, এই কোচরা ক্রিকেটারদের প্রতি বেশি কঠোর হলেও চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেন না। আর কোমল হলে তো আরও পারেন না।
কোচ–সংক্রান্ত আলোচনা যেহেতু, এর সূত্রপাত অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে রাসেল ডমিঙ্গোর বিদায়। নিশ্চয়ই ভুল ধরিয়ে দিতে চাইছেন। ডমিঙ্গোর চাকরি তো যায়নি, তিনি নিজেই ইস্তফা দিয়েছেন!
বিষয়টা আপাতদৃষ্টে সে রকমই মনে হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে আসলে ডমিঙ্গোর আর থাকার কোনো উপায় ছিল না। কোচ হিসেবে তাঁর কাজে অক্সিজেনপ্রবাহের একটার পর একটা জানালা বন্ধ হয়ে আসছিল আগে থেকেই। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি অনুভব করলেন, চাকরিদাতা বিসিবি তাঁকে আর ঠিক চাইছেই না, তখন সিদ্ধান্ত নিলেন সরে যাওয়ার।
বিসিবির চাকরি ছেড়ে কোচদের এ রকম বাধ্য হয়ে সরে যাওয়া আগেও দেখা গেছে। আবার কাউকে কাউকে বিসিবিই বিদায় করেছে চুক্তির সময় শেষ হওয়ার আগে। ডমিঙ্গোর আগে ছিলেন স্টিভ রোডস। ডমিঙ্গোর মতোই নিপাট ভদ্রলোক। ২০১৮ সালের জুনে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপের পরই চলে যেতে হয় তাঁকে।
ডমিঙ্গোর সময়ে বাংলাদেশ দলের সাফল্যের পাল্লাটা বেশ ভারী হলেও তাঁর ওপর থেকে বিসিবির মন উঠে যাওয়ার অন্যতম কারণ, দলে নাকি এই দক্ষিণ আফ্রিকানের কর্তৃত্ব ছিল না। খেলোয়াড়দের প্রতি আচার-আচরণে তিনি কড়া হেডমাস্টার হতে পারেননি। সঙ্গে বিসিবির না–বলা একটা কারণও যোগ করে নিতে পারেন। দলে বোর্ডের অযাচিত হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না পেশাদার মানসিকতার এই কোচ।
ইংলিশ কোচ রোডসের ওপরও ঠিক এসব কারণেই বিরক্ত হয়েছিল বিসিবি। ক্রিকেটারদের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন তিনি। কঠোরতা ব্যাপারটা ছিলই না সদা হাসিখুশি রোডসের মধ্যে। একপর্যায়ে অভিযোগ উঠল, তিনি নাকি টিম মিটিংয়েও কথা বলেন না। পরিকল্পনা দেন না। সব দেন কম্পিউটার বিশ্লেষক শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন। যদিও বাস্তবতা ছিল একটু অন্য রকমই।
রোডসের ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে ক্রিকেটারদের অনেকেরই সমস্যা হতো। অনেক সময় দেখা গেছে, টিম মিটিংয়ে তাঁর কথা ঠিকভাবে না বুঝেও কেউ ওপর-নিচে মাথা নাড়ছেন। সে তুলনায় ভারতীয় শ্রীনিবাসের হিন্দি ছিল সহজবোধ্য। তো রোডস ভেবে দেখলেন, তাঁর কথা যদি শ্রীনিবাস হিন্দিতে সবাইকে বুঝিয়ে দেন, তাহলেই তো ক্রিকেটারদের সুবিধা।
কোচ কী বার্তা দিতে চাইলেন, সেটা তখন তাঁরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। এই উপলব্ধি থেকেই রোডস তাঁর গেম প্ল্যান আগে শ্রীনিবাসকে বুঝিয়ে দিতেন। পরে রোডসের উপস্থিতিতে শ্রীনিবাস সেসব হিন্দিতে বুঝিয়ে বলতেন খেলোয়াড়দের। কিন্তু বিষয়টির ব্যাখ্যা এ রকম দাঁড়িয়ে গেল যে রোডস ড্রেসিংরুমে কোনো কথা বলেন না। সব বলেন শ্রীনিবাস। এমন কোচ থেকেই লাভ কী! অতএব বিশ্বকাপের পর রোডসকে বিসিবি বলে দিল, ‘ধন্যবাদ। আপনাকে আমাদের আর প্রয়োজন নেই।’
ব্যাটিং কোচ হয়ে ফিরে আসা সাবেক প্রধান কোচ জেমি সিডন্সের বিরুদ্ধেও বিসিবির আগের পরিচালনা পর্ষদের অনেকটা এ রকম ‘অভিযোগ’ই ছিল। সিডন্স সব সময় খেলোয়াড়দের হয়ে কথা বলতেন আবার খেলোয়াড়দের মধ্যে নাকি তাঁর পছন্দ-অপছন্দও ছিল। সঙ্গে যোগ হলো ২০১১ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা। বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার অনেক ইচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিসিবির খাতায় পাস মার্ক না পেয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল এই অস্ট্রেলিয়ান কোচকে।
এবার একটু চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সময়ে ফিরে আসুন। ভালো কথা, তার আগে আরেক সাবেক কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে হাথুরুসিংহের একটি মিলের কথা বলে নিই। হোয়াটমোর ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান, কিন্তু অর্জুনা রানাতুঙ্গা-অরবিন্দ ডি সিলভাদের কোচ হিসেবে বেশ কয়েক বছর শ্রীলঙ্কায় থাকা হয়েছে তাঁর। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কান হাথুরুসিংহে খেলোয়াড়ি জীবনের পর বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
অস্ট্রেলিয়ান মানুষ এবং কোচ হিসেবে বেশ কঠোর হলেও উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে হোয়াটমোরের ভালো ধারণা ছিল। ক্রিকেটারদের আবেগ-অনুভূতির খোঁজ রাখতেন। কঠোর মুখায়বের আড়ালে বেশ একটা রসিক চেহারা প্রকাশ পেত মাঝেমধ্যেই। সে তুলনায় শ্রীলঙ্কান হাথুরুসিংহে ছিলেন ভীষণ কাঠখোট্টা। ক্রিকেট ও ক্রিকেটীয় সব ফোল্ডার-সফটওয়্যারে ভরা একটা ল্যাপটপ ছাড়া তাঁর আর কোনো ধ্যানজ্ঞান ছিল বলে মনে হয়নি কখনো।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাথুরুসিংহের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ছিল নিয়মিত ঘটনা। মুমিনুল হককে প্রথমে ওয়ানডে এবং পরে টেস্ট থেকেও নির্বাসনে দিলেন। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তো ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা যেত প্রায় সময়ই। নির্বাচক কমিটির সদস্য, এমনকি অনেক সময় বোর্ড কর্মকর্তাদেরও তাঁর আচরণে মনঃক্ষুণ্ন হতে দেখা গেছে। দলের সঙ্গে হাথুরুসিংহের মন জুগিয়ে চলাটাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিসিবির জন্য।
বিসিবির সঙ্গে হাথুরুসিংহের সেই চুক্তি ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৭ সালের অক্টোবরেই তিনি জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ দলের কোচ আর থাকবেন না। একদিকে শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ার প্রস্তাব, অন্যদিকে বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিসিবির নির্লিপ্ততা—সব মিলিয়ে হুট করে বাংলাদেশের কোচের চাকরি ছেড়ে দেন হাথুরুসিংহে। বিসিবি পরে তাঁকে ডেকে এনে আলোচনায় বসে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিল থাকার জন্য। কিন্তু র্যাডিসন হোটেল থেকে সেদিন সাদা শার্ট পরা হাথুরুসিংহে সবাইকে এক রকম অপমান করেই বেরিয়ে যান।
একেকজন কোচের কাজের ধরন একেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাঁদের পারফরম্যান্সের মাপকাঠি হিসেবে ‘চারিত্রিক সনদ’–এর চেয়ে বেশি বিবেচ্য হওয়া উচিত সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব। কিন্তু কোচ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিসিবির চিন্তাটা একটু ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে।
কেউ খেলোয়াড়দের পিঠে স্নেহের হাত বুলিয়ে ভালো পারফরম্যান্স আদায় করলে হবে না। তাঁকে কড়া হেডমাস্টারই হতে হবে। কিন্তু সেই কড়া হেডমাস্টার আবার ‘স্কুল কমিটি’র মতের বাইরে গেলে তিনিও চলে যাবেন অপছন্দের তালিকায়। সব মিলিয়ে বিসিবি যে আসলে কেমন কোচ চায়, সেটা বোঝাই মুশকিল—কোমল নাকি কঠোর!